যুগ-যুগ ধরে সরকারি মদদে ইসরায়েলি মিডিয়া ফিলিস্তিনি নেতার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার চালিয়েছে। তাঁর ওপর বর্ষণ করা হয়েছে অযুত পরিমাণ ঘৃণাবাক্য এবং তাঁকে বানানো হয়েছে শয়তান। এ ভাগ্য আরাফাতের সময়ে আর কারুরই হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরও সেই ঘৃণাবর্ষণের অবসান হয়নি। ওপরে বলা ঐ রিপোর্টটি সেই একই বিস্তৃত ও ধারাবাহিক প্রচারণারই অংশ। এর চুম্বক শব্দটি হচ্ছে, ‘এইডস’। অথচ এই দীর্ঘ রচনাটির কোথাও এ অভিযোগের পক্ষে একটিও প্রমাণ নাই। রিপোর্টাররা ‘ইসরায়েলি সিকিউরিটি স্ট্যাবলিশমেন্টের সোর্সদের’ বরাত দিয়েছেন। তারা ইসরায়েলি ডাক্তারদের কথাও তুলে দিয়েছেন, ‘যারা আবার সেটা শুনেছেন ফরাসি ডাক্তারদের কাছ থেকে রোগ নির্ণয়ের কী খাঁটি পদ্ধতি! ইসরায়েলের একজন নামী অধ্যাপক এমনকি শেষকথা বলার মত প্রমাণও পেয়েছেন। হায় পরিহাস! অথচ তারা বলে না যে, এর আগে রামাল্লায় আরাফাতের এইডস টেস্ট করা হয়েছিল এবং তাতে তিনি নিরোগ প্রমাণিত হয়েছিলেন। এই টেস্টটি করেছিলেন তিউনিসিয়ার একদল চিকিৎসক, কিন্তু আরবদের কে বিশ্বাস করবে?
পত্রিকাটি জানে কীভাবে নিজেকে রা করতে হয়ে। রিপোর্টটির কোনো একখানে, তার আকর্ষণীয় শিরোনামের থেকে অনেক দূরে তারা নয়টি শব্দে লিখেছে, ‘তবে আরাফাতের এইডস হওয়ার সম্ভাবনার পে জোরদার প্রমাণ নাই’। অতএব হারিৎজ ভুল করেছে বলা যাবে না। সামরিক বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে বললে, তাদের পশ্চাদ্দেশ সুরতি। এর সঙ্গে তুলনা করা যায়, একইদিনে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একই বিষয়ক প্রতিবেদনটিকে। সেখানে এইডসের কথা বলা হয়েছে; তবে সন্দেহের সাথে।
এটা যে ডাঁহা মিথ্যা তা সরলভাবেই প্রমাণ করা যায়: যদি এর কনামাত্রকেও সত্য বলার অবকাশ থাকতো, তবে ইসরায়েলি সরকারের বিপুল প্রচারযন্ত্র বং বিশ্বময় ছড়ানো ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ মাস অপো না করে আরাফাতের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ছাদে উঠে ঢোল পিটিয়ে তা ঘোষণা করতো। কিন্তু ঘটনা হলো, এর কোনো প্রমাণ নাই। তাছাড়াও রিপোর্টটির লেখকদ্বয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, আরাফাতের লোগলণ কোনোভাবেই এইডসের সঙ্গে মেলে না।
তাহলে কীসে তার মৃত্যু হলো?
