‘‘ঘনকৃষষ্ণ ধাতব পাতে বানানো বিপুল এক গম্বুজ যেন বৈরুতের আকাশ। এক মহাদুপুর হাড়ে হাড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার অবকাশ। দিগন্ত যেন ঝকঝকে ধুসর এক স্লেট, যে রংই দেয়া হোক খেলুড়ে জেটগুলো তাতে আড়াল পাবে না। আকাশ হিরোশিমাময়। যদি ইচ্ছা করি, তবে হাতে চক নিয়ে সেই স্লেটে যা কিছু লিখে ফেলতে পারি আমি। কী এক ঝোঁক চেপে বসে আমার মাথায়। যদি উঠে যেতে পারি খুব উঁচু কোনো দালানের ছাদে, তখন কী লিখব আমি, আকাশে? ‘‘ওরা তোমাকে যেতে দেবে না’। হ্যাঁ, তা তো বলাই হয়েছে। ‘হয়তো মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে আমাদের কিনতু অমর হোক জন্মভূমি’? এটাও আগে বলা হয়েছে। ‘হিরোশিমা’? তাও তো পুরনো কথা। আমার স্মৃতি থেকে, আমার আঙুল থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে শব্দগুলো। আমি ভুলে গেছি
হরফ। কেবল অক্ষয় হয়ে আছে এই কয়টি অর : বৈ-রু-ত।’’
Memory Of Forgetfulness : Mahmood Darwish))
বৈরুত ধসে যাচ্ছে বোমায়। তছনছ হয়ে যাচ্ছে গাজা, পুড়ে খাক হচ্ছে। বোমারু বিমানের ধাতব গর্জনে খানখান হয়ে যাচ্ছে আকাশ। সীমান্ত ছারখার হচ্ছে ট্যাংকের ঘাতে-আঘাতে। পদাতিকের বুটে মাটিতে লেখা হচ্ছে হিংসার পরওয়ানা। হিব্রু ঈশ্বরের ঘৃণা অতি ঐতিহাসিক। শরীরের পাপে তিন দেন শরীরের ধ্বংস,শরীরের পূণ্যে দেন শরীরী পুরস্কার। ইহুদিদের তিনি দিয়েছেন দুধ মধুর নহর প্রবাহিত ইসরাইল। আর আরবদের জন্য তার অফুরান লানত। এমন ত্রাস যে গর্ভের শিশুও জন্মাতে ভয় পায়। তবুও তারা বন্দির জরায়ু থেকে পরাধীন মাটিতে পড়ে। পাথর, রকেট বা রাইফেল হাতে নেয়ার জন্য বা নিজেকেই বোমা বানাবার জন্য। বন্দিশালায় শৈশব বলে কিছু থাকে না। দাসের শিশুও যে দাস সেটা সেই শিশু দাসটিও জানে_ আমরা জানি না। সেই শিশুরা বলে না, মা ‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’। সেখানে বোমা-বারুদ আর মৃত্যুর আবহে নারী-পুরুষের মিলন তবু হয়, সন্তানের আশায়। হায় সন্তান? এত জন্মায় তবু কমে যায় জাতির আকার। জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরো আরো জন্ম চাই। আরো শিশু চাই শহীদদের খালি জায়গা ভরাট করার জন্য। সহস্র সহস্র বছরের জাতীয় অস্তিত্ব টিকবে না যদি না শিশু জন্মায়, যদি না শিশু হাঁটাচলা শিখলেই শহীদ হতে না যায়। জন্ম আর মৃত্যুর এ কোন অঙ্ক কষে যাচ্ছে আজ ফিলিস্তিন ও লেবানন?
