somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিলেট ট্যুর - (শেষ পর্ব)

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জাফলং সম্পর্কে আগে থেকেই মনে ছবি আঁকা ছিল। সেটাতেই রং মাখাতে লাগলাম জাফলং ট্যুরের আগের রাতে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে দুই বন্ধু ভাবতে লাগলাম কিভাবে জাফলং যাওয়া যায়। নিজেদের ফুরন্তপ্রায় পকেটের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম - বাস কিংবা লোকাল সি এন জি তে করেই যাওয়া হোক, কিন্তু লোকাল সি এন জি পাওয়া গেলো না। রিক্সা নিলাম - গন্তব্য সুবহানী ঘাট। সেখান থেকে জাফলং এর বাস ছাড়ে। গিয়েই বাস এবং বাসের মধ্যে ফাঁকা সিট্ দুটোই পেয়ে গেলাম। দেখতে যতটা লোকাল ভেবেছিলাম আসলে ততটা ধীর গতির ছিলোনা সেটা। সাই সাই করে ছুঁটে চলছে জাফলং যাওয়ার বাস। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস আর কানে হেডফোনে বাজছিলো সিলেটি গান - " সুন্দরী ফুরি , তুমি মন খরলায় চুরি ,.... কোন দূর দেশত তাখি আইলায় নি উড়ি "

সিলেট - জাফলং রোড ধরে তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাস। রাস্তার দু পাশের অবারিত ধানক্ষেত আর গাছপালা দেখে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিচ্ছিলাম। যতটাই জাফলং এর দিকে এগুচ্ছিলাম প্রকৃতি ততটাই যেন রং বদলাচ্ছিলো। অনেকটা মেঘলা ও ধূসর ভাব প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন ক্রমশই বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।

জৈন্তাপুর পৌঁছানোর পর থেকেই পাহাড় আর আকাশের অপূর্ব মিতালি নজর কেড়ে নিচ্ছিলো। বাকি সারাটি পথ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম এ দৃশ্যে , এ যেন চোখের ও প্রশান্তি।


ভেবেছিলাম বাসের শেষ স্টপেজেই নামতে হবে, কিন্তু তার কিছু আগেই একটা বালক আমাদের ডেকে বললো -"ভাই আপনারা ঘুরতে আসছেন না ? তাহলে এইখানেই নেমে পড়ুন " ধড়ফড় করেই বাস থেকে নেমে পড়লাম। অনেকটা থমথমে পরিবেশ দেখে একটু দ্বিধান্বিতই হয়ে পড়লাম। আমি ভেবেছিলাম বেশ জমজমাট হবে জায়গাটা। সামান্য কিছু দোকানপাট চোখে পড়লো ঠিক-ই যার অধিকাংশ ছিল বন্ধ। সরু এক রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে এক আচারওয়ালা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম যে সঠিক পথেই এগোচ্ছি। দুপাশে পাথর ভাঙার মেশিন আর স্তূপীকৃত পাথর। আর তার পেছনেই দেখতে পেলাম সবুজে আবৃত পাহাড়।

আমার কাছে পাহাড় মানেই নিস্তব্ধতার অপর নাম। শব্দ দূষণের শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের সান্নিধ্য তাই যেন পরম পাওয়া। রাস্তা থেকে পাহাড়ের দিকে কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলাম সাদা পতাকা দিয়ে চিহ্নিত সীমানা যার ওপারে ভারত। তার মানে সব পাহাড় ভারতের। শুধুমাত্র চক্ষু জুড়িয়ে নেয়াটাই আমাদের জন্য প্রযোজ্য। সেখানে দাঁড়িয়েই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একজন বাঙালি হিসেবে ভারতের সাথে পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে কষতে লাগলাম। পাহাড়গুলোর জন্য আসলেই মায়া হলো। এর খাঁজে খাঁজে ধোয়ারুপি মেঘগুলোর এলোমেলো বিচরণ, কোথাও কোথাও উঁকি দেয়া রুপালি ঝর্ণা, পাহাড়ি গাছের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে থাকা ঘরের চাল সবকিছুর মধ্যেই এক মায়াবী আবহ জড়িয়ে আছে।



আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখতে পেলাম একপাশে সারিবদ্ধ খাবারের দোকান আর সামনে কিছু গাড়ি পার্ক করা। বেশ কিছু ট্যুরিস্টের এলোমেলো পদচারণায় এখন কিছুটা জমজমাট অনুভূত হতে লাগলো জায়গাটা। একটা দোকানে ঢুকে চা খেয়ে নিলাম। কিছুদূর এগিয়ে টের পেলাম আমরা বেশ উঁচুতে দাঁড়িয়ে। অনেকটা পথ নিচের দিকে নামতে হবে। কোথায় যাবো, কেমনে যাবো , কিভাবে ঘুরবো ইত্যাদি ভেবে কিছুটা চিন্তিত হচ্ছিলাম যখন কিছু দালাল টাইপ লোকজন এসে বয়ান দিচ্ছিলো এইভাবে যে - পাঁচ টা প্লেসে নিয়ে যাবে, অমুক জায়গায় নিয়ে যাবে, তমুক জিনিস দেখাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একপর্যায়ে সব দালালের অফারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম, ভাবলাম যা আছে কপালে, সব একা একাই এক্সপ্লোর করবো। এমন সময় পেছন থেকে প্রায় ৮/১০ বছর বয়সী শুকনো মুখের একটি ছেলে আমাদের সাথে যেতে চাইলো।তার নাম হুসেন। মনে মনে ভাবলাম - বিছানাকান্দি ট্যুরের মতো একজন ফটোগ্রাফার হলে মন্দ হয় না। ছেলেটাকে ভালো ও মায়া দুটোই লাগলো। তারপর ও মজা করে অনেক্ষন দর কষাকষি করলাম তার সাথে। একপর্যায়ে যখন জানতে পারলাম যে বাবাহীন পরিবারে তার উপার্জন অনেকটাই মুখ্য, তখন আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ আর ক্যামেরা তার হাতে তুলে দিলাম।

সেখানে অনেক প্রফেশনাল ফটোগ্রাফের রয়েছে। কিন্তু তাই বলে এমন পুচকে এক ছেলের হাতে ডি এস এল আর কেউ আশা করে নাই , তাই লোকাল অনেকেই তাকে দেখে টিপ্পনি কাটছিলো, আর তার বিপরীতে হুসেনের সারল্য হাসি ছিল দেখার মতো। আমি সিলেটি ভাষায় হুসেনের সাথে দুস্টুমি করে কথা বলতে থাকি কিন্তু তার কথা ঠিক সিলেটিদের মতো লাগছিলো না। জিজ্ঞেস করলাম সে লোকাল কিনা। সে বললো - ট্যুরিস্টদের সাথে কথা বলতে বলতে সে তার লোকাল ভাষা ই ভুলে গিয়েছে।

হুসেনের সাথে কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে চলেছি। কোথায় কোথায় যাবো এ বিষয়টা তার সাথে কথা বলে মুটামুটি ঠিক করে ফেললাম। আগে থেকেই সে কিছু কিছু বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছিলো। যেমন : খাসিয়া পল্লীতে চা বাগানের কাছে যেসব খোলা চা পাতা বিক্রি হয় সেসব না কিনতে, অনেকেই মদ কেনার জন্য প্রলুব্ধ করতে পারে, তাদের সাথে ভালো বা মন্দ কোনো ধরণেরই কথা না বলতে, ৩০০ টাকার বেশি যেন অটো ভাড়া না দিই ইত্যাদি।

এবার বলি জাফলং এর প্রাথমিক ইম্প্রেশন টা। বিশাল পাহাড়ের বেষ্টনী। একটা ঝর্ণার স্বচ্ছ পানির ঢল নদীর মতন রূপ নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। দূর পাহাড়ে কিছু ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছিলো। ইন্ডিয়ানরা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে খুব সুন্দর করে ঘরবাড়ি গড়ে রেখেছে। যতবার এইদিকে তাকিয়েছি যেতে ইচ্ছে হয়েছে।।দুই পাহাড়ের মধ্যিখানে একটা ব্রিজ দেখা যায় যা ভারতেই। ব্রিজের নিচে প্রায় ৩০/৪০ টি ছোট নৌকায় করে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে ভারতীয়রা। তারা বাঙালি হলে নিশ্চিত ভাবেই একটা চান্স নিতাম কারণ মাছ ধরা আমার কাছে একটা নেশার মতনই। একটা পাহাড়ের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কালো রঙের গম্বুজাকৃতি বিশাল পাথর। হুসেন এর ভাষ্যমতে যা হলো গায়েবি মন্দির। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিশাল এক বালুচর রয়েছে। পশ্চিমে যতদূর চোখ যায় শুধু এ বালুচর ই।



