এক
এই কথাগুলো একান্তই আমার নিজের, ইচ্ছে না হলে জোর করে পড়ার দরকার নেই।
দুই
২৭এর বিসিএস এর সময়ে হলে ছিলাম। প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল সে ব্যাপারে কোন কথা নেই, পরীক্ষার দিন সকালে হল গেটে দোকানগুলোতে ২ টাকা দিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের ফটোকপি পাওয়া যাচ্ছিল।
বাবার সততার মন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে প্রশ্ন নেওয়ার ধান্ধায় যাইনি, নিজের বিদ্যার দৌড়ও যথেষ্ঠ ছিলনা, ফলাফল: প্রিলিতেই ফেইল। কিন্তু তখনই চোয়ালবদ্ধ পণ করেছিলাম ২৮-এ দেখে নেব।
এখন পর্যন্ত বিসিএস ইতিহাসের সবচেয়ে আচানক বিসিএস হিসেবে পরিচিত ২৮এর বিসিএস এর প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় টিকে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার দিকে এগিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে,
বলাবাহুল্য সেটা নিজের মেধার উপর নির্ভর করেই। পিএসসি চেয়ারম্যান এর ভাইভা বোর্ডও আমার আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিতে পারেনি, ভাইভা ভালো হয়েছিল, অন্তত আমার তাই মনে হয়।
তিন
অবশেষে রেজাল্ট হলো ২৮ বিসিএস এর। দুই বছরের বেশী সময় লাগিয়ে।
মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৫৭৮৩ জনের মধ্যে থেকে যে ২১৯০ জন ২৮তম বিসিএস এর বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য কমিশন সাময়িকভাবে সুপারিশ করেছে, আমার নাম তাদের মধ্যে নেই। প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আমি আসলে ফেইল।
সেল ফোন অফ রেখে এক বন্ধুর বাসায় ছটফট করে কাটিয়ে দিলাম দুই দিন। বাবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল।
বাবা তার সর্বস্ব দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করতে লড়েছিলেন ২ নম্বর সেক্টরে। ওসমানীর স্বাক্ষর করা একটা প্রশংসাপত্রও আছে বাসায়। কিন্তু ওই প্রশংসাপত্রের বানিজ্যিক ব্যবহারে বাবার ভীষণ আপত্তি ছিল বরাবর, আমাদেরকেও শিখিয়েছেন তাই।
পুত্রের ভবিষ্যত পথ নি®কণ্টক করার মত ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যাবহারের বিরুদ্ধে থাকা বাবার কাছে ওই প্রশংসাপত্র হালনাগাদ করার কোন গরজই ছিলনা। ওটা তাই এখন ব্যাকডেটেড।
চার
চেতনার সফল ব্যবসায়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত টার্মে ক্রমহ্রাসমান মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটাকে রাজনৈতিক স্বার্থে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থেই বাড়িয়ে দিলেন ৩০ শতাংশে। আর এবার সেই একই উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন কোটা সংরক্ষণ করা হবে।
এখন এই দেশে যাদের কোটা নেই বা আমার মত যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুজি করতে আগ্রহী নই, তারা এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেছে। এখন সরকারী চাকুরীতে মেধায় কেউ উত্তীর্ণ হয়না, ওটাও
একটা কোটা।
বিএসসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটি দেখুন-
