পার্বত্য জেলা শহর রাঙামাটি থেকে দশমাসে দ্বিগুন অংকের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে গত একবছরে দশ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অন্ততঃ ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিতর্কিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানী ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ লিমিটেড। জনৈক উদ্দীপন চাকমার হাত ধরে রাঙামাটি জেলায় ব্যবসা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটিতে পঙ্গপালের মতো লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছে ক্ষুদ্র,মাঝারী এবং বড় অংকের টাকা উপার্জনকারী ব্যবসায়ী,চাকুরীজীবি সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে,গত একবছরে এই জেলায় অন্ততঃ দশ হাজার মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকেই দ্বিগুন মুনাফা নিলেও নব্বই শতাংশ মানুষেরই মূল টাকা উঠে আসেনি। উদ্দীপন চাকমার সাথে বনরূপা এলাকার দুই/তিনজন তরুন ব্যবসায়ী মিলে মানুষকে প্রলোভনে ফেলে টাকা বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার কার্যক্রম শুরু করলেও পরে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। নিম্মআয়ের মানুষ ছাড়াও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা টাকা রাখতে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানে। এদের মধ্যে একজন সাবেক সিভিল সার্জন তার পেনশনের প্রায় বারো লক্ষ টাকা,একজন অন্তর্বতীকালীন পরিষদ চেয়ারম্যানের স্ত্রী আট লক্ষ টাকা,আট থেকে আট/দশ জন পাহাড়ী ডাক্তার প্রত্যেকে দুই লক্ষ ১২ হাজার টাকা করে,কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান দুই লক্ষ টাকা করে দিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে। একইভাবে শহরের অনেক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী,ঠিকাদার এবং কাঠব্যবসায়ীও প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে বিরাট অংকের টাকা রেখেছেন এখানে। টাকা প্রদান করা ব্যক্তিরা প্রায় প্রত্যেকেই নগদ টাকা তুলে দিয়েছেন উদ্দীপন চাকমার হাতে। যারা কমিশন পেয়েছেন তারা ইন্টারনেটে কথিত পয়েন্ট এবং ডলার পেলেও তা উদ্দীপনকে বুঝিয়ে দিয়ে নগদ টাকাও নিয়েছে তার কাছ থেকে। বিষয়টি এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারও করেছে উদ্দীপন। তবে তিনি একাই নন,টারজেন চাকমা নামের আরো একজনও গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সরাসরি সংগ্রহ এবং কোম্পানীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানান তিনি। শহরের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, বড় ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন,সবাই নিজ দায়িত্বে টাকা রেখেছে,আমার কোন দায়িত্ব নেই।
আর ইউনিপের গ্রাহকরা জানিয়েছেন,গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন বাবদ গত একবছরে অন্ততঃ ৩০ লক্ষ টাকা ব্যক্তিগতভাবে আয় করেছে উদ্দীপন। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ীদের কোন আয়কর দিতে হয়না বলে তার প্রকৃত আয় কখনই জানা সম্ভব নয়। তবে উদ্দীপন ব্যক্তিগতভাবে ইউনিপে থেকে মাত্র ৫/৭ লক্ষ টাকা আয় করার কথা স্বীকার করেছেন। অত্যন্ত চতুর উদ্দীপন গ্রাহকদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য কোম্পানীর নামে রাঙামাটি পৌরসভা থেকেও ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করে নিজ কার্যালয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন। ট্রেড লাইসেন্সে ইউনিপেটুইউর মালিক হিসেবে উদ্দীপন চাকমার নাম আছে। আবার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিং নাম্বারের স্থানে কোন নাম্বার না দিয়ে লেখা হয়েছে ‘বনরূপা মোড়’। ব্যবসায়িক ধরণের স্থানে লেখা হয়েছে ‘ইকমার্স/মাল্টিলেভেল মার্কেটিং’।
