তিস্তার দুই কুলঃ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের গজব
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা ব্যারেজ রেকর্ড থেকে জানা গেছে, তিস্তার পানি বর্তমানে সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। তিস্তায় পানি প্রবাহ না থাকায় শাখা নদীগুলোও মরে যাচ্ছে। গজলডোবা ব্যারেজের কারণে এ অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষরস্রোতা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ত্রিশটি নদী এখন বিলীন হওয়ার পথে। এই গজলডোবা ব্যারেজের কারণে শুধু নদীই নয়, তিস্তা নদীবেষ্টিত লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর জেলায় মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তার কার্যক্রমও এখন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। ফলে হাজার হাজার একর ফসলী জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এক দিকে ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া অন্য দিকে তিস্তার ভারত অংশে গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট বন্ধ করে দেয়ায় বন্ধ হতে বসেছে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প। (উল্লেখ্য বাংলাদেশের তিস্তা সেচ প্রকল্পের উপকৃত এলাকা নির্ধারিত হয়েছিলঃ সাত লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে কৃষিযোগ্য জমি পাঁচ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর, প্রধান খাল ৩৪ কিলোমিটার, শাখা খাল ২৭৫ কিলোমিটার, সেকেন্ডারি খাল এক হাজার ৪৫০ কিলোমিটার, টারশিয়ারী খাল দুই হাজার ৭২০ কিলোমিটার, নিষ্কাষণ খাল পাঁচ হাজার কিলোমিটার জলকাঠামো (এরিগেশন স্ট্রাকচার) এক হাজার ৫১২ ড্রেনেজ স্ট্রাকচার, দুই হাজার ৩২০টি ও টার্নআউট ১৫ হাজারটি নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে এক লাখ ৮২ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে।)
এই মুহূর্তে ভারত ব্যারাজের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ করছে। ভারত ব্যারেজ নির্মাণ করে সেচ প্রকল্প ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এক তরফা পানি প্রত্যাহার করায় পানি সঙ্কটে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে তিস্তা। শুধু তিস্তা কেন, তিস্তার সংযোগ নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। যে স্থান দিয়ে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেই নীলফামারীর ডিমলার পশ্চিম চাতনাই ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামের কালীগঞ্জ পয়েন্টে তিস্তা বালুচরে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় তিস্তার পানি আশা করা দুরাশা মাত্র। তিস্তার পানি প্রবাহের গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দিলেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যাবে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল ১০৩৩ কিউসেক, ২০০০ সালে ৪৫৩০ কিউসেক, ২০০১ সালে ১৪০৬ কিউসেক, ২০০২ সালে ১০০০ কিউসেক, ২০০৩ সালে ১১০০ কিউসেক, ২০০৬ সালে ৯৫০ কিউসেক, ২০০৭ সালে ৫২৫ কিউসেক, ২০০৮ সালে ১৫০ কিউসেক, ২০০৯ সালে প্রায় শূন্য কিউসেক। এখন যেটুকু পানি আসছে তা বাঁধ চোয়ানো। পানি বিশেষজ্ঞরা বাঁধ চোয়ানো পানিকে কিউসেকের হিসেবে ধরেন না। তিস্তার পানি এখন সম্পূর্ণ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। তিস্তার পানি সরিয়ে নিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে।
ব্যারাজ দিয়ে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিস্তার বাংলাদেশ অংশ সরু খালে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতি বছর প্রয়োজনের সময় তিস্তার বাংলাদেশ অংশ পানিশূন্য থাকে। আর অসময়ে পানি ছেড়ে দেয়ায় প্রয়োজন না থাকলেও বর্ষায় দেখা দেয় বন্যা।
ভাটির দিক কে মরুকরনের দিকে ঠেলে দিয়ে উজানের দিককে সুজলা সুফলা করার উচ্চাভিলাষী প্রকল্পঃ
