বিমান বন্দর চত্বরে লালন ভাস্কর্য ভাঙ্গায় কিছু একটা প্রমাণ হয়। কিন্তু তা কীসের আলামত তা নিয়ে চটজলদি মতামতের বাজারে হাজির হলেও, ভাববার প্রয়োজন ফুরায়নি। ভাবনার সুতাটা এলোমেলো ঘুরছে। আপাতত হাতের কাছে ভাস্কর্য নিয়ে টানাটানি করতে থাকা খতমে নব্যুয়তের কর্মীদের ছবিটাকে নেয়া যাক।
ঐ ছবি প্রমাণ করে যে, ভাস্কর্যটি ভেঙ্গেছে একটি ধর্মবাদী উগ্র সংগঠন। এদেরকে আমরা বিভিন্ন সময় জনগণের গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং বাস্তব স্বার্থের বিপে কাজ করতে দেখেছি। এই দফায় তাদের হোতা হিসেবে নাজিল হয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি আমিনী। সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার, একটি ‘মৌলবাদী’ শক্তিই এই শিল্প-নাশকতার হোতা। কিন্তু ঘটনাটা যখন প্রধানত রাজনৈতিক, এবং আমাদের রাজনীতি যখন শুভঙ্করের গণিতের খেলা তখন সরলাঙ্কের হিসেবে জটিলতার হদিস মিলবে না। সম্ভবত বিএনপি-জামাতের সঙ্গে সরকারের একটা সমেঝাতা হয়ে গেলেই এবং মুজাহিদ জামিন বা দায়মুক্ত হলেই আমিনী ও খতমে গংদের আষ্ফালন থেমে যাবে।
যারা ভাস্কর্য ভাঙ্গায় হাত লাগিয়েছে এবং যারা এর সমর্থনে আওয়াজ তুলছেন, তারা বড়জোর কারিগর ও প্রচারক। কিন্তু নকশাটি কার গায়ের জোরের মতার উৎসটি কোথায়, তার বিচারই আজ প্রধান। যখন নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, যখন চোখে ঠুলি পরা পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে দুর্নীতি মামলার ফেরারি আসামি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করছেন, আদালতে যাচ্ছেন আসছেন, সভাসমিতি করছেন; কেন ঠিক তখনই খতমে নব্যুয়তের ঈমানি জোশ জাগলো এবং তাতে হাওয়ার ওপর তাওয়া গরম করে কার জন্য পিঠা ভাজা হচ্ছে, সেইসব প্রশ্নের জবাব জানা ফরজ বৈকি! সেই কাজ গোয়েন্দার নয়,
কাজটা রাজনৈতিক এবং রাজনীতি নিয়ে আগ্রহীদেরই তা করা উচিত।
ভাস্কর্যটি তৈরির পরিকল্পনা করা এবং সে মোতাবেক মাটি থেকে আপাদমস্তক ভাস্কর্যটি দাঁড়াতে লম্বা সময় লেগেছে। এত বিরাট সময় জুড়ে এ নিয়ে যে কারো কোনো আপত্তি আছে তা দেশবাসী জানতে পাননি। জানা গেল দেশের ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর সন্ধিণে। সুতরাং এটা যতটা না ধর্মীয় প্রশ্ন তার থেকে বেশি রাজনৈতিক বিষয়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারি হুকুমবলে তড়িঘড়ি করে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়ার মধ্যে। খতমে নব্যুয়ত এর আগে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাস্তাঘাট গরম করে তুলেও কিছু করতে পারেনি সরকারি বাধার জন্য। এবং এটাই সত্য যে, সরকার না চাইলে এবং জনগণের বিরাট অংশ নিজের গরজে রাস্তায় না নামলে এই কাজ করবার শক্তি কারো থাকবার কথা নয়। এই বেলা তাদের আপাত সাফল্যে তাহলে সরকারের কোনো অংশের লাভ রয়েছে কি? তাই তারা এটা হতে দিয়েছে!