বাইবেলের আল্লা নৈতিক অপরাধের জন্য সোডোম আর গোমোরাহ নামে দুটি শহরকে আগুন আর পাথর বর্ষণ করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আর এখন ইসরাইল ফিলিস্তিন আর লেবাননকে ধ্বংস করছে ট্যাংক আর মিসাইলে। পাশ্চাত্যের কর্তাদের কাছে স্বাধীন মুসলমান বা আরব বা এশিয় বা আফ্রিকীয় হওয়া কেবল রাজনৈতিক অপরাধই নয়, নৈতিক অপরাধও বটে। এ যুদ্ধ শরীরের বিরুদ্ধে শরীরের যুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদ চায় অবসিত শরীর। অবশ হবে না যে, সে ধ্বংস হবে।
অবরুদ্ধ জাতির শরীর কেবল তার গতরের মধ্যে সীমিত না। তার ভূমি, তার আকাশ, তার প্রকৃতি, তার ভাষা ও ইতিহাস পর্যন্ত ছড়ানো তার শরীর। উপনিবেশিত যে সমাজের মধ্যে নিজেকে সনাক্ত করে উপনিবেশিতের শরীরের আয়তনে থাকে সেই সমাজও। উপনিবেশ এ শরীরকে ধ্বংস করে, দখলের প্রয়োজনে পুঁজির প্রয়োজনে। আধিপত্যই তার টিকে থাকার ভিত্তি। শরীরের এ ধ্বংস মনকে বাদ দিয়ে সম্ভব হয় না। তাই মনকে জাদু করার বটিকা হিসাবে 'সভ্যতা' ও 'গণতন্ত্রের' ইন্দ্রজাল পাতা থাকে তার চারপাশে। সেই ইন্দ্রজাল আমাদের এবং আগ্রাসী পশ্চিমা শক্তিকে একই যুক্তিবাদ একই মানবিকতা একই মূল্যবোধ আর একই উন্নয়নের তরিকায় বেঁধে রাখে। পশ্চিমা পীরের ছুঁড়ে দেয়া পাগড়ি ধরেই না আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এখন যা, তা হয়ে
উঠি। হয়ে উঠি পশ্চিমা অধিপতির চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের চির মুরিদান। ব্যাপারটা কেবল বুশ-ব্লেয়ারের কারসাজি বা হান্টিংটনের উর্বর মস্তিষ্কের উস্কানি নয়। ইউরোপ যখন আলোকিত দর্শন, সাহিত্য আর মানবতাবাদের ঢেকিতে নিরন্তর পার দিয়ে সভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠছে, সেই ‘আলোকিত যুগই’ই কি এশিয়া, আফিদ্ধকা আর ল্যাটিন আমেরিকায় বর্বরতম দখল আর লুণ্ঠনের উন্মাদ কাল নয়? সভ্যতা আর বর্বরতা কি নয় একই ঔরসে জন্ম নেয়া দুই ভাই, চাঁদের এপিঠ ওপিঠ? তার নিরাকার যুক্তিবাদের তাবিজের মধ্যেই কি ফ্যাসিবাদী শ্রেষ্ঠত্বের আঁটি পুরে দেয়া ছিল না? ইরাক-আফগানিস্তান আর ফিলিস্তিন-লেবানন তাই কোনো দুর্ঘটনা নয়, এ তার স্বভাবেরই ফজিলত। উত্থানের যুগ থেকেই ইউরোপীয় বুর্জোয়ার আগ্রাসী ক্ষুধা এক মুহূর্তের জন্যও নিরস্ত হয়নি। সেকারণে, তার এই আধিপত্যের প্র-যুক্তি যে আধুনিক মতাদর্শে গড়া তার বিরোধিতা না করে সত্যিকারভাবে মধ্যপ্রাচ্য কেনো,কোনো প্রাচ্যীয় সমাজ-অর্থনীতি ও প্রকৃতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় না। দাঁড়ানো যায় না, খোদ পাশ্চাত্যের কর্পোরেট পুঁজির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ইউরোপ আমেরিকার ভেতরের নীপিড়িতের সঙ্গে সহমর্মিতার পাটাতনে। এ কথা বুঝতে আমাদের আজো দেরি হলেও আলজেরিয় বিপ্লবী ফ্রানজ ফ্যানোর বরাতে জাঁ পল সাঁত্র তা অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন। ফ্রানজ ফ্যানোর ‘রেচেড অফ দি আর্থ’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেন, ‘‘ইউরোপীয় এলিট