ভারত তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় একশ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা নামকস্থানে ২.২১৫৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। এর গেট রয়েছে ৫৪টি। গজলডোবা বাঁধের রয়েছে ৩টি পর্যায়। প্রথম পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খনন করে নৌপথ তৈরি। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে আগেই। ১৯৮৭ সাল থেকে ৫৪ টি স্লুইস গেটের মাধ্যমে সেচকার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে এ ব্যারেজের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জেলায় ৬১ হাজার, দার্জিলিং জেলায় ১৭ হাজার, মালদহ জেলায় ৩৮ হাজার, উত্তর দিনাজপুর জেলায় ২ লাখ ৪ হাজার একর জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। গজলডোবা বাঁধের সাহায্যে ভারত দুই হাজার নয়শ ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে শুকনো মৌসুমে তিস্তার প্রবাহ থেকে প্রায় ২ হাজার কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে প্রবাহিত করছে। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খালের মাধ্যমে ভারতের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কুচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচ সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
আরও পানি প্রত্যাহার!: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া গত বুধবার জানায়, রাজ্যের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে উত্তরাঞ্চলের অতিরিক্ত জমি সেচের আওতায় আনা হবে। এর অংশ হিসেবে আগামী বছর দেড় লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা হবে। মন্ত্রী বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সেচ চাহিদা মেটানোর মতো প্রয়োজনীয় পানি তিস্তায় নেই। তাই তিস্তা থেকে পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন। নিজেদের চাহিদা না মিটিয়ে বাংলাদেশকে পানি দেব কীভাবে?’ এর পরে রয়েছে আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প! আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের কি ভয়ংকর ও কদর্য রূপ!!
প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বন্টনে শতাংক ভিক্তিতে চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী তিস্তার পানির শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত এবং বাকি ২৫ ভাগ সংরক্ষিত থাকবে। এ চুক্তির পরপরই ভারত সরকার দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এখনকার বাতিল হওয়া চুক্তিঃ গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়াই তিস্তা চুক্তি
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে ১০ বছরের অন্তর্বর্তীকালীন। যদিও বাংলাদেশ ১৫ বছরের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। ২০ শতাংশ পানি নদী প্রবাহের জন্য সংরক্ষিত রেখে অবশিষ্ট পানি আধাআধিহারে ভাগ করে অবশিষ্ট পানির ৪৫ শতাংশ ভারত, ৩৫ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ। গজলডোবায় যে পানি পাওয়া যাবে তার ভিত্তিতেই এ হিস্যা নির্ধারিত হবে। কিন্তু গজলডোবায় পানি আসার আগেই উজানে ভারতের তিস্তা ব্যারাজ এবং নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা ব্যারাজ ছাড়াও ছোট ও মাঝারি সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার নদী, শাখা নদী, খাল, বিলে বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে নেবে। এতে শুকনো মওসুমে গজলডোবার পানিপ্রাপ্তিই থাকবে অনেক কম, যা বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত হবে না বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী প্রায় ১শ’ কিলোমিটার উজানে ভারতের গজলডোবায় পানি পরিমাপ করা হবে। গজলডোবা থেকে ভাটিতে ১শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে ভারতীয় এলাকায় চারটি বড় খাল, অনেক খাল-বিল রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ছাড়া পানি এসব খাল-বিল হয়ে বাংলাদেশের ডালিয়ায় আসবে। গজলডোবায় বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে পানি ছাড়া হবে। পানি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, গজলডোবা প্রান্তে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে কি না- সেটাই বড় প্রশ্ন। শুকনো মওসুমে উজানে নদীর বিভিন্ন স্থানে তিস্তার মোট প্রবাহ কত থাকে তা পরিমাপের জন্য বাংলাদেশের পরিদর্শকসহ যৌথ পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের ব্যবস্থা খসড়া চুক্তিতে রাখা হয়নি। বাংলাদেশ থেকে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।