[এই ঘটনায় 'জেহাদিরা' ইঙ্গিত পেল যে, সরকার সিভিল সোসাইটির বদলে ইসলামওয়ালাদেরই এখন তার রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে পেতে চায়। একে কেউ পঞ্চম বাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রবদলও ভাবতে পারেন। কিন্তু মূলগতভাবে আমি একে জরুরি অবস্থা প্রলম্বিত করা এবং নির্বাচন ভণ্ডুলের মওকা হিসেবেই ব্যবহৃত হতে দেখছি। ]
এ জন্য কথাটা বলছি যে, ১/১১ এর পর এ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে যারা জরুরি আইন ভঙ্গ করে নানান ইস্যুতে গোলোযোগ সৃষ্টি করেছে, সহিংসতার পরিবেশ তাতিয়েছে, তারাই আমাদের পরিচিত ‘ইসলামপন্থি’ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। তাদের নামের সঙ্গে ‘ইসলামপন্থি’ তকমাটি তাঁরা লাগান বটে, কিন্তু এজন্যই তাঁদের যেকোনো কর্মকাণ্ডই যে ইসলামসম্মত, তা বলার কোনো ভিত্তি নেই। আর যখন তাঁরা সেটা করেন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ব্যানারে তখন তাদের আর দশটা রাজনৈতিক দলের চাইতে উঁচু আসন দেয়ারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে বা অন্য কারো স্বার্থের পুতুল হয়ে তাদের উত্তেজনা সৃষ্টির খেলাকে ‘ইসলামী’ বললে এদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের বিশ্বাসেরই অবমাননা হয়। সেই বিচার একদিন জনগণ করবেন। এবং জনগণ জেনে রাখবেন যে, সরকারের ভেতরের কোনো একটি মহল পাকিস্তানী কায়দায় দেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টকে তাদের মতার খেলার পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। উগ্রবাদী এই দৈত্যের প্রাণভোমরা তাই তার দেহে নাই, তা রতি আছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কোনো অপশক্তির হাতের কৌটায়। তারা সুতা ছাড়লে এরা নড়ে, নতুবা গর্তবাসী থাকে। উভয়ের সম্পর্কটি দেয়া ও নেয়ার। এরা প্রচণ্ড মতাবান অপশক্তির নীলনকশা বাস্তবায়নের ঘুঁটি ও খুঁটি হিসেবে কাজ করবে। বিনিময়ে পাবে ক্ষমতার হিস্যা এবং যা খুশি তা করার ছাড়পত্র। এরা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরাপদ কোটরে বসা সেই অপশক্তিরই পঞ্চম বাহিনী। একসময় ৭৫-এর খুনী ফারুক-রশীদ গং ছিল এই ভূমিকায়, আজ দাঁড়াচ্ছে কতিপয় মোল্লা ও তাদের অনুসারীরা। দেশের অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ যে তাদের সঙ্গে আছেন এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। এরা দেশেরও শত্রু ধর্মের ভেতরে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী। এবং ইসলামে হত্যার চাইতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি বেশি ক্ষতিকর বলে গণ্য হয়।
