"পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকার গলুই ভেঙে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদে
জলজ গুল্মের ভরে, ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যতও নেই কোনখানে।"
প্রতিটি ভুলই এক একটি শুদ্ধতার পথ দেখায়। আর দুঃখ হচ্ছে জীবনের এমন একটি অলঙ্কার যা জীবনকে শুদ্ধ করে, পরিপূর্ণতা আনার চ্যালেঞ্জ এনে দেয় দেহে মনে আর প্রাণেও। কিন্তু ভুল থেকে, বিচু্যতি থেকে শিক্ষা নেয়ার কিংবা পথের অবলম্বন খুঁজে নেয়ার প্রবণতা খুবই কম আমাদের দেশে। যে যার ভুল, যে যার ব্যর্থতা আড়াল করতেই, লুকোতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে সবচে' বেশি ধূর্ত ও কৌশলী। জনতার সাথে সাপলুডু খেলায় প্রতিদিন, নিত্যসময় মেতে উঠে এ দেশীয় রাজনীতির পেশাদার খেলোয়াড়রা। খুউব সুকৌশলে, দক্ষতার সাথে। তাইতো আমরা দেখি-অনেক রক্তের স্রোতধারা পেরিয়ে শেষতম অবলম্বনের মত দাঁড়িয়ে থাকা 'পার্বত্য শান্তিচুক্তি' বাস্তবায়ন হয়না অজানা কারণে, কারো ভুলে,কারো আপোষকামিতায়, কারো সুবিধাবাদে, কারো সহিংসতায়ও বটে! শান্তিচুক্তি হয়, শান্তি আসেনা। রক্ত ঝরে ফুরোমোন, সাজেক আর চিম্বুকের পাদদেশে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঘর ছাড়া পাহাড়ী যুবকের গ্রামে ফেরা হয়না (অথবা ফিরতে পারে না) 'আপোষকামী আর সুবিধাবাদী' বিতর্কে। লাশ হয়ে যাবার ভয়েও। এখন ভয়ের সময়, সংহতির নয়। সবুজ পাহাড়ে এখন লাশের উৎসব, শান্তির নয়। তবুও আমরা শান্তিকামী মানুষ আশায় বুক বাঁধি, নতুন আলোর ভোরের প্রত্যাশায়। অপহরণ, খুন, জিঘাংসা বন্ধ হয়ে আবারও জুম পাহাড়ে ভালোবাসার গান গেয়ে উঠবে কোনো জুম্মবী, ভালোবাসায়-উচ্ছাসে।
রুদ্ধশ্বাস এ শহর ছটফট করে সারারাত
কখন সকাল হবে
জীয়নকাঠির স্পর্শ পাওয়া যাবে
উজ্জ্বল রোদ্দুরে।
পার্বত্য রাঙামাটি দিনে দিনে হারাচ্ছে তার রূপ। আমাদের ভালোবাসার শহর রাঙামাটি। বনমোরগ ছুটে বেড়ানো পাহাড়গুলির মুন্ডু কর্তন শুরু হয়েছিল বহু আগেই, এখন সেগুলো অস্তিত্ববিহীন। প্রকৃতির সন্তান পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে ইমারত, প্রশাসনের নাকের ডগায়, আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনও জড়িত অনেক স্থানে। অবাধ বৃক্ষ কর্তন চলছে, ক্রমেই বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে পার্বত্য অরণ্য। রিজার্ভ ফরেস্ট এ চারপাশে বৃক্ষ আছে ঠিক, কিন্তুু মাঝখানে মাইলের পর মাইল ফাঁকা, বৃক্ষশূন্য। এ দায় কার? কাপ্তাই লেকও মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ছে, অজস্র