ভারত সরকার বিবেচনায় নেয় নি। ভাটিতে গজলডোবায় আসার আগেই উজানে তিস্তার ব্যারাজ-১সহ বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে ভারত পানি সরিয়ে নেয়ার অবারিত সুযোগ পাচ্ছে।’ সিকিমের চুহুল হ্রদ থেকে বয়ে আসা তিস্তা ১৭শ’ কিলোমিটার ভারতীয় এলাকা পেরিয়ে বাংলাদেশের ১২৪ কিলোমিটার এলাকায় প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতে সেচ প্রকল্পভুক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ১১ লাখ হেক্টর। চার বছর আগে সেচ প্রকল্পভুক্ত জমির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ হেক্টর। দ্বিতীয় তিস্তা ব্যারাজ নির্মিত হলে সেচ প্রকল্পভুক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ১৫ লাখ হেক্টর। অন্যদিকে বাংলাদেশে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ মাত্র দেড় লাখ হেক্টর। তিস্তা থেকে পানির অভাবে বাংলাদেশ বগুড়া অঞ্চল পর্যন্ত সেচ প্রকল্প সমপ্রসারণ করতে পারছে না। খসড়া তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় বাংলাদেশ কত কিউসেক পানি পাবে তার নিশ্চয়তা থাকছে না। গজলডোবায় পানির প্রাপ্যতার ভিত্তিতে চুক্তি অনুযায়ী পানির শেয়ার পাবে বাংলাদেশ। ভাটির এ এলাকায় এমনিতেই শুকনো মওসুমে প্রয়োজনীয় পানি থাকে না। গজলডোবা থেকে ছাড়া পানি ভারতীয় প্রায় ১শ’ কিলোমিটার পেরিয়ে বাংলাদেশের ডালিয়ায় যেতে যেতেও পানি অনেক কমে যাবে।
একদিকে মরুভুমি অন্যদিকে প্রকৃতির লীলাঃ
পশ্চিমবঙ্গের গণশক্তি পত্রিকায় লিখিত-গজলডোবায় তিস্তার জলে ঝাঁপাচ্ছে ৫১ প্রজাতির পাখি
(প্রশান্ত সিকদার) মালবাজার, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি — নদীনালা বেষ্টিত ও চারিদিকে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে মোড়া গজলডোবা গ্রামের প্রধান আকর্ষণ তিস্তা ব্যারেজ। তিস্তা নদী ও তার চারিপাশে অসংখ্য ছোটবড় জলাধার। প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক ভারতবর্ষের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে এখানে আসেন আনন্দ নিতে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য ছাড়া এই এলাকার অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী পাখি ও পরিযায়ী পাখি। গজলডোবা এলাকায় আছে ১৫২ রকমের প্রজাতি। শীতের শুরুতে এই পাখিগুলি ভারতবর্ষের অন্য প্রান্ত ছাড়া ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে এই গজলডোবায় আসে। সাধারণত আসে হিমালয়, চীন, মঙ্গোলিয়া, তুন্দ্রা, কোরিয়া, সাইবেরিয়া, তিব্বত, চীন, উত্তর আমেরিকা, লাদাখ ও উত্তর সিকিম এলাকা থেকে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে একমাত্র ফরাক্কা ব্যারেজ বাদ দিয়ে গজলডোবা এলাকায় পাখির উপস্থিতি বেশি। প্রায় ১০ হাজার পাখি এই এলাকায় আছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকরা এই পাখি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসেন।
২রা ফেব্রুয়ারি বনদপ্তর ও স্বেচ্ছাসেবী সংখ্যা (ন্যাফ) যৌথভাবে পাখি গণনা করে ৮ হাজার পাখির সন্ধান পেয়েছেন। এই পাখিরা ৫১টি প্রজাতির।
তথ্য সুত্রঃ গাঁদা গাঁদা।
পাদটীকাঃ
আন্তর্জাতিক নদীর পানি ভাটির দেশের পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রান বৈচিত্র্য, মাটির আর মানুষের আধিকার, কোন জালিম সরকার বা জনগোষ্ঠীর অনুগ্রহ নয়। মহাকালের এটাই শেষ স্টেজ নয়, ভারত! ম্যানকাইন্ড, প্রকৃতি, ইতিহাস ও সময়ের বিধাতা একদিন এই নির্মমতার প্রতিশোধ নিতেও পারেন!