ইসলাম তার আদিযুগে নারীদের অবমাননা ও দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছে, এরা চাইছে আবার তাদের আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে, অর্থাৎ পুরুষের ভোগের সামগ্রী করে তুলতে। নারীর বিরুদ্ধে তারা যত সোচ্চার, পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার কনামাত্রও নয়। ইসলাম আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা তথা খ্রিস্টিয় চার্চের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানকে মুসলমানদের মধ্যে নিষিদ্ধ করেছে, অথচ এরা হয়ে উঠতে চাইছে পোপের মতো মতাবান। সেই পোপ যার কথা আল্লাহ শুনবেন, শাসক মানবেন এবং জনগণ থাকবে বাধ্য। ইসলাম মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিপে দাঁড়ায়, আর আমাদের এঁরা সমাজকে ভাগ করছে এবং নিজেরাই যে কত ফেরকায় বিভক্ত তার কোনো শুমার নাই। এ বিষয়ে পাকিস্তানী চিন্তাবিদ একবাল আহমদের একটি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করতে চাই। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই তাঁকে এক সাক্ষাতকারে বলেন, বিজেপি ভারতে হিন্দুধর্মের মধ্যে ইসলামী উপাদান প্রবেশ করাচ্ছে। দেশাই মনে করেন, হিন্দু ধর্মে একেশ্বরবাদ না থাকলেও বিজেপি অন্য সব দেবতার চেয়ে রামকে কেন্দ্র করে একেশ্বরবাদ কায়েম করতে চাইছে। হিন্দু ফ্যাসিবাদী বিজেপি যা করছে, আরেক অর্থে সেই কাজ করছে আমাদের এই স্বঘোষিত ‘ইসলামপন্থিরা’।
ব্রিটিশ আমলে জমিদারের বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলনকে তছনছ করে সেখানে পাকিস্তানের দাবি ঢোকায়। তারা ইসলামের নামে ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার অধিকারকে খর্ব করার কোশেশ করে। চূড়ান্তভাবে তারা একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের দোসর হয়ে বাংলার মাটিতে নৃশংস গণহত্যা ও গণধর্ষণের উৎসব বসায়। সুতরাং তারা যে বারবার নিপীড়িতের হক কেড়ে নেবে, জনগণের চিত্তের বিকাশে আমাদের যে পির্তৃপুরুষ ও মার্তৃনারীরা সংগ্রাম করে গেছেন সেই লালন ও রোকেয়াদের নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চাইবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নয়। আচানক তারা এই কাজে নামেনি। এটাই তাদের সিলসিলা। অথচ এই বাংলায় ইসলাম এসেছিল নিপীড়িতের বঞ্চনার প্রতিবাদ হিসেবে। তরবারি দিয়ে নয় অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে বাংলায় কৃষি সমাজের ভিত রচনা করে ইসলাম জনপ্রিয় হয়েছিল। সুফি-দরবেশ থেকে শুরু করে সেই আদি যুগের মুসলিম সুলতানদের সময়টাই ছিল বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। যে নদিয়ায় শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল সেটা কিন্তু সুলতানদের রাজ্যভুক্ত ছিল। কই মুসলিম রাজশক্তি তো কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি। তাঁদের গুণেই মতাশালী ব্রাক্ষ্মণ্য দাপটের এপারে কৃষক সমাজের এক দেশ গড়ে উঠেছিল। সেই দেশ আজ স্বাধীন। লালন হলেন সেই কৃষকদেরই বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক গুরু। নিজ জীবদ্দশায় তিনি যেমন জাত-পাত, শ্রেণী-বর্ণের বিরোধিতায় কাজ করেছেন, তেমনি লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছেন জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সেই লুঙ্গি পরা শুশ্রুমণ্ডিত লালন আজো কৃষকর-কারিগরদেরই প্রতিনিধি_ উচ্চবর্গের দরবারে। সে যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরোহিত ও কাঠমোল্লারা যেমন তাঁর ধারাকে মুছে দিতে চেয়েছিল, আজকের এনারাও সেই কাজে নেমেছেন। দিনের পর দিন ধরে এটা হয়ে আসছে।
সরকারি উদ্যোগে আজ লালনের সমাধি ঘিরে বিশাল মেলা বসে। মন্ত্রী-এমপি প্রভৃতিরা অঢেল জাঁকজমকের সঙ্গে তা উদ্বোধন করেন। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনীতে যেমন দশচক্রে ভগবান ভুত হন, তেমনি পর্যটন বাণিজ্য আর সরকারি দাপটের চক্রে লালনের সাধুসঙ্গ এখন অ-সাধুদের খপ্পরে জারবার। লালনের সমাধি ও আখড়ার দায়িত্ব থেকে ভক্তদের তাড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে লালন একাডেমি। তাতে লালনের ধারার কোনো অনুসারি যেমন নাই তেমনি লালনের আদর্শ বা চর্চার সঙ্গেও তার সম্পর্ক অতি নাজুক। এমনকি লালনের শিষ্যদের হাতে রোপিত শতবর্ষবয়সী মহীরূহও আমলাদের নির্দেশে কাটা পড়েছে। এবং আহাম্মকি এই যে, সেখানে বিদেশী বৃও রোপিত হয়েছে! এইভাবে বাণিজ্যিক পর্যটনকেন্দ্র গড়বার পুঁজিবাদী ভোগবাদী খায়েশে সাধকদের তীর্থস্থানের যে বিনষ্টি ঘটেছে, কতিপয় ‘উগ্রবাদীদের’ উস্কানিতে সরকারি নির্দেশে লালনের ভাস্কর্য নিয়ে কুৎসিত নাটক সেই অনুযায়ীই ঘটছে। এই কাজে আধুনিক শিতি লোকজন (যার মধ্যে সিভিল এভিয়েশনের উচ্চশিতি চেয়ারম্যানও রয়েছেন, তিনিও ভাস্কর্যবিরোধীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বলছেন, ‘কেবল ওরাই মুসলমান নয়, আমরাও মুসলমান’, সমকাল ১৮ অক্টোবর)
এবং এঁদের হৃদয় এতই শুষ্ক যে, ঐতিহ্যের কথা বললে এদের মনে পড়ে তা নিয়ে ব্যবসার কথা। আর ইসলামের ইতিহাসের কথা বললে তিন মহাদেশ জুড়ে দেড় হাজার বছর ধরে অজস্র জাতির মধ্যে বিরাজ করা সমৃদ্ধ মুসলিম শিল্প-সংষ্কৃতি-দর্শনের কথা মনে পড়ে না, মনে পড়ে কেবল তরবারির কথা। আর তাদের সেই তরবারির নিশানায় বারবার পড়ে তারাই, যারা মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। এদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা শিক্ষায় সেই গৌরবের ইতিহাস ও সেই চেতনার দীক্ষা কমই লক্ষ্য করা যায়। কেননা, মাদ্রাসা পড়ুয়া গরিব ঘরের কৃষক সন্তানেরা যদি তা জানতে পারে, তাহলে এইসব ‘নব্য-পোপদের’ জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তাই মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে আধুনিক জ্ঞান ও চিন্তা আনায় তাঁরা ভীত। মাদ্রাসার সচেতন তরুণ-তরুণীরা যদি নৈতিক ও জাগতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের খপ্পর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে!