প্রজাতির মাছ বিলীন আজ । মাছ, গাছ, বাঁশ ব্যবসায়ী আর নব্য ঠিকাদাররা আমাদের এই জনপদের বারোটা বাজিয়েছে। অথচ এরাই আজ আমাদের নেতা, জনপ্রতিনিধি, অথবা দলীয় পৃষ্ঠপোষক। এদের কেউ ধানের শীষ, কেউবা নৌকা, কেউ কেউ আবার পাল্লা বা লাঙ্গল। কিন্তু সবার চেতনার স্রোত ঠিকই প্রবাহিত হয় অর্থের দিকেই। বাঃ! কি চমৎকার ঐক্য! পাহাড়ে খাদ্যাভাবে জনপদে নেমে আসছে হাতির পাল, হরিণশূণ্য হচ্ছে পাহাড় মানবীয় লোভে, কত অসংখ্য, অজস্র প্রজাতির পশু-পাখী যে হারিয়ে গেল, হারিয়ে যাচ্ছে সে খবর কে রাখে? হ্র্রদের পানি পানের উপযোগিতা নিয়ে কে ভাববে? বন বৃক্ষশূন্য হলে কার কি? হ্রদে মাছ না পেলে কি এমন ক্ষতি? আমরা তো প্রতি বেলা মাছ ভাত...। কেউ দাঁড়াবেনা বুক টান করে, সাহস নিয়ে। এই সময়ের তারুণ্যকেই রুখে দাঁড়াতে হবে নিজেদের ভবিষ্যত ভাবনায় সমৃদ্ধ হয়ে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগী এই শহর রেখে যেতে। আসুন আজ, এক্ষুনি হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে যাই প্রতিরোধে-প্রতিবাদে-দ্রোহে। কিংবা বিক্ষোভে আর বিপ্লবে।
মানুষের মনে, নাকি মানবিক আত্মায়
পড়েছে পলেস্তরা
বোধে আর প্রেমে তাই বসেছে পাথর, নাকি
হিংস্রতায় ভীত-সন্ত্রস্ত আমাদের পুষ্পিত বসুন্ধরা।
মাদকের বিষাক্ত নীল ছোবল এখন পাহাড়ী প্রতিটি শহরে। যে পাহাড়ী যুবক জুমে মায়ের পিঠে সওয়ার হয়ে জীবন ঘষে ঘষে মৃত্তিকার অবিরল ভালোবাসা আর সোঁদাগন্ধ নাকে নিয়ে বেড়ে উঠেছে তার হাতে কে, কারা তুলে দিল ভয়ংকর মাদক? কোন সে অপশক্তি পাহাড়ী তারুণ্যের মেরুদন্ড ভেঙে চৌচির করে দেয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত? আজ এখানে মুড়ি-মুড়কির মত বিক্রি হচ্ছে ফেনসিডিল, গাঁজা। অন্যান্য মাদকদ্রব্যও দুষ্প্রাপ্য নয়। প্রশাসন জানে, পুলিশ জানে, নেতারা জানে, আমি জানি, আপনি জানেন, কারা এইসব নিষিদ্ধ পণ্যের বিকিকিনি করছে, কোথায় করছে, কিভাবে করছে। তবুও অপরাধীরা ধরা পড়ছে না কেন? নাকি ধরা হচ্ছে না? মাদকের নীল বিষ পুরো শহরে। আসুন, রুখে দাঁড়ালেই যদি প্রতিহত করা যায় মাদকের ভয়াল থাবা, তবেই বেঁচে যাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।
কৃষ্ণচূড়া বিরহে উড়ে রাধাচূড়া চৈত্রের ধুলো
কোন শোকে পাতা ঝরে
ঝরে আমার বিষন্নতাগুলো।