রামাল্লায় আরাফাতের জনকলরোলভরা জানাজায় আমি সামিল ছিলাম। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে কিছু বলা থেকে আমাকে বিরত করা হয়। আমি চিকিৎসক নই, তবে একটি অনুসন্ধানী পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে কয়েক যুগের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে: যা আমি আদালতে প্রমাণ করতে পারবো না তা কখনো উচ্চারণ করতে নাই। কিন্তু এখন যখন সমস্ত বাধা সরে গেছে, মনে যা আছে তা বলার জন্য এখন আমি তৈরি: প্রথম মুহূর্ত থেকেই আমি নিশ্চিত ছিলাম, আরাফাতকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
হারিতজ যে সকল চিকিতসকের সাক্ষাতকার নিয়েছে, তাঁরাও যাচাই করে দেখিয়েছেন সকল লক্ষণ বিষপ্রয়োগের সঙ্গেই মেলে, আর কিছুর সাথে নয়। যে ফরাসি চিকিতসকরা মৃত্যুর আগের দু‘সপ্তাহ ধরে তাঁর চিকিতসা করেছেন তাদের দেয়া রিপোর্ট বলছে, মৃত্যুর কারণ তাদের কাছে অনাবিষ্কৃত। সত্যিই, পরীক্ষায় দেহে বিষপ্রয়োগের কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এসকল টেস্ট তো করা হয় সাধারণ বিষের জন্য! আর এটা কে না জানে যে, দুনিয়ার অনেক গোয়েন্দা সংস্থা এমন কিছু বিষ তৈরি করেছে যাকে কখনো সনাক্ত করা যায় না, বা যা কাজ সারার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়।
কয়েক বছর আগে, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা আম্মানের সদর রাস্তায় একটা ছোট্ট খোঁচা দিয়ে হামাস প্রধান খালেদ মিশালের শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। বাদশাহ হুসেন ততক্ষণাত ইসরায়েলের কাছে এর প্রতিষেধক দাবি করেছিলেন এবং তাঁর চাপে সেটা দেয়া হয় বলে সে যাত্রায় মিশাল বেঁচে যান। (আবার আগাম দায়মুক্তি হিসাবে, ইসরায়েলের ততকালীন প্রধানমন্ত্রি বেনিয়ামিন নেতিনেয়াহু হামাসের আরেক প্রধান শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে মুক্তি দেয়। কিন্তু বছর কয়েক আগে গাজায় ফিরে আসার পর তাঁকেও হত্যা করা হয়। এটা করা হয় কোনো গোপন পথে নয়, অনেক সোজাসাপ্টা পথে মিসাইল মেরে।)
যখন পরিচিত কোনো রোগলণ অনুপস্থিত এবং বিষপ্রয়োগের পরিষ্কার চিহ্ন বর্তমান, তখন এটাই হওয়া সম্ভব যে, বিষের প্রতিক্রিয়া শুরুর ৪ ঘন্টা আগে ডিনারের সময়ই আরাফাতের শরীরে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।
আরাফাতের চারপাশে নিরাপত্তার এন্তোজাম যে খুবই শিথিল ছিল তা আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। বিভিন্ন দেশে যখন ডজনেরও বেশি বার তাঁর সাথে মিলিত হয়েছি, তখন আমি দেখে খুবই অবাক হয়েছি যে, কত সহজেই না আততায়ীরা তাঁকে হত্যা করতে পারে! যেভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রিকে পাহারা দেয়া হয় তার সাথে তুলনায় আরাফাতের নিরাপত্তা খুবই সাধারণ মানের। তিনি প্রায়শই বাইরের লোকের সাথে খেতে বসতেন, দেখা করতে আসা যে কারো সঙ্গেই কোলাকুলি করতেন। তাঁর সঙ্গিরা জানিয়েছে, তিনি যখন তখন বাইরের লোকের দেয়া মিষ্টি খেতেন, এমনকি তাদের দেয়া ওষুধ নিতেন তো বটেই এবং তাদের সামনেই তা খেয়ে ফেলতেন। ডজনখানেক হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া এবং একটি প্লেন দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়ায় তাঁর মধ্যে নিয়তিবাদী মনোভাব তৈরি হয়েছিল যে, ‘সবই আল্লাহ্রর হাতে’। আমার মনে হয়, তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে এমন এক বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই আরাধ্য কাজ সমাধা হওয়া পর্যন্ত তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবেন।
যদি তিনি বিষেরই শিকার হয়ে থাকেন_ তবে কার দ্বারা?