গ্রাহকের টাকা পাওয়ার অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে উদ্দীপন চাকমার সাথে আলাপ হলে তিনি জানান,সবাই নিজ দায়িত্বে টাকা রেখেছে,এর জন্য আমি বা কোম্পানী কোন দায়দায়িত্ব নেবনা। এর দায় সরকারের বলেও দাবী করেন তিনি। তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যে টাকা জমা দিয়েছে,তারা জেনেশুনে বুঝেই দিয়েছে,যার যার দায়,তার তার।
উদ্দীপন চাকমা এর আগেও রিচআইবাজার,ননি,মডার্ন হারবাল,টিএনএসসহ নামে অন্য কয়েকটি এমএলএম কোম্পানীর কার্যক্রম চালিয়েছেন রাঙামাটিতে। সেগুলোর কার্যক্রমও এখনো চলছে। আবার একসময় ইন্স্যুরেন্স্ ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। তবে প্রতিদ্বন্ধী এবং বর্তমানে চলমান অন্যকয়েকটি মাল্টিলেভের মার্কেটিং কোম্পানী ‘স্পিক এশিয়া’ এবং ‘ভিসারেভ’ এর আইনগত কোন অনুমোদন নেই বলেও জানান তিনি। সবসময় উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনকারী এবং একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর গাড়ী ব্যবহার করা উদ্দীপন চাকমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আছে নানান গল্প। তার সহজ স্বীকারোক্তি-‘আমি যেখানে বেশি লাখ দেখি সেখানে যাই,তাই একের পর এক কোম্পানী বা ব্যবসা পরিবর্তন করেছি।’
এই দিকে ইউনিপের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ এবং এর কার্যক্রম সরকারীভাবে বন্ধ করা হলে মাথায় বাজ পড়ে রাঙামাটির গ্রাহকদের। কম টাকার বিনিয়োগকারীরা প্রায় প্রতিদিনই বনরূপাস্থ ইউনিপে কার্যালয়ে জড়ো হলেও বেশি টাকার বিনিয়োগকারীরা চক্ষু লজ্জা এবং সামাজিক অবস্থানের কারণে কার্যালয় অভিমুখীও হতে পারছেনা। আবার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্ত্রীর টাকা বিনিয়োগের খবর গ্রাহক সংগ্রহকালে ইউনিপের সদস্যরা বারবার ব্যবহার করলেও পরিবর্তিত বাস্তবতায় নিজেরা টাকা বিনিয়োগ করেছেন এমন কথাও স্বীকার করতে পারছেন ওই প্রভাবশালী স্ত্রীরাও। এনিয়ে শহর জুড়ে রয়েছে নানা মুখরোচক আলোচনা।
কেবল রাঙামাটি জেলা শহর নয়,রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলা থেকেও প্রচুর গ্রাহক সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অনেকেই বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন নিয়েও ইউনিপেতে দিয়েছেন বেশি লাভের আশায়। আবার স্বর্ণালংকার বন্ধক,পেনশনের টাকা,ডিপিএস ভেঙ্গে তোলা টাকা,বাগান বা জমি বিক্রি করেও হাজারো মানুষ টাকা রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানে।
ইউনিপের মাধ্যমে রাঙামাটি থেকে প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মাসুদ-উল-হাসান বলেন,ওদের ব্যাপারে যা শুনছি,তাতো অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার। আমরা অবশ্যই খোঁজ খবর নেবো এবং এই ব্যাপারে সরকারের যে নির্দেশনা আছে,তা পালন করা হবে। তিনি সবাইকে এই ধরণের প্রতারণার ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শও দেন।
বিতর্কিত একটি প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান প্রসঙ্গে রাঙামাটি পৌরসভার ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বলেন-ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে কেউ ট্রেড লাইসেন্স পৌরসভা থেকে নিতেই পারে,তবে এর মাধ্যমে তার ব্যবসায়িক বৈধতা প্রমাণ হয়না। তিনি বলেন-এদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন অনুমতিও নাই,তাই এটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান।