আরব প্রতিরোধ সংগ্রাম নিয়ে আমার আগের পোস্টের মন্তব্যে অপবাক যে দীর্ঘ মন্তব্য করেছেন তার জবাব মন্তব্যের খোপে রাখা গেল না বলে এই পোস্ট।
অপ বাক বলেছেন: আরব গেরিলা আর ইসরাইলের লড়াই- শব্দ দুটোর ভেতরে একটা ধর্মীয় চেতনা বিদ্যমান। আরব গেরিলা শব্দ দিয়ে যে অর্থ প্রকাশিত হয় সেটা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের মুসলিম সংবেদনশীলতার অংশ- (এটা নিশ্চিত ভাবে আমার মতামত)
কীভাবে? শব্দ দিয়ে অর্থই প্রকাশিত হয় অনর্থ নয়। অনর্থ করাটা আমাদের কারো কারো অভ্যাস। যেমন আপনার এবং আপনার প্রতিপক্ষ ইসলামওয়ালাদের। তারা আরব জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের অর্থ করে ‘ইসলামী জেহাদ’। আপনিও দেখছেন তা-ই। ধর্মনিরপেতার মুখোশ পরা ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা আর কাঠমোল্লাদের ধর্মব্যাখ্যা এই জায়গায় একত্রে বিশ্বকে ধর্মীয়ভাবে ভাগ করছে। তবে এ কাজে ইসলামওয়ালারা প্রতিক্রিয়া আপনি যাদের হয়ে ওয়াজ করে যান সেই পশ্চিমা প্রভুরা করেন ক্রিয়া। ক্রিয়া না বুঝলে প্রতিক্রিয়া বুঝবেন কীভাবে? বাংলাদেশে সংবাদপত্র আমার মনে হয় না মুসলিম সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে। এদের বেশিরভাগই সিএনএনের বুলিই কপচায়- তবে কৌশলে। যে দেশে মুসলমান এবং বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেদেশের সংবাদপত্র এ দুই বিষয়ে যৌক্তিকমাত্রায় সংবেদশীলতা না দেখিয়ে কি আমেরিকান সাম্প্রদায়িকতার প্রতি সংবেদশীলতা দেখাবে?
লেবাননের মানুষ হেজবুল্লাহর আগ্রাসনের যন্ত্রনা সহ্য করছে এবং করেছে অনেক দিন ধরেই-
ভাই কি লেবাননে গিয়েছিলেন? নাকি কল্পনার মোয়া খেয়েছেন? ইসরায়েল আপনার কপালের তিলক হয়ে ফুটে আছে যে! তাই ইসরায়েলের আগ্রাসন আপনার চোখে লাগে না, হিজবুল্লাহর প্রতিরোধকে মনে হয় আগ্রাসন। কলিকাল, কাউয়ার ডাক নাকি এখন কোকিলের থেকে মধূর। লেবাননে হিজবুল্লাহ এতই জনপ্রিয় যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বানিয়ে বিরজা করলেও মার্কিন-ইসরায়েলের দালাল সরকার তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। সম্মিলিত আরব বাহিনী ইসরায়েলকে একবারও প্রতিহত করতে পারেনি, ওরা পেরেছে। হিজবুল্লাহ যে পরিমাণ ভোট পায় সেটা কিন্তু সেখানকার শিয়া ভোটের থেকেও বেশি। তার অর্থ লেবানিজ খ্রিস্টান ও সুন্নিরাও তাদের সমর্থন করে। লেবাননের সেনাবাহিনীও তাদের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরতে নারাজ। বুশ যা বলে নাই, আপনি দেখি তা-ই বলছেন। আপনার মতি হোক।
তারা হঠাৎ করেই ইসরাইলের উপরে মিসাইল হামলা করলো কেনো? অনেকগুলো কারণ দেখলাম, তবে কোথাও দেখলাম না ইসরাইল লেবানন দখল করবার সংগ্রাম করছিলো-
দেশ দখলকে আমরা আগ্রাসন বলেই জানি, আপনি বলছেন সংগ্রাম। ইসরায়েলি আগ্রাসন বললে পাপ হয় নাকি? আপনি দেখি অতি বড় ধার্মিক! ইসরায়েলের আÍরা নীতিই হলো প্রতিবেশীদের সন্ত্রস্ত করে রাখা। কারণ ইসরায়েলের সাইকির মধ্যেই একটা বিকৃতি ঢুকে পড়েছে হলোকস্টের পর। যে বিভীষিকা ইহুদিদের সহ্য করতে হয়েছিল তা তাদের মনে নিরন্তর ধ্বংস ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। আতঙ্কিত লোকই উš§ত্তের মতো আচরণ করে। সেকারণে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে নিরন্তর আক্রমণ, ষড়যন্ত্র, অনুপ্রবেশ তার নিয়মিত কর্ম। লেবানন ও ফিলিস্তিনে তাদের অভিযান সবসময়ই প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে চলেছে। লেবানন আক্রমণের আগে কয়েকজন শীর্ষ হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাকে তারা হত্যা করেছিল। ইরান আক্রমণের প্রস্তুতি হিসাবে হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। যেসময় হিজবুল্লাহ তাদের দেশে ঢুকে পড় একজন ইসরাইলি সৈন্যকে আটক করে, তার আগে ইসরাইলি সৈন্যরা বেশ ক’জন লেবানিজকে ভেতরে ঢুকে ধরে নিয়ে যায়। সেসময় গাজায় পাখির মতো মানুষ মারছিল জায়নিস্টরা। আপনার জানা থকবার কথা বিতাড়িত ফিলিস্তিনীদের বিরাট একটা অংশ লেবাননে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের জন্যও হিজবুল্লাহর দায়িত্ব ছিল গাজার ওপর চাপ কমিয়ে আনা। তাই আগে অনেক প্ররোচনায় সাড়া না দিলেও এবারে সঠিকভাবেই তারা ইসরায়েলকে যুদ্ধে টেনে এনে একদিকে গাজাবাসীর ওপর চাপ কমিয়ে এনেছে অন্যদিকে ইসরায়েলের দম্ভ খর্ব করে দিয়েছে। এর জন্য তারা যে কোনো সুস্থ্য পাবার দাবিদার।
তবে হামাস কিংবা ফাত্তাহ কোনো দলই কি প্যালস্টোইন জনগণরে কথা ভাবে না
হামাসকে গালি দেবেন বলে ফাতহকেও গালি দিয়ে নিলেন? হামাস যে তা ভাবে অন্তত আচরণে তা করে তার প্রমাণ নির্বাচনে তার জনপ্রিয়তা। তার প্রমাণ এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া। অন্যদিকে ফাতহ নেতারা ব্যস্ত ভোগবিলাসে এবং জনগণের অর্থ আত্মসাতে। তারা ফিলিস্তিনী রাজাকার।
হামাস সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছিলো, সেটার স্থায়িত্ব ছিলো যে কয় দিন সেখানে শান্তির আলোচনার সূচনাটা হলো না।
হামাস পরাশক্তির বিরোধিতা অভ্যন্তরীন বিশ্বাসঘাতকাতার মধ্যেও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। সরকারে গিয়ে তারা একতরফা ভাবে যুদ্ধবিরতিও ঘোষণা করেছিল। তাদের মূল প্রতিজ্ঞা ইসরায়েলকে স্বীকার না করা, সেখান থেকেও তারা সরে আসার লক্ষণ প্রকাশ করেছিল। তারা পরাজিত ফাতাহকে সরকারের অংশীদার করেছিল এবং দিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। পরের ইতিহাস সবাই জানে।
এখানে ইসরাইলের ট্যাঙ্কের গোলায় নিরপরাধ শিশু নিহত হলে ইসরাইলে নিহত হয় আরও কয়েকজন নিরপরাধ মানুষ-
নিরপরাধ মানুষের স্বীকৃত অপরাধ তার নাগরিকত্ব।
এত মানুষ মানুষ কইরেন না তো? ফিলিস্তিনী মানুষ হচ্ছে জগতের সবথেকে লাঞ্ছিত-ভাগ্যহত মানুষ। আর ইসরায়েলের মানুষ হচ্ছে অন্যের জমিতে, অন্যের অধিকার দলন করে ভোগ-বিলাসের সুখী জীবন যাপন করা দাপুটে মানুষ। তাদের সমর্থনেই ইসরায়েল বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। এই ভেদ মনে না রাখা অন্যায়। আমি আÍঘাতী হামলার পওে না বিপওে না। এটা নিয়ে কথা বলার ঔদ্ধত্য আমার নাই। যে নিজের জীবন জাতির মুক্তির জন্য সজ্ঞানে বিসর্জন দেয় এবং শতে শতে দেয় তাদের আমার অচেনা মনে হয়। ওই সাহস বা সংকল্প আমার নাই। আর আÍঘাতী হামলা কিন্তু প্রতিক্রিয়া, কারণ যে জাতিকে পরস্পরের কাছ থেকে, নিজেদের সম্পদের কাছ থেকে এমনকি নিজেদের সরকারের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন করে পশুর জীবনে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তাদের সমালোচনার নৈতিক জোর আমার নাই। আপনার থাকতে পারে, কারণ আগুনের মধ্যে বসিয়া, পুঁজির মূত্রস্রোতে ফোটা মানবতার অলীক ফুলের সুবাস আপনি পেতে পারেন, ব্যথা-অপমানে জর্জর স্বাধীন মানুষ তা পারে না। আÍঘাতী হামলা ফিলিস্তিনের গণসংগ্রাম, গেরিলা যুদ্ধ এবং সার্বিক অসহযোগের সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াইয়ের অঙ্গীভূত। একে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ফুল বাদ দিয়ে পাপড়ির নিয়ে মাতার মতো অপদার্থতা। ফিলিস্তিনের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা কে ধ্বংস করলো এটা আমার আপনার কাছে জানবার ইচ্ছা রইল। আর প্রতিরোধ বাজারি বিনিয়োগ নয় যে, লাভের সম্ভাবনা কম বলে প্রতিবাদ করবো না? পুঁজিবাদ আপনাকে ভালই যুক্তি শিখিয়েছে। প্রতিবাদের মধ্যেই ফিলিস্তিনীরা আজো জাতি হিসাবে টিকে আছে, সাম্রাজ্যবাদী শাহানশাহদের শান্তি নষ্ট করছে। সকল মুক্তিকামী সংগ্রামই আসলে অসম্ভবের সংগ্রাম। কিন্তু অসম্ভব সংকল্প ও ত্যাগের বিনিময়ে তা একসময় জয়ী হয়। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটুন, চোখের আড়ে পাহাড় লুকানোর কসরত আর কত?
আপনাদের মতো লোকেরা লড়াই করে না, কিন্তু তার ফল ভোগ করে, মজমা বসায় জয়ী পরে আসরে। জাতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানবতার বিরাট অংশের বাইরে এক ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বাস করে জীবনের অবৈধ সুধা ভোগ করে ইতিহাসের গতিসূত্র বোঝা আপনাদের কম্ম নয়। এ কথা বলছি বলে মাফ করবেন, খেয়ে না খেয়ে ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানোও কিন্তু একধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণার রাজনীতি। আপনি না জেনেছেন ধর্ম না বুঝেছেন ইতিহাস। আপনার আরো লেখা দেখেছি, যেখানে ইসলাম কত খারাপ এটা দেখানোই আপনার ব্রত। কিন্তু ওগুলো কি চেক করে দেখেছেন, ইসলামের ভেতরে কত কত ধারা কত কত বাদ-প্রতিবাদ সেগুলোর খোঁজ নিয়েছেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভাড়া করা বুদ্ধিজীবীদের লেখা পড়ে কি আর তা হবে? একটু মেহনত করুন ভাই। নইলে আপনাদের এসব কথা ইসলামের নামে জড়ো হওয়া কতিপয় গণবিরোধী ‘হুজুর’দেরই হাত শক্তিশালী করবে। আর করবেই না কেন, কেন তারা যেসব প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা প্রচার করে আপনারাও সেসবকেই মুসলমানের বিশ্বাস বলে মনে করেন। পোপ দিয়ে আমি আমার খ্রিস্টান ভাইদের যেমন চিনব না, তেমনি কতিপয় মোল্লাকে দিয়ে মুসলমানদেরও মাপতে চাইব না। একজন মানুষ কেবল ধর্মীয় জীব নয়, তারো আরো অনেক মাত্রা আছে, তেমনি একটি সংগ্রাম যতই ধর্মের নাম নিক, তারও জাতীয়তাবাদী, শ্রেণীভিত্তিক, মতাদর্শিক উৎস আছে। গান্ধি উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে ধর্মকে, রামরাজত্বের ধারণা এনেছিলেন তাই বলে তাঁর লড়াইকে আমরা ধর্মীয় লড়াই বলতে রাজি নই। তেমনি ইসলামের নামে আজকে একদিকে প্রতিরোধ আরেকদিকে প্রতিবিপ্লবী যে কাজকর্ম চলছে সেগুলোকে নির্বিচারভাবে এক করে দেখতেও রাজি নই।
মানুষ হিসাবে আমরা ভেদজ্ঞান অর্জন করেছি, এখানেই আমরা প্রাণীর থেকে পৃথক।