২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় মোট আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ১২০৯৪৬ জন। প্রিলিমিনারী টেষ্ট ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মোট
৫৮৮১ জন প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়।
মৌখিক পরীক্ষায় ৫৭৮৩ জন প্রার্থী উপস্থিত এবং ৯৮ জন অনুপস্থিত ছিলেন। লিখিত এবং মৌখিক উভয় পরীক্ষায় মোট ৫১০৫ জন প্রার্থী কৃতকার্য হন
উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে ২১৯০ জনকে ২৮তম বিসিএস এর বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য কমিশন সাময়িকভাবে সুপারিশ করেছে।
বিসিএস (প্রশাসন)
মেধাকোটা -৯০ জন
প্রাধিকার কোটা -১০০ জন
সর্বমোট =১৯০ জন
বিসিএস (নিরীক্ষা ও হিসাব)
মেধাকোটা -৯ জন
প্রাধিকার কোটা-১০ জন
সর্বমোট =১৯ জন
বিসিএস (শুল্ক ও আবগারী)
মেধাকোটা =১৪ জন
প্রাধিকার কোটা =১৫ জন
সর্বমোট =২৯ জন
বিসিএস (পররাষ্ট্র)
মেধাকোটামোট =৭ জন
প্রাধিকার কোটা
মোট =৮ জন
সর্বমোট =১৫ জন
বিসিএস (পুলিশ)
মেধাকোটা =৯০ জন
প্রাধিকার কোটা =৯৯ জন
সর্বমোট =১৮৯ জন
বিসিএস (করআ
মেধাকোটা =২১ জন
প্রাধিকার কোটা =২৫ জন
সর্বমোট =৪৬ জন
বিসিএস (ইকনমিক)
মেধাকোটা =২২ জন
প্রাধিকার কোটা =২৪ জন
সর্বমোট =৪৬ জন
সূত্র- Click This Link
এই হল এখনকার অবস্থা। সবক্ষেত্রেই মেধার চেয়ে কোটা বেশী।
৫১০৫ জন প্রার্থী শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ, তার ভেতরে ২১৯০ জনকে চাকুরীর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তার মানে ২৯১৫ জনই চাকুরী পাচ্ছেনা। অথচ লক্ষ্য করুন কোটার নির্ধারিত পদের ভেতরে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়াতে ৮১৩ টি পদ আমাদের বিজ্ঞ(??) প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে খালিই থেকে গেল। আর জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ সময় থেকে দুই বছরের বেশী নষ্ট করে আমরা পেলাম একটা অশ্বডিম্ব।
জীবন শক্তিতে ভরপুর এই ২৯১৫ জনের মিলিত শক্তির চেয়ে এই দেশের এখন বেশী দরকার অযোগ্য, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা কোটায় থাকা ৮১৩ জন প্রতিবন্ধীকে।
আচ্ছা বলতে পারেন কারা এখন কোটার সুবিধা নিচ্ছে? পাক হানাদার বাহিনীর দোসররাইতো নাকি?
গত সরকারের সময়ে তারাই গাড়িতে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছে, এই সরকারেও উড়াচ্ছে। তারা মন্ত্রী হচ্ছে, দেশপ্রধানদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দিব্যি ক্ষমতার ব্যবহার অপব্যবহার সবই তারা করছে আর মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট আওয়ামীলীগ প্রধানও তার সাফাই গাচ্ছেন। বাহ, কি চমতকার দেখা গেল...
ফালতু আবেগ দিয়ে কি লাভ? আমার বাবা যুদ্ধে শরীরের অঙ্গ হারিয়েছেন আর আমি হারাচ্ছি আমার ভবিষ্যত।
এসব আবেগ ফাবেগের গুষ্ঠি মারি, আবার যদি যুদ্ধ বাঁধে, নিশ্চিত আমি রাজাকার হব।
পাঁচ
কারো মন্তব্যর কোন উত্তর দেওয়া হবেনা
ছয়, এখন সংযোজিত
নিচে মন্তব্যে একজন বলেছেন উত্তর না দিলে এই লেখা ব্লগে না দিয়ে ঘরে টানিয়ে রাখা উচিৎ ছিল..... তার উত্তরে আমার সংযুক্তি হিসেবে মেঘের পরে মেঘ এর মন্তব্যটাকেই এখানে তুলে দিলাম
