দীর্ঘ মেয়াদী বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বয়ে জাইকার সহায়তায় টোকিও ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশ পাওয়ার সিষ্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০ প্রণয়ন করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে প্রকাশিত ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৮% জিডীপি বৃদ্ধির মেঠডলজি ভিত্তিক এই মহাপরিকল্পনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ঠিক এই সময়ে জাইকার তত্ত্বাবধানে বিগ-বি (The Bay of Bengal Industrial Growth Belt," or BIG-B”) এর অনূকূলে বাংলাদেশ পাওয়ার সিষ্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১৫ এর কাজ এগিয়ে চলছে। এখানে পিএসএমপি-২০১০ থেকে ঠিক কি কি ডেভিয়েশান আসে তা দেখার এবং পর্যালোচনার অপেক্ষায় আছি আমরা।
বাংলাদেশ পাওয়ার সিষ্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০ এবং এই সংক্রান্ত জ্বালানী নিরাপত্তার স্ট্রাটেজিক পর্যালোচনা দেখুন এই লিংকে।
এটা অনুমেয় যে এই বিগ-বি পরিকল্পনায় মাতারবাড়ি-মহেশখালি কেন্দ্রিক এক বিশাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ এর হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে যা প্রস্তাবিত পায়রা পোর্ট পর্জন্ত এক্সটেন্ডেড হবে (এমনকি মংলা!)।
(ক) উচ্চ মান সম্পন্ন পরিবেশ গত সমীক্ষা এবং তার বাস্তবায়ন,
(খ) অতি উচ্চ মানের কয়লা এবং টেকনোলজি ব্যবহার নীতি এবং
(গ) উচ্চ মান সম্পন্ন শোধন (এক্সট্রিম্লী লো এমিশান সহ) এর গ্যারান্টি ক্লজ এর বাইরে আমরা
(ঘ) আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বছরে একাথিক স্বচ্ছ ও স্বাধীন অডিট
-এর নিশ্চয়তার ভিত্তিতেই শুধু আমরা এই মহা পরিকল্পনাকে স্বগত জানাই। অন্যথায় বাংলাদেশ ব-দ্বীপের বিস্তীর্ন উপকূলীয় ইকোসাইকেল ডার্টি এনার্জি কয়লা দিয়ে নস্ট হতে দেয়া যায় না কোন ভাবেই।
বাংলাদেশ পাওয়ার সিষ্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০ প্রাইমারি ফুয়েল সোর্স স্ট্রাটেজিতে অভ্যন্তরী কয়লা হতে ১১২৫০ মেগাওয়াট (২৯,০৭%) এবং আমদানিকৃত কয়লা হতে ৮,৮০০ মেগা ওয়াট (২১,৭১%) বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মোট টার্গেট ৩৮৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এর বিপরীতে শুধু কয়লাভিত্তিক ১৯ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে যা মোট উৎপাদন টার্গেটের ৫০.৭৮%।
আমদানিমুখী কয়লা ভিত্তিক উৎপাদন টার্গেটের (৮৮০০ মেগাওয়াট) এর অনুকূলে ইতিমধ্যেই ৫টি ১৩২০ মেগাওয়াট এবং ১ টি ৭০০ মেগাওয়াট সহ মোট ৭৩০০ মেগাওয়াট পরিকল্পনা জিটুজি বেসিসে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি করা হয়েছে অথবা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ পৌঁছানো হয়েছে। এর বাইরে আরো কিছু বৃহৎ আমদানী নির্ভর কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তির কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে দেশের অন্যান্য রিসোর্স ডোমেইন এর সাথে ডার্টি ফুয়েল এনার্জি কোল ব্যাপক ব্যবহার পরিকল্পনার সামঞ্জস্য রাখার নিরিখে এই অঞ্চলের অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ন ম্যাক্রো ইকোনমিক ভ্যারিয়াবল সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে একটি দীর্ঘ এবং গুণগত নাগরিক আলোচনার সূত্রপাত করা দরকার।
১। সুন্দরবন এর জিওসাইকেল এবং ইকোসাইকেল রক্ষা - মংলা পোর্ট ভিত্তিক কোল ট্রান্সপোর্টেশনের অনুকূলে বৃহত্তর সুন্দরবন এবং এর সারাউন্ডিং এলাকায় (খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট, পুরানো সুন্দরবন এলাকা) যে কোন ধরনের কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মুক্ত রেখে সুন্দরবনের জৈব বৈচিত্র রক্ষার সুদৃঢ় রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। সেক্ষেত্রে আমরা রামপাল কোল প্ল্যান্টকে নিন্মোক্তো কন্সেপ্টে সাবেক সুন্দরবন এলাকা থেকে সরানোর দাবি জানাই।
এখানে আমরা উপকূলীয় এলাকাকে ২ টি ফল্ট জোনে আনার সুপারিশ করছি।
জোন কন্সেপ্ট। (পটুয়াখালী-বরগুনা-পাথারঘাটা) এবং (গলাচিপা-কলাপাড়া-কুয়াকাটা)