সর্বপ্রথম নৌকা ঘাটে গিয়ে একটা নৌকায় উঠে বসলাম। হুসেন ই মাঝির সাথে দরদাম করিয়ে দিলো। খুব অবাক হলাম ছেলেটার ডেডিকেশন দেখে। খুব অল্প দামেই নৌকা দিয়ে পার হলাম। ওপারেই বালুময় এলাকা। হাটা শুরু করলাম। আমাদের গন্তব্য খাসিয়া পল্লী। অনেকদূর হেটে একটু উঁচু এলাকা পেলাম। সেখানে বেশ কিছু অটো এবং ব্যাটারি চালিত রিক্সা দেখতে পেলাম। রিক্সা ভাড়া বেশ সস্তা হওয়ায় সেটাই নিয়ে নিলাম।


নারকেল, পান আর সুপারি বনের মধ্য দিয়ে সরু ও আঁকা বাঁকা পথ ধরে রিক্সা এগিয়ে চলছে। হুসেনের মুখ থেকে শোনা - এটা খাসিয়া রাজার এলাকা। এখানকার অধিবাসীরা ভারতের নাগরিক। রাজা সাহেব কদাচিৎ এই এলাকায় ঘুরতে আসেন। এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর দেখছিলাম খাসিয়াদের সরু চোখ আর গোলাকৃতি চেহারা বিশিষ্ট মুখ গুলো। তাদের কর্মময় দিনের ব্যস্ততা, আর দেখছিলাম তাদের ঘরবাড়ি। কেমন যেন নিচতলাবিহীন দোতলায় থাকে ওরা। একটু অন্যরকম বাড়িগুলো রঙিন ও বেশ পরিপাটি।



একটা চা বাগানের কাছে এসে রিক্সা থামলো। বাগানের কাছেই বেশ কিছু অস্থায়ী দোকান রয়েছে যেখানে সাবান, ও কসমেটিক্স পাওয়া যাচ্ছে যার সবগুলোই ভারতীয় ব্রেন্ডের। দু একটা চাপাতার দোকান ও ছিল, কিন্তু হুসেনের চোখের ইশারায় সেখান থেকে চা কেনা থেকে বিরত থাকলাম। বেশ কিছু সাবান কিনে নিয়ে এবং চা বাগানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে রিক্সায় উঠে বসলাম। যেখান থেকে রিক্সায় উঠেছিলাম সেখানে এসে নামিয়ে দিলো। উঁচু এই স্থানটি থেকে পাহাড় আর বালুময় স্থানটিকে অসাধারণ সুন্দর লাগছিলো। সেখান থেকে নেমে বালুর মধ্যে দিয়ে হেটে পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগলাম। এখানে একটা ঝর্ণা রয়েছে। কেউ একে বলে মায়াবী ঝর্ণা আবার কেউ বলে মায়া ঝর্ণা। যে যাই বলুক - সেখানে এতটাই পর্যটক জড়ো হয়েছে যে রীতিমতো একটা বাজার বসিয়ে দিয়েছে। নীরব পরিবেশ পেলে হয়তো আসলেই মায়া লেগে যেত। সেখানে অল্প কিছু ছবি তুলে পেছন পথে হাটা দিলাম। গরম লাগছিলো তাই দুই বন্ধু মিলে আইস ক্রিম খেলাম। হুসেনকে সাধলাম কিন্তু খেলো না।


