এডভান্স কম্পিউটিং, এজ কম্পিউটিং, ন্যানো টেক,কন্ট্রোল সিস্টেমস, সিলিকন সিরামিক্স, মেশিন লার্নিং, ফেসিয়াল রিকগ্নিশান, ভয়েস রিকগ্নিশান, ভিজুয়াল ডাটা প্রসেস, ইমোশনাল এক্সপ্রেশান রিকগ্নিশান, আরটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি এমেইজিং কারিগরি উতকর্ষের ছোঁয়ায় আজকের রোবটিক্স এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।
এদিকে টেলিকম ও আইটি এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুতই সম্পূর্ণ ফিফথ জেনারেশন (ফাইভ জি) সার্ভিস লঞ্চ হতে শুরু করবে দেশে দেশে। ফাইভ জি এক্সট্রিমলি হাই ডেটা, এক্সট্রিমলি লো লেটেন্সি (১ থেকে ৫ মিলি সেকেন্ড) এবং ম্যাসিভ কানেক্টিভিটি নিয়ে হাজির হয়ে দুরুত্ব ও ডেটাকে রিয়েল টাইম ট্রান্সফর্মেশন রূপ দিতে যাচ্ছে। ফলে ইতিমধ্যেই আলোড়ন তোলা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি রিমোট মেশিন অপারেশন, রিমোট সার্জারির, রিমোট ক্লাস ও কন্ট্রল সিস্টেমে এক অনন্য উচ্চতার যোগ এনে দিবে।
আগামীর দিনে রোবটিক্সের সাথে ৫ম প্রজন্মের টেলিকম টেকনোলোজি যোগ হয়ে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আরটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির রাজত্ব সব ইন্ডাস্ট্রিতে কায়েম হবে, বহু ইন্ডাস্ট্রি ও সেবা খাত এক নব রূপে আবির্ভূত হবে। শুরু হবে রিমোট সার্ভিস ও অপারেশন্স এর নব অধ্যায়। এর মধ্যমে কানেক্টেড কার, সেলফ ড্রাইভ ভেহিকল, প্রায় লেটেন্সি ফ্রি রিয়েল টাইম রিমোট রোবোটিক্স সার্জারি, লেটেন্সি ফ্রি রিয়েল টাইম রোবোটিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল অপারেশন্স, রোবোটিক মেডিক্যাল এসিস্টেন্স, রিমোট ক্ল্যাস, ডিসট্যান্ট লার্নিং, রিয়েল টাইম ডিসট্যান্ট কাস্টমার কেয়ার সাপোর্ট, রিয়েল টাইম ডিসট্যান্ট সেলস সাপোর্ট, যেকোন হার্ডোয়ার ট্র্যাকিং,যোকোন ভেহিকল ম্যানেজমেন্ট, স্মল ও লার্জ এন্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ইনভেন্টরি, যে কোন রিমোট হার্ডোয়ার ও সফটওয়্যার এপ্লিকেশন, এমনকি ইন্টার্যাক্টিভ রোবোটিক সেক্স পার্টনারের কন্সেপ্ট গুলো ধারণা থেকে বাস্তব রুপ পাবে। এই ধরনের বহু ট্রায়াল ইতিমধ্যেই হয়েও গেছে। অর্থাৎ শ্রম ঘন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ গুলো দিন দিন অটোমেশনের আওতায় আসবে। মানুষ নির্ভর সেবা খাত দিনকে দিন মেশিন সার্ভিসে রূপান্তরিত হবে।
এখন কথা হচ্ছে এই অভাবনীয় কারিগরি উতকর্ষের যুগে বাংলাদেশের ইন্টেলেকচুয়াল, একাডেমিক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট স্টেইক কেমন হবে। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রোবোটিক্স পড়ানোর ইনফাস্ট্রাকচার নেই। ল্যাব নেই টেলিকমের ৪জি'র, ৫জি 'র সিলেবাস কভারেইজ নেই কারিকুলামেও। যেখানে ৪র্থ ও পঞ্চম জেনারেশনে টেলিকম তার বেইজ স্টেশন থেকে শুরু করে কোর নেটোয়ার্ক সর্বত্রই আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়ে এসে গেছে, যেখানে আধুনিক সব আইটি'র রাউটার ভেন্ডর "এ আই" নিয়ে এসে গেছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষার সিলেবাসে বহুবিধ ডোমেইনের সাধারণ "এ আই" কনটেন্ট আনার বোধও তৈরি হয়নি, রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট তো দুরের ব্যাপার।
কিন্তু বিদেশি কোম্পানির হাত ধরে বাংলাদেশে টেকনোলোজির ইমপ্লিমেন্টেশন (ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন) একেবারেই বসে নেই। ইপিজেড গুলোতে রোবোটিক ইন্টাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন শুরু হয়ে গেছে, এডভান্সড কন্ট্রোল সিস্টেম এসেছে বহু আগেই। এতে করে টেকনোলোজি আমদানির শুরু করে দিলেও বাংলাদেশের নিজের টেকনোলজি ভিত্তি তৈরির হুঁশ তৈরি হয়নি এখনও।