ফল্ট লাইন-১ (পায়রা নদী) - পটুয়াখালী-বরগুনা-পাথারঘাটা বরাবর দেশ এর উপূকূলকে পুর্ব পশ্চিমে ভাগ করে পশ্চিমে সুন্দরবনের দিকে কোনভাবেই কোন তাপ বিদ্যুৎ এবং কোন ল্যান্ড ক্লেইম ইনফাস্ট্রাকচার না করা। মানে রামপাল এর প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্টকে প্রস্তাবিত পায়রা পোর্ট ভিত্তিক কোল ট্রান্সপোর্টেশনের অনুকূলে পটুয়াখালী-বরগুনা-পাথারঘাটার পূর্ব দিকে সরানোর দাবি।
ফল্ট লাইন-২ (গলাচিপা নদী) - গলাচিপা-কলাপাড়া-কুয়াকাটা ফল্ট লাইন-১ (পায়রা নদী-পটুয়াখালী-বরগুনা-পাথারঘাটা) জোনকে আরেকটু বর্ধিত করে গলাচিপা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করে এর পশ্চিম দিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ডেল্টা ইনফাস্ট্রাকচার এর আওতা মুক্ত রাখলে একদিকে সুন্দরবন রক্ষা পাবে অন্য দিকে ইলিশ সহ পায়রার মোহনা এবং পাথরঘাটা কেন্দ্রিক উর্বর সামুদ্রিক মৎস্য প্রজনন সুরক্ষা পাবে। সুন্দরবনের প্রান, পরিবেশ, ইকোসাইকেল এবং মৎস্য সম্পদের সুরক্ষায় এই লাইন মেন্টেইন করা রিকোমেন্ডেড।
উল্লেখ্য মংলা পোর্ট ট্রান্সপোর্টেশন কেন্দ্রিক রামপাল এর ১৩২০ মেগা ওয়াট তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প (বিউবো-এনটিপিসি ইন্ডিয়া) এই উভয় ফল্ট জোনের সাথে সরাসরি কনফ্লিক্টেড। সুতরাং আমরা এই প্রকল্প সহ অন্য যেকোন মংলা ভিত্তিক সাবেক বৃহত্তর সুন্দরবন এলাকা হতে সরিয়ে ফল্ট জোন লাইন-২ এর পুর্ব দিকে স্থানান্তর চাই। নিদেন পক্ষে পায়রার প্রস্তাবিত পোর্টের অনুকূলে ফল্ট জোন-১ এর পুর্ব দিকে।
আরো উল্লেখ্য যে এই ফল্ট জোন কন্সেপ্ট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঞ্চালন মহা পরিকল্পনার সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক নয়।
এর বাইরে- প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের আঁধার হালদা নদী রক্ষা
সুন্দরবন এবং পায়রার মোহনার পশ্চিম দিকের প্রাকৃতিক প্রান বৈচিত্র্যের আধার রক্ষার সাথে সাথে এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের আঁধার হালদা নদী, এর উৎস এবং অব্বাহিকাকে কোল প্ল্যান্ট মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করা জরুরি। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় অঙ্গিকার এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের আঁধারকে ইউনেস্কো কর্তিক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণার দাবীকে একটি মজবুত ভিত্তি দিতে পারে।
অর্থাৎ একটি পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি ব্যবস্থাপনাকে সামনে রেখে কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের ক্ষতিকর দিকগুলোর সকল পরিবেশ এবং প্রতিবেশ গত স্টান্ডার্ড মেইন্টেইন করার রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি চাই।
২। ইমিশান গ্যারান্টি ক্লজ এবং স্বাধীন আন্তর্জাতিক অডিট - সরকার উচ্চ কয়লার ব্যবহার নিশ্চিতে এবং হাইপারটিকেলের ইমিশাল লেভেল (পরিশোধন)এর গ্যারান্টি ক্লজ দিবে। প্রতি কোয়ার্টারে ১ টি আন্তর্জাতিক পার্যায়ের ইন্ডিপেন্ডেন্ট অডিট টীম ব্যবহৃত কয়লার মান এবং এমিশন অডিট করে স্বাধীন ভাবে নির্দিস্ট সময়ে তা উন্মুক্ত করবে। আন্তর্জাতিক পার্যায়ের ইন্ডিপেন্ডেন্ট আডিট এবং এসেস্মেন্ট ছাড়া সরকারের কোন বা জি টু জি বডির রিপোর্ট এবং ডেটাকে ক্রেডিবিল স্বীকৃতি দেয়া যাবে না।
৩। বেসরকারি খাতে কোল প্ল্যান্ট না বসানোর অঙ্গীকার- কোল স্ট্রাটেজিতে পরিষ্কার ভাবে বেসরকারি খাতে কোল প্ল্যান্ট না বসানোর অঙ্গীকার থাকবে। বেসরকারি খাতের কোল একদিকে যেমন উচ্চ মান সম্পন্ন কয়লার যোগান করতে পারবে না অন্যদিকে উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শোধন নিশ্চিত করতে পারবে না। ফলে পরিবেশ দূষণের অবারিত ক্ষেত্র হয়ে উঠবে এই বেসরকারি প্ল্যান্ট গুলো, রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক দুর্বিত্তায়ন দিয়ে প্ল্যান্ট অপারেট করার ধৃষ্টতা থাকব, তারা দায়িত্বশীলতা দেখাবে না, এটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় চরম সত্য। অন্যদিকে এসব কোম্পানি প্রান্তিক নাগরিককে ভূমিহীন এবং ইকোনোমিকিলি ডিস্প্লেইস করার কারখানা হয়ে উঠবে যাদেরকে পরবর্তিতে নগরের বস্তিতে বসবাসে বাধ্য করবে।
লিখোকের নিজস্ব কন্সেপচূয়াল আর্টিক্যাল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ রাত ৩:৪২