প্রথমেই সন্দেহ যাবে ইসরায়েলি সামরিক সংগঠনের দিকে। অবশ্যই, এ্যারিয়েল শ্যারন বিভিন্ন সময়ে অনেকবার আরাফাতকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি মন্ত্রীপরিষদের সভাতেও উঠেছিল। গত কয়েক বছরে একাধিককবার আমি এবং আমার বন্ধুদের মনে হয়েছে, এটা ঘটতে যাচ্ছে। তাই আমরা রামাল্লার মুকাতায় হাজির হয়েছিলাম আরাফাতের মানববর্ম’ হতে। এক সাক্ষাতকারে শ্যারন বলেছেন, আমাদের উপস্থিতির কারণেই সেবার তিনি পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সত্য হলো, শ্যারন তখন নিরস্ত হয়েছিলেন প্রধানত আমেরিকানদের বাধার কারণে। তারা ভয় পাচ্ছিল যে, আরাফাত খুন হলে গোটা আরবে ব্যাপক ঝড় বয়ে যাবে এবং মার্কিন বিরোধী প্রতেরোধ অনেকগুণ বাড়বে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দারা কোনো চিহ্ন না রেখেই লোকজনকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে সক্ষম, মিশালের ঘটনা তারই প্রমাণ। ঘাতকরা হাতেনাতে ধরা পড়েছিল বলে বিষপ্রয়োগের ব্যাপারটা তখন জানা গিয়েছিল।
যাই হোক সম্ভাবনা সম্ভাবনাই, প্রমাণ নয়। ইসরায়েলিরাই আরাফাতকে বিষ দিয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত করা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। কিন্তু যদি তারা না হয় তবে কারা? মার্কিন গোয়েন্দারাও এ কাজের উপযুক্ত। প্রেসিডেন্ট বুশ কখনোই আরাফাতের প্রতি তার ঘৃণা গোপন করেননি, আবার আরাফাতও তার নির্দেশ মোতাবেক চলতে রাজি ছিলেন না। তার বদলে মাহমুদ আব্বাসকে বরণ করায় বুশের আগ্রহ ছিল। এমনকি এখনও মার্কিন প্রতিনিধিরা মুকাতায় এলে এর প্রাঙ্গনে আরাফাতের কবরে শ্রদ্ধানিবেদন থেকে দৃষ্টিকটুভাবেই বিরত থাকে।
তবে আমেরিকানদের সন্দেহ করার মত প্রমাণও আমাদের হাতে নাই। তাহলে ভাবা যেতে পারে অন্য কারো কথা, এমনকি ঘাতকরা আরবদের মধ্যে থেকেও আসতে পারে।
আরাফাতের মৃত্যু কি শ্যারনকে লাভবান করেছে?
প্রাথমিকভাবে না। যতদিন আরাফাত বেঁচে ছিলেন, ততদিন ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন ছিল সীমাহীন। কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট বুশ তার উত্তরসূরীর প্রতি মুখ ফেরালেন। ইরাকে শোচনীয় ব্যর্থতার পর বুশ বাধ্য হয়ে ‘বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের’ অন্য কোথাও দেখাবার মত সাফল্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাই আরব ও মুসলিম বিশ্বের ওপর দিয়ে নয়া মার্কিন হাওয়ার প্রতীক হিসাবে তিনি মাহমুদ আব্বাসকে হাজির করেছেন। আবার যাতে আব্বাসের ওপর ফিলিস্তিনিরা আস্থা আনে, তার জন্য শ্যারনকেও নমনীয় হতে নতুন ধরনের চাপ দিচ্ছেন। সম্ভবত শ্যারন মনে মনে অতীতের সেই সুসময়ের আশা করেন, যখন জীবন ছিল সোজা এবং শত্রুও ছিল চেনা।
কিন্তু যে ব্যাক্তির ধ্যানজ্ঞান হলো, ফিলিস্টিøনী জনগণের ঐক্যকে টুকরা টুকরা করা এবং যে কোনো মহƒল্যে একটি কার্যকর ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকানো, সে ঐকান্তিকভাবেই চাইবে আরাফাতের অবসান। যে আরাফাত সমগ্র ফিলিস্তিনী জনগণকে একতাবদ্ধ করেছেন। তারই আছে জনগণকে আদেশ করার অধিকার, এবং তিনি এটা করেন জোর ও সহৃদয়তার সঙ্গে, মানবিক প্রজ্ঞা কৌশলের সঙ্গে।
ইসরায়েলে এমন অনেক লোক আছে যারা আশা করেছিল যে, আরাফাতকে ছাড়া ফিলিস্তিনি মাজ ভেঙ্গে পড়বে, ব্যাপক নৈরাজ্যের কারণে এর ভিত্তি টলে যাবে এবং সশস্ত গোষ্ঠীগুলো একে অন্যকে এবং তাদের জাতীয় নেতৃত্বকে হত্যা করবে। আরাফাতের মৃত্যুতে যারপরনাই খুশি হয়ে এখন তারা প্রার্থণা করছে যাতে মাহমুদ আব্বাস ব্যর্থ হন।
একবার আরাফাত আমাকে নিশ্চিত করে বলেছিলেন যে, আমরা উভয়ে আমাদের জীবিতকালেই শান্তির দেখা পাব। কিন্তু তাকে সেই দিনটির কাছে যাবার আগেই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। যে এটা করেছে,সে যেই হোক সে শুধু ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধেই পাপ করেনি, সে পাপ করেছে শান্তির বিরুদ্ধে, এবং সেকারণে ইসরায়েলেরও বিরুদ্ধে।
লেখক: ভিন্নমতাবলম্বী পত্রিকা গুশ সালোমের সম্পাদক, সাবেক সাংসদ এবং ফিলিস্তিনীদের পক্ষের আন্দোলনের নেতা।