এই ভিত্তি বলতে আমাদের বুঝতে হবে-
ক। রোবোটিক্স,আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও ৫জির একাডেমিক সক্ষমতা,
খ। রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট সক্ষমতা,
গ। অপারেশন্স ও সাপোর্ট সক্ষমতা,
ঘ। "এ আই" ক্যাপাবল হাই টেক পণ্যের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন সক্ষমতা (দেশীয় অথবা বিদেশী ম্যানুফ্যাকচারের বেইজ তৈরি)।
মানুষের জীবন-জীবিকাকে সহজ ও আরামদায়ক করে আনার প্রযুক্তিগুলো এখন ব্যবসায়ের বড় বড় পণ্য। "অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ‘দ্য ফিউচার অব এমপ্লয়মেন্ট’ নামের এক গবেষণায় অনুমান করেছেন, আসন্ন দশকগুলোয় রোবট টেকনোলজি প্রচুর ‘কাজ’ নিয়ে নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তাদের অনুমান, ভবিষ্যৎ দুই দশকে প্রায় ৪৭ শতাংশ কর্মজীবী সেখানে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে যেসব ‘কাজ’ দীর্ঘ সময় ধরে পুনঃপুন একই ধাঁচে করা করা হয়, সেগুলোতে মানুষকে প্রতিস্থাপন করবে রোবট। হিসাববিজ্ঞানের নামকরা প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসি এ বছরের ২৪ মার্চ এক অনুমান প্রকাশ করে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতোই যুক্তরাজ্যে কর্মহীনতার একই ঘটনা ঘটবে আগামী ১৫ বছরে অন্তত ১০ মিলিয়ন স্বল্প দক্ষ কর্মজীবীর বেলায়। অল্প পরিমাণ ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ দিয়েই অনেক ধরনের এমন সব কাজ করা সম্ভব, যেগুলো এখন মানুষ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে হিসাব কষে এও বলে দেওয়া হয়েছে, ৩১ লাখ ট্রাক-ট্যাক্সি-ডেলিভারি ভ্যানের চালক স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের কাছে কর্মসংস্থানের বাজারে পরাজিত হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে। ওয়ালস্ট্রিটে ইতিমধ্যে ট্রেড করছে রোবট। বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজার ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ কর্মীর জন্য এটা একটা বড় খবর বটে। যদিও উদ্বেগজনক খবর। এ রকম গবেষণা আরও হয়েছে, যেখানে দাবি করা হয়, ডিজিটাল ভয়েস সার্ভিস দিয়ে এমন অনেক কাজ সারা যায়, যা এত দিন ইউরোপ-আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের ‘অনলাইন লেবার’দের দিয়ে করাতে। কেবল যে এগুলো গবেষণা অনুমান তাও নয়; অনেক সত্য বাস্তবেই দেখা যাচ্ছে। জাপানে বৃদ্ধ মানুষের সেবায় ইতিমধ্যে কাজ করছে রোবটরা। অথচ একসময় অনুমান করা হতো, জাপানে বা উন্নত বিশ্বে প্রচুর নার্স দরকার হবে। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ সেখানে নার্সের বাজার নিয়ে আশাবাদী ছিল, কিন্তু এখন আর এই সেমি স্কিল্ড শ্রম বাজারেরও বাস্তবতা নেই, রোবোটিক ম্যাডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট এখন বাস্তবতা। বাংলাদেশের মতো মধ্য আয়ের অনেক দেশেই নির্মাণ খাত গুরুত্বপূর্ণ। রোবোটিকস যেসব খাত নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখছে, তার একটি নির্মাণ খাত। অতি স্বল্প সময়ে অনেক বড় নির্মাণ সমাধা করবে আগামী দিনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আপাতত যেসব খাতকে রোবটবিদ্যা বেশি টার্গেট করেছে, তার মধ্যে আছে খাবার বিতরণ খাত, জিনিসপত্র তৈরির ফ্যাক্টরি, পরিবহন ও কৃষি খাত।" (আলতাফ পারভেজের লিখা হতে)।