লালনের ভাস্কর্য ধ্বংসে যেভাবে তারা হাত লাগিয়েছে, তারা আবার একাত্তরের ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এভাবে বারবার তারা সেই ইসলামের ভাবমূর্তির তি করে, যে ইসলাম সর্বদা জনগণের মুনের মুকুরে ঠাঁই করে নিয়েছে। সব ধর্মের মধ্যেই দেখা যায়, কিছু লোক ধর্মকে পুঁজি করে নিজেদের বিত্ত-বাসনা ও ক্ষমতার ক্ষুধা মেটাতে বলি করছে নিজ ধর্মের লোককেই। এদের সহযোগিতা করে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ি এবং ফৌজি লোকজন। ভারতে যেমন বিজেপি’র উদীয়মান ফ্যাসিবাদকে মদদ যোগাচ্ছে সেদেশের কর্পোরেট পুঁজিপতিরা। বাংলাদেশেও তেমন মদদের আলামত স্পষ্ট। খতমে নব্যুয়তের নেতা জানিয়েছেন, কোনো একজন ‘সব অর্থ দিচ্ছেন; কিন্তু তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি নন’ (সমকাল, ১৮ অক্টোবর)।
এইভাবে নতুন পাওয়া অর্থের জোরে তারা আজ ধরাকে সরা মনে করছে। এজন্য ধর্মকেও তারা সুবিধা মতো বদলে নিচ্ছে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নাই, পাকিস্তানের পারভেজ মোশাররফ আর বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদ যতই ‘ইসলাম ইসলাম’ বলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, ততই দেশের মানুষের জীবন ও ধর্ম দুটোরই সর্বনাশ করেছেন। এদের অপকর্মকে পুণ্য বলে ফতোয়া দিয়েছেন অনেক ‘আলেম’! এই দুই ধারার লোকদের কার্যকলাপের জন্যই পশ্চিমা দেশে আজ একদল ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারক দাঁড়িয়ে গেছেন, যারা প্রমাণ করতে চাই ইসলাম ‘সন্ত্রাসী ধর্ম’ বা ইত্যাদি। দেখা যায়, এই সাম্প্রদায়িক ইসলাম বিদ্বেষীরা আর আমাদের সাম্প্রদায়িক ও গণবিদ্বেষী ধর্মীয় এজেন্সিধারীরা একে অন্যকে দিয়ে করে-কর্মে খাচ্ছে। একদলের ‘ওয়ার অন টেরর’ আরেক দলের ‘জেহাদি জোশ’ আখেরে সব ধর্মের সাধারণ মানুষকেই শেষ পর্যন্ত পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ায় একমত। কায়া ও ছায়ার মতোই তারা অবিচ্ছেদ্য।
তাই কায়ারূপ সরকারের ভেতরের একটি অংশ এবং তাদের ছায়ারূপ ধর্মের লেবাসে থাকা গডফাদারদের কাণ্ডকারখানাকে সরল চোখে দেখার কোনো সুযোগ নাই।
বাংলাদেশ এখন জরুরি অবস্থার পুলসিরাত পার হয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এগতে চায়। সবাই স্বীকার করবেন যে, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া সেই পুলসিরাতের সরু সাঁকো পার হবার আর কোনো উপায় নাই। সেরকম একটি জটিল সময়ে হুঁশিয়ার থাকা দরকার যাতে কোনোভাবেই আমরা ভুল কাজিয়া বা ভুল উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে সেই সাঁকো ভেঙ্গে না ফেলি বা মাঝপথেই কারো ধাক্কায় অতল খাদে পড়ে না যাই। তবে একইসঙ্গে এই ঘটনার বৈশ্বিক ও দীর্ঘমেয়াদী তাৎপর্যটির বিষয়েও সজাগ থাকা চাই। বিশ্বব্যাপী ‘বুশ এন্ড গং’ যাকে-তাকে সন্ত্রাসী বলে চড়াও হতে মুখিয়ে আছে। বাংলাদেশেও তারা সক্রিয়। লালনের ভাস্কর্য ভাঙ্গার দৃশ্য প্রচার করে তারা প্রমাণ করতে চাইবে, বাংলাদেশ তালেবানদের হাতে যেতে মাত্র কয়েক কদম বাকি। তারা এও বোঝাবে যে, এদের জন্যই জরুরি অবস্থা বা ১/১১ জাতীয় ঘটনা ‘চিরস্থায়ি’ হওয়া দরকার। আফগানিস্তানে বামিয়ানের বুদ্ধ ধ্বংস কিংবা বাংলাদেশে এ জাতীয় কার্যকলাপ তাদের জন্য বিরাট উসিলা। আগে জেএমবি সেই উসিলা যুগিয়েছে, এখন কারা সেই কাজ করছে, বাঁচতে হলে জনগণকে তাদের চিনে নিতে হবে। শিকারি যেমন পাখির পুরো দেহ নয়, কেবল তার মাথাটাকে নিশানা করে, আমাদের এখন তেমনই প্রখর চক্ষু চাই।