মেঘের পরে মেঘ বলেছেন: @ শামীম ভাই, আপনি লেখকের দুঃখটা ধরতে পারেননি। বিসিএসে জবে ঢুকে সৎ না অসৎ হবে, সেটা পরের ব্যাপার। আমার পরিচিত আপনজন আছে, যে আজ পর্যন্ত একপয়সাও ঘুস খায়নি, এমনকি অফিসের টাকায় র'চাও খায়না। কথা হচ্ছে, এইযে ৩০% কোটা রাখা হল মুক্তিযোদ্ধা বলে, এবং ফলস্বরুপ প্রতিটি ক্যাডারে উপযুক্ত প্রার্থী না পেয়ে লোকই নিয়োগ দেয়া গেলনা, ব্যাপারটা কি আপনি মেনে নিতে বলেন? যেদেশে লাখ লাখ লোক বেকার, যেখানে প্রতি মাসেই প্রায়, টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজ, মিল কারখানা, ট্রেন বন্ধ করে বেকারের মিছিল বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে এই বাস্টার্ডরা কেবলমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যান্য কোটা চালু রেখেছে।
একজন প্রার্থীকে পুরো বিসিএস প্রক্রিয়া শেষ করতে ২ থেকে আড়াই বছর কাটাতে হচ্ছে। সব প্রক্রিয়ায় পাশ করেও যোগ্য প্রারথীরা বাদ পড়ছে এই বালের কোটার জন্য। (সরি স্ল্যাং বললাম ইচ্ছা করেই, লেখকের লেখা পড়ে, আর এই কমেন্ট করার সময় মানসিক অবস্হাই এর জন্য দায়ী)
আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজ অনেক বেশি সহনশীল। না হলে সব কয়টারে রাস্তায় পাইলে এতদিনে পিটাই লাশ করত।
সময় এসেছে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
জবাব দিন|মুছে ফেলুন | ব্লক করুন
আরেকটু যোগ করি, যাদের বর্তমান সময়ের বিসিএস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই তারা একদিন কষ্ট করে আমাদের সেন্ট্রাল লাইব্রেবীতে ঘুরে যাবেন। একটা ছেলে বা মেয়ে, যে বিসিএস করতে চায়, সে সেকেন্ড ইয়ার পার হওয়ার আগেই হন্ডুরাসের রাজধানী কি, পালাও এর মুদ্রার নাম, আলবেনিয়ার সংসদের নাম আর হুতু তুতসী দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট ইত্যাদী ইত্যাদি ফালতু বিষয়গুলো অপ্রয়োজনীয় হওয়া সত্বেও মুখস্থ করতে শুরু করে শুধু মাত্র এই বিসিএস দেবে বলেই। আর এই প্রকৃয়ার মধ্য দিয়ে যাবার ফলে যখন একজন পরিক্ষার্থী ভাইভা পর্যন্ত আসে তখন পৃথিবীর হেন গলি ঘুপচি থাকেনা, যেটা সম্পর্কে সে কিছু জানেনা। অথচ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই জ্ঞান তার কোন কাজেই আসেনা। তবু সে এই দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, জীবনীশক্তিক্ষয়ী প্রকৃয়ায় যায় কারণ সে এই দেশের প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা হতে চায়।
শুধু একদিন এসে ক্যাম্পাস, টিএসসি, মল চত্বর, কলাভবন, ডাকসু, রোকেয়া শামসুননাহার এর সামনের জীবনের সাথে সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ভেতরের জীবনটা তুলনা করে যান..... লাইব্রেরীর ভেতরে থাকা ছেলে মেয়েরা কি দোষ করেছে যে তারা বাকি জায়গাগুলোর উপভোগ্যতা থেকে বঞ্চিত থাকবে?
তবু তারা করে। শুধু মাত্র বিসিএস এর জন্যে। আর এত কিছুর পর তারা জানতে পারে পরীক্ষার সব ক্ষেত্রে পাশ করেও এবং পদ ফাকা থাকার পরও তারা চাকরী পাবেনা শুধু মাত্র কোটা নামের এক অভিশাপ এর কারণে।
নিতান্তই আমার দুঃখের প্যাচালী হওয়াতে আমি বলেছি কারো মন্তব্যর জবাব দেয়া হবেনা। এখনও তাই বলছি।
ভালো থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১০ রাত ৮:০০