সোফিয়া রোবোটের নির্মাতা ‘হানসেন রোবোটিকস’-এর ওয়েব পেজ বলছে, ‘এমন এক জিনিয়াস প্রযুক্তি তৈরি করতে চায় তারা, যা কেবল বাঁচবে না, ভালোও বাসবে!’। এই বক্তব্যের মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অর্থ আছে। এর মানে হতে পারে জীবন যাপন, উপভোগ ও কর্মসংস্থানের বহু সেবা রোবোটিক এপ্লিকেশনে নিয়ে আশার বাস্তবতা আমাদের কড়া নাড়ছে। এই ধরণের দ্রুতগতির অটোমেশন উতকর্শের যুগে শ্রম ঘন দেশে গুলোর আন্সকিল্ড ও সেমি স্কিল্ড বৈদেশ শ্রম রপ্তানির বাজার, ঘনবসতি পুর্ণ অভ্যন্তরীণ জনমিতিক বাজারে উতপাদন ও কর্মসংস্থান সম্পর্ক কেমন হবে তার ভাবনা চূড়ান্ত করা জরুরী।
যেহেতু বাংলাদেশে কারিগরি বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়া দেশের তলানিতে তাই রোবোটিক্সের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আধুনিক টেলিকমের দুরন্ত সেবার মিশেলে তৈরি অটোমেশনের কাছে এখনই নিজের অভ্যন্তরীণ শ্রম ঘন কর্মসংস্থান বাজার হারিয়ে ফেলবে ব্যাপারটা সেরকম নয়। তবে বাংলাদেশের আমেরিকা, ইউ ও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজারের ব্যাপ্তি যে কমে আসবে, আন্সকিল্ড ও সেমি স্কিল্ড শ্রম বাজারের রোডম্যাপ যে মার্জিনালি টার্মিনেইট হবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। হলফ করে বলা যায় আগামী ১ দশকের ভিতরে বিদেশে বাংলাদেশের ফিজিক্যাল সার্ভিস ওরিয়েন্টেড ম্যানপাওয়ার বাজার (মেশিন অপারেটর, সুইপার, ড্রাইভার, নার্স, সাধারণ টেকনিশিয়ান ইত্যাদি) সিগ্নিফিক্যান্টলি হারাবে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ভবিষ্যৎ বিকল্প কি হবে?
বাংলাদেশ কি সামনের দিনে তার উচ্চ মান হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপে মন দিবে? প্রতিবেশী ভারতের উচ্চ সক্ষমতার আই আই টি 'র এত সুবিশাল সাফল্যও কি দেশটিকে কোন অনুপ্রেরণা বা দুরদর্শিতা এনে দিয়েছে? আমরা দেখেছি ভারত রোবোটিক্স, আইটি ও টেলিকম খাতে প্রোডাক্ট উৎপাদনে সক্ষম না হলেও বিশ্ব ব্যাপী এই খাতগুলোতে অপারেশন ও কারিগরি সাপোর্ট সক্ষমতা তৈরি করে স্কিল্ড কর্ম সংস্থান ও রেমেটেন্স বাজারকে অবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ কি প্রতিবেশী হয়েও এই দুরদর্শিতা ও ইন্টেলেকচূয়াল স্ট্রাটেজী বুঝতে পেরেছে? বাংলাদেশ কি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিদেশের বাজার চাহিদা উপযোগী করবে, দেশীয় কারিগরি উদ্ভাবকদের উৎসাহিত করবে নাকি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশী ব্যবসায়ীদের রোবোটিক পণ্য প্রমোট করবে????
বাংলাদেশকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি সোফিয়াদের কিনে আনবে নাকি সোফিয়া তৈরির নলেজ বিল্ড, রোবোটিক্সের ফরোয়ার্ড ব্যাকোয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রি লিংকেইজ, সোফিয়া সচল রাখার টেক সাপোর্ট দিবার মত যোগ্য ইনফাস্ট্রাকচার তৈরি করবে!!!
মার্কেট কম্পিটিশন খুবই র্যাডিয়ান্ট। ভারত-চায়না, কোরিয়া-জাপানের কারিগরি উতকর্ষের বিপরীতে এশিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতির দেশকে উৎপাদন শিল্পায়ন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে টিকে থাকতে হলে টেকনোলজি ডেভেলপ না করতে পারলেও অন্তত বাস্তবায়ন ও অপারেশন্স সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। টেকনোলোজি ট্রান্সফারে করিতকর্মা হতে হবে। নচেৎ নিজের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শ্রমবাজার হারিয়ে সোফিয়া তুষ্টিতে আহলাদ মিটাতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৫:২২