ফিরে আসার পথে আরো কিছু ভারতীয় পণ্যের দোকান পড়লো। এবার কিছু চকোলেট কিনে নিলাম। দুপুর তখন বেলা দুটো অতিক্রম করেছে। ক্ষুধায় মলিন মুখ নিয়ে হুসেনকে জিজ্ঞেস করলাম এখানকার ভালো খাবারের দোকান কোথায় পাওয়া যায়। সে বললো উপরে, তার মানে আমরা একদম প্রথমে যেখান থেকে নেমেছি। ক্লান্তি আর ক্ষুধা নিয়ে সেখানে যাওয়াটা অসম্ভব। তারপর সে নিচেই এমন এক খাবারের দোকান দেখিয়ে দিলো, যার অবস্থান ছিল একদম ভারত সীমান্তে, অর্থাৎ খাবারের টেবিলে বসে থু থু ফেললে তা ভারতে গিয়ে পড়বে।

রঙিন ছাতা টানানো বেঞ্চ আর টেবিলে বসে পড়লাম আমরা তিনজন। খাবারের মান প্রত্যাশার চেয়ে ও ভালো ছিল। আমি খেলাম বিশাল এক মাছের মাথা। ভাত আর দুই প্রকারের ভর্তা ছিল আনলিমিটেড। সোজা নদী থেকে তুলে আনা ঝর্ণার প্রাকৃতিক পানি খেলাম, সে এক অন্যরকম তৃপ্তি। খুব ভালো লাগা কাজ করছিলো যখন নিজেকে এভাবে আবিষ্কার করছিলাম যে - আমি বাংলাদেশের একদম কিনারায় বসে আছি। খুব মজা করে খেয়ে দেয়ে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিলাম।আমাদের জামা কাপড়, ব্যাগ, ক্যামেরা সবকিছু হুসেনের হাতে দিয়ে শুধু শর্টপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে দুই বন্ধু পানিতে নেমে পড়লাম। আ ,....হা কি যে ঠান্ডা পানি।
পানি ছিল প্রচন্ড রকমের ঠান্ডা আর স্বচ্ছ। মনে হচ্ছিলো আমি একুরিয়ামে ভাসছি। কিছু ছোট ছোট মাছ ও ঘুরাঘুরি করছিলো এমনকি আমার হাতে পায়ে রীতিমতো বাড়ি খাচ্ছিলো মাছগুলো। একটু গভিরে একটা বড় পাথর আছে যার ওই পাশেই ভারত। সুতরাং পাথর ক্রস করা যাবেনা, কারণ বিজিবি আর বি এস এফ এখানে বেশ তৎপর।


প্রায় এক ঘন্টা ডুবাডুবির পর উঠে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। কিছু ভারতীয় ট্যুরিস্টদের দেখলাম বর্ডারের কাছে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশী ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে আচার ও ঝালমুড়ি কিনে খেতে। খুব ইন্টারেষ্টিং ছিল এ কেনাকাটা যেখানে ক্রেতা এক দেশে দাঁড়িয়ে আর বিক্রেতা অন্য দেশে। আমিও বরইয়ের আচার কিনে খেলাম। ওয়ান টাইম গ্লাস আর চামচ দিয়ে খুব সুন্দর করে পরিবেশন করা হয় এই আচার। আরো কিছুক্ষন ছবি তুলে এবার ফিরতি পথ ধরলাম। ছোটোখাটো পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে এবার। চলার মধ্যিখানে দেখলাম একটা ছোট্ট মেয়ে কোমরে কলসি আর হাতে একটি টিনের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব কিউট মেয়েটির নাম অঞ্জনা যার বয়স সর্বোচ্চ ৫ হবে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পানি খেলাম আর তাকে কিছু টাকা দিয়ে দিলাম। সে শুধু মুচকি হাসছিলো , এমনকি আমরা কত টাকা দিচ্ছি সেদিকেও বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই তার। উপরে উঠে ঠান্ডা শরবত খেয়ে নিলাম। এবার হুসেনকে বিদায় দেবার পালা। নম্র, নির্লোভ ও আন্তরিক এই ছেলেটার প্রতি অনেক মায়া কাজ করছিলো। কিছু বোনাস সহ পুরো টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কিছু কিছু মায়া ক্ষণস্থায়ী হলেও তার অনুভূতি থাকে তীক্ষ্ণ। সেটাই টের পেলাম।