কিছুই ভালো লাগে না আর। শৈশবের কত শরতে চিম্বুক আর ফুরোমোনের এই শহরে বুনো সৌন্দর্য চাঁদ আর আমি এক অবাক মৌনতায় ভালোবাসায় ভিজে ভিজে শুদ্ধ হয়েছি, ঋদ্ধ হয়েছি। আমার ছেলেবেলায় খালি পায়ে এই পাহাড়ী জনপদের সোঁদামাটির বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে দাবড়ে বেড়িয়েছি পুরো শৈশব-কৈশোর, আমি, আমরা, তুমিও কি নও? আজ তবে বহুকোষী মাল্টিন্যাশনাল ত্রাস, মাছ_গাছ-বাঁশের ফেরিওয়ালাদের পুঁজিবাদী আস্ফালন, নপুংসক ঠিকাদারদের চৌর্যবৃত্তির কাপুরুষতা, বর্জ্যের শিল্পায়নের নামে বিনষ্ট শহর, এসি-নন এসি হোটেল, পানি বিদু্যৎ (রক্ত বিদু্যৎ প্রকল্প), পিকনিক স্পট (যাত্রা শিল্পীর মত কৃত্রিম সাজে), আদিবাসী সংস্কৃতি রক্ষার নামে বিদেশীদের সামনে সং সাজিয়ে আমার বোনের বোতল আর বাঁশ নৃত্য, পিননখাদি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট-স্কার্ট সুশোভিত আদিবাসী মেয়ে- এইসব ভুলে, মননের নিউরন থেকে মুছে ফেলে আমি চলে যেতে চাই, পালাতে চাই এ শহর ছেড়ে। দূরে, বহুদূরে। কিন্তু এই শহর ছেড়ে আমি কোথায় যাবো? আমার অতীত নেই কোনো, শুধুই বর্তমান। আমার শেকড় আঁকড়ে আছে এই শহরের মাটি আর পলেস্তরা। তোমাদেরও নয় কি?
আমিও নদীর মতো হারিয়ে যাবো
আসবোনা ফিরে কোনদিন।
যে শহরে বেড়ে ওঠা, যে শহরের কিশোর-কিশোরীর স্বপ্নে আমার সবুজ উপস্থিতি, সেই শহরে ক্রমশঃ নিঃসঙ্গ আমি। শুধুই কি আমি? না। আমি, আমরা, তুমিওতো। শহরের প্রতিবাদী মুখগুলো কমতে কমতে বিলীন প্রায়। এককালের 'আপোষ নয় সংগ্রাম' স্লোগানওয়ালারা এখন মাথা নত করে মেনে নেয় স্লোগানের খন্ডাংশ 'আপোষ'। ভালো আর মন্দের লড়াই যেখানে ক্রমশঃ একতরফা হয়ে উঠছে সেই শহরে আমাদের থাকাতো নিরাপদই না ! তবুও পারিনা। মগজবিক্রির হাটে আমাদের বিশেষ নিউরন ভর্তি মাথা কেনার সামর্থ্য অনেকের থাকলেও সাহস নেই কারো। তাই অবিক্রিত নিউরনকে আরো ঝাঁঝালো করে হেঁটে বেড়ায় দুর্দন্ড দাপটে কিছু সাহসী মানুষ। যারা প্রতিরোধ করতে পারে, প্রতিবাদ জানাতে পারে। সাহসী মুখগুলোর প্রতি শহরবাসীর দিনে দিনে শ্রদ্ধা বাড়ে আরো । তবু প্রিয় মুখগুলো পালাতে চায়। দুপুরের ক্ষিপ্রতা যেমন সাঁঝে হারায় দাপুটে সূর্য, তেমনি জীবনের বেলা বয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত সাহসী মানুষগুলোও এখন পালাতে চায়, এই শহর ছেড়ে, এই জীবন ছেড়ে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? তাদের শৈশব মানেইতো ফুরোমোন, কৈশোর মানেই তো কাপ্তাই হ্রদ, পুরো জীবন মানেই তো এই শহর। তাইতো সাহসী কবির উচ্চারণে বলে-
'যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না, সে শহরে যুদ্ধ শেষের
ভাঙ্গা-পোড়ো একটি এয়ারপোর্টের মতো বেঁচে থাকবে তুমি,
যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সেই শহরে চরম
দুর্বোধ্যতম হয়ে বেড়ে উঠবে তোমার বিষন্ন সন্তান।'
১. ০৩ রা জুলাই, ২০১১ রাত ১:০৯ ০
সুন্দরের অপেক্ষায় থাকলাম।