মেইন রোডে এসে আবারো বাসে চড়ে বসলাম। ফিরে আসার সময় একনজর পাহাড় সহ পুরো দৃশ্যটা চোখে গেথে নিয়েছিলাম আর বাসে বসে সেটাই মনের মধ্যে আটকে ছিল। মাগরিবের আজান পড়ছিলো আর স্নিগ্ধ সবুজাভ পথ ধরে আমরা ফিরছি সিলেট শহরের দিকে।

হজরত শাহপরান (র:) এর মাজার গেটে নেমে গেলাম। মেইন রোড থেকে বেশ কিছুটা পথ হেটে ভেতরে যেতে হয়। পথিমধ্যে একটা ভাঙাচোরা দোকানে বসে চা খেয়ে নিলাম। অসাধারণ ছিল চা টা। মাজার জিয়ারত করে বাইরে একটা দোকান থেকে চা পাতা কিনে নিলাম। সি এন জি তে করে হোটেলে ফিরলাম।

ফ্রেশ হয়ে ই বের হয়ে গেলাম। গন্তব্য সিলেটের বিখ্যাত পাঁচ ভাই রেস্তোরা। রিক্সায় চেপে ১০/১৫ মিনিটেই চলে গেলাম সেখানে। মানুষের ভিড়ে গম গম করছে হোটেল। কোনোরকমে দুটো সিটে বসে গেলাম দুজন। অন্যরা কি খাচ্ছে দেখছিলাম, এর মধ্যে মুরগির রোস্টটাই দেখতে ভালো মনে হলো। ওয়েটারকে ডেকে রোস্টের অর্ডার দিবো অমনিতেই বন্ধু শোয়েব জিজ্ঞেস করে বসলো - ভাই পাখির মাংস আছে নাকি ?? ওয়েটারের চটজলদি উত্তর : বকের মাংস আছে। আর যায় কোথায় !! অর্ডার দেয়া হলো বক। জীবনের প্রথম বকের মাংস খাওয়ার জন্য মুখে যেন লালা ঝরছিল। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, হোটেলে প্রচন্ড ভীড় থাকলেও ওয়েটারদের সার্ভিস ছিল অসাধারণ ডিসিপ্লিনড। একটু পর চলে এলো আস্ত বক ভুনা। চোখ, পেট, মন ভরে খেলাম।

হোটেলে ফিরেই ফেসবুকে স্টেটাস দিলাম - "" আর অমনিতেই ভার্সিটির এক ছোট ভাই পল্লব মেসেন্জারে ফোন নম্বর চাইলো। দিতেই কল দিলো। বললো - ভাই তুমি সিলেটে আসবা জানাইবানা!! আমি তো সিলেটেই জব করি , পাঁচ ভাই রেস্তোরার কাছেই আমার বাসা। রাত তখন প্রায় বারোটা। সে বললো সকালে দেখা করবে। যাই হোক - সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের ঢাকাগামী ট্রেন। ৭ টায় পল্লব এসে উপস্থিত। সকালের নাস্তা বীফ ভুনা খিচুড়ি সে ই খাওয়ালো। একসাথে গল্প গুজব করতে করতে স্টেশনে চলে গেলাম। সে খুব আফসোস করলো - ভাই তোমাকে আমার বাসায় নিতে পারলাম না।

ট্রেন ছাড়লো। এর মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বাইরে মেঘলা আকাশ আর রেললাইনের দুপাশে অবারিত সবুজ আর সবুজ যাতে বৃষ্টির পানি মিশে স্নিগ্ধতার অন্তিম সীমায় পৌঁছে গেছে প্রকৃতি। ট্রেন এগিয়ে চলছে গাছ পালা , বিল, জঙ্গল ছেদ করে আর আমি দুচোখ দিয়ে এই অপরূপ প্রকৃতি গিলছিলাম। কোথাও দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজে ছাতা নিয়ে বসে বড়শিতে কেউ মাছ ধরছে, কোনো এক দস্যি বালকের দল জাল দিয়ে মাছ ধরছে , কোনো গ্রাম্য মাটির ঘর থেকে বেরোচ্ছে রান্নার ধোঁয়া, পানিতে টইটুম্বর ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বকের ঝাঁক। আমি মুঘ্ধ হচ্ছিলাম বার বার। ট্রেনে বসে বৃষ্টির আবহ পুরোটাই উপভোগ করে যাচ্ছিলাম। বাদাম, ঝালমুড়ি, সিঙ্গারা, কলা, সেদ্ধ ডিম্, নানান কিছু খেয়ে উপভোগ করছিলাম মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ট্রেন।

প্রায় বিকেল করেই ঢাকায় এসে পৌছুলাম। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি আর পানি। রিক্সায় উঠে যখন বাসার দিকে যাচ্ছি তখন মনে মনে ভাবছি - আমি আসলেই সিলেটের প্রেমে পড়ে গিয়েছি।

এই পর্বে খরচাপাতি :
* দরগাহ গেট থেকে সুবহানী ঘাট / জাফলং গামী বাস স্ট্যান্ড রিক্সা ভাড়া ৩০ টাকা।
* জাফলং যাওয়ার বাস ভাড়া ৬o টাকা প্রতি জন।
* গাইড হুসেনকে ঠিক করা হয়েছিল মাত্র ১০০ টাকায়। তার অসাধারণ সার্ভিসে পরবর্তীতে আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়।
* জাফলঙে নদী পার হতে নৌকা ভাড়া ১০ টাকা প্রতি জন।
* খাসিয়া পল্লীতে যেতে রিক্সা ভাড়া ১৫০ টাকা। (অটো ভাড়া ৩০০)
* দুপুরে খাবারের প্যাকেজ ছিল। আনলিমিটেড ভাত ভর্তার সাথে মাছ হলে ৮০ টাকা আর মুরগি হলে ৯০ টাকা। মাছের মাথার দাম বেশি তাই ১০০ টাকা রেখেছে।
* হজরত শাহপরান (র : ) এর মাজার থেকে শহরের দরগাহ গেটের সি এন জি ভাড়া ৩০ টাকা প্রতি জন।
* দরগাহ গেট থেকে পাঁচ ভাই রেস্তোরা রিক্সা ভাড়া ২০ টাকা মাত্র।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৪
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিচারের জায়গা না পেলে মানুষ প্রেত হয়ে ওঠে

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ১২ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:৩৯


(সামাজিক অবিচার, রাষ্ট্রীয় অনুপস্থিতি এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঠামোর মধ্যে সাধারণ মানুষ কীভাবে হারিয়ে যায়।)

মানুষ যখন বারবার অবিচারের শিকার হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

=একদিন এসো সন্ধ্যে ফুরোলেই=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১২ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৫



ভালোবাসা ছড়ানো পাতায় পাতায়, সবুজাভ স্নিগ্ধ প্রহর আমার
এখানে উঁকি দিলেই মুগ্ধতারা চুয়ে পড়ে টুপটাপ;
ধূসর রঙ প্রজাপতিরাও এখানে রঙিন ডানায় উড়ে,
কেবল অনুভূতির দোর দিতে হয় খুলে, চোখগুলো রাখতে হয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

চীনের জে-১০ যুদ্ধবিমান কোনো চকচকে ল্যাব বা বিলাসবহুল ফ্যাক্টরিতে জন্মায়নি

লিখেছেন নাঈম আহমেদ, ১২ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৬

চীনের জে-১০ এর পেছনেও রয়েছে সেই ত্যাগ আর সংকল্পের গল্প—
১: গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) দলের অক্লান্ত পরিশ্রম।
২: বাইসাইকেলে চেপে কাজে যাচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী সু চিশৌ।
৩: প্রথম উড্ডয়নের পর কেঁদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Bangladesh bans ousted PM's Awami League under terrorism law

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১২ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫৬





হায়রে এরেই বলে কর্মফল। ১৭ টা বছর গুম , খুনের মাধ্যমে এক ভয়ের রাজ্য তৈরী করে কেড়ে নেয়া হয়েছিল মানুষের বাকশক্তি। চোখ, কান, মুখ থাকতেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিন গেলে আর দিন আসে না ভাটা যদি লয় যৌবন

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১২ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:২৬


এমন কোনো ইস্যু আছে, যা নিয়ে জাতি পুরোপুরি একমত? ৫০%ও একমত এমন কোনো বিষয় চোখে পড়ে না। একপক্ষ রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনেপ্রাণে ধারণ করে, আরেক পক্ষ বদলাতে চায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×