একটি ঔপনিবেশিক এলিট তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিল। সম্ভাবনাময় যুবকদের তারা বেছে নিত। গনগনে লাল লোহার ছেঁকায় দাগ মেরে দেয়ার মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বুনিয়াদী নীতিমালা দিয়ে তাদের দেগে দেওয়া হতো। তাদের মুখগহ্বর ভরিয়ে দেয়া হতো গুরুগম্ভীর মহান আর ঝাঁঝালো শব্দাবলী দিয়ে। তা দাঁতে বাজতো। ঔপনিবেশিক দেশে কিছুকাল থাকার পর তাদের পাঠানো হতো নিজের দেশে। এই চলমান মিথ্যার প্রতিমূর্তিদের তরফে তখন তাদের দেশীভাইদের বলার মতো কিছুই আর থাকতো না। তারা শুধু প্রতিধ্বনি করতো। প্যারিস, লন্ডন, আমস্টারডামে আমরা উচ্চারণ করতাম ‘পারথেনন ভ্রাতৃত্ব, আর আফ্রিকা অথবা এশিয়ার কোথাও তাদের কন্ঠ খুলে যেতো, ‘...তৃত্ত্ব তৃত্ত্ব তৃত্ত্ব’।”
এভাবে ‘আমরা’‘তারা’ হয়ে উঠতে চেয়েছি। আর তারা আমাদের সভ্য করার দায়িত্ব নিয়ে ‘করদ’করেছে। আমাদের সাহিত্য,বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও উন্নয়ন সেই ‘তারা’র জবানীতে বর্ণিত হয়। কারণ আমাদের কথা আমরা বলতে শিখিনি।
এখন আর সভ্য হওয়ার জন্য ইওরোপে যেতে হয় না, ইউরোপ চলে আসে ঘরের কাছে। দোকান খোলে বাহারি সব উন্নয়ন, প্রগতি আর আধুনিকতার। এ পণ্যের প্রচারকদের আমরা নাম দিয়েছি জাতীয় বুদ্ধিজীবী। অথচ কী পরিহাস! কোটি কোটি ‘আঁধারবাসী’
'পশ্চাদপদ' জনগণের কাছে এদের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নাই। এ বুদ্ধিজীবীদের তারা পুঁছেও দেখে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন বলেছিলেন, 'এসব মানুষ প্রতিদিন যে পানি খায় তা দিয়ে ঐসব আলোকিত মানুষরা ছুঁচতেও রাজি হবেন না।' তাহলেও আমাদের সাংস্কৃতিক মেরাজ বন্ধ হয় না, পশ্চিমা আরশের সংবাদের তৃষ্ণাও মেটে না আমাদের। আমাদের বাসনা চায় ইওরোপের লাওহে মাহফুজে রক্ষিত সভ্যতার ও আত্ম-উপভোগের শাঁস চেখে দেখার অভিযান চালাতে। এই-ই তাদের সেক্যুলার ধর্ম এবং জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াবার দার্শনিক বর্ম। তাই আমাদের মতো উপনিবেশিত দেশের সামাজিক পাঁকে আটকে থেকে কল্পনার সুষমায় পাক খেতে থাকা প্রতিটি ‘আলোকিত’ ও 'শিক্ষিত' নাগরিকদের কি নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত নয়, যে সুরভিত মোমের পাখনায় আমাদের সাংস্কৃতিক উড়াল, তা কি জাতীয় অবস্থা তথা জনগণের অকহতব্য দুর্দশা থেকে দূরে সরবারই ছল? ছল, কেননা পাখনাটা মোমের আর সংগ্রামের সূর্যের তাপে তা গলে যেতে বাধ্য। ইকারুসের মতোই। যেমন গিয়েছিল একাত্তরে। জনগণ লড়েছে আর বুদ্ধিজীবীদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছে বা মেতেছে কলকাতাইয়া নাচনে।
তবুও সভ্যতা থাকছে। থেকে যাচ্ছে পশ্চিমে আর দূরতাড়িত আমাদের মগজের কোষে কোষে। লেখক-শিল্পী আর ‘আলোকিত’ মগজে পুষ্টি যোগানো এ মহান সভ্যতা। হা সভ্যতা! সেটা এখন এক পরিত্যক্ত পিরামিড,যার গায়ে মোতে শেয়াল আর হায়েনা। সেই মুতের ধারায় অবগাহিত সভ্যতার বাঁট দুইয়ে কোন সুধা আমরা চেটে নিতে চাই?
পশ্চিমা সভ্যতার মোহ যাকে সবচে বেশি পেয়েছিল সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই লেখা হয়েছিল তার এপিটাফ : ‘সভ্যতার সংকট’। জীবনানন্দ দাশেরও এ মোহ ছিল না। তাই লিখতে পারেন, ‘পশ্চিমে প্রেতের
মতো ইউরোপ, পূর্বে প্রেতায়িত এশিয়ার মাথা’।
পাশ্চাত্যের তুলতুলে মানবতা হিংসার বিরুদ্ধে, ঘৃণার বিরুদ্ধে,নিপীড়িতের ধর্মের বিরুদ্ধে। কেননা এগুলোর একচেটিয়া অধিকার তাদেরই। তাদের হিংসা থাকতে পারে অবাধ্যদের প্রতি, ঘৃণা থাকতে পারে অসভ্যদের প্রতি। জ্যোতির্ময় ধর্মবোধজাত বিদ্বেষ থাকতে পারে অখ্রীস্টানদের প্রতি। হিংসা আমাদের থাকতে পারে না। কিনতু সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘কোনো ভদ্র আচরণই সহিংসতাকে মুছে ফেলতে পারে না; শুধুমাত্র সহিংসতা নিজেই তার অবসান ঘটাতে পারে’(সাঁত্রে)। বিদ্রোহীর হাতের বন্দুকই তার মানবিকতার প্রমাণ। কারণ এর মাধ্যমেই সে দাস হতে অস্বীকার করে।
আগ্রাসী মালিককে খুন করে সে যেমন অত্যাচারীর বিনাশ ঘটায়, তেমনি বিনাশ ঘটায় নিজের ভেতরের নিপীড়িত সত্তাটিরও। একমাত্র এভাবেই সে মুক্ত হয়। সাঁত্রে বলেছেন, এরপর পড়ে থাকে একজন মৃত মানুষ আর একজন মুক্ত মানুষ।’
ঘৃণা তীব্র ভালবাসার অপর পিঠ, এ আমরা মানি। তবে ভালবাসার বিষয়কে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে যদি আমার ঘৃণা না থাকে ,তবে সেটা কপটতা_ আত্মপ্রহসন। ওজেন ন্যাশের একটি কবিতা বলছে, ‘অ আ পড়া যে কোনো বাচ্চাই ভালবাসতে পারে বোকার মতো, কিনতু ওহে বত্স্য ঘৃণা করাটাই হলো শিল্প।’ ঘৃণা করাটা একইসঙ্গে রাজনীতিও বটে। ইউরোপের রেনেসাঁস মানবতা আর হেলেনিক সৌন্দর্যবোধ সত্ত্বেও, আত্মমর্যাদা ও দেশাত্মবোধ সত্ত্বেও এর কোনো কিছুই ঘৃণ্য নিগার, ঘৃণ্য আরবদের ভালবাসতে শেখায় না। দেখতে হবে নীপিড়িতের চোখ দিয়ে। সেই চোখে ঘৃণার বিরুদ্ধে পাল্টা ঘৃণার আগুন ছাড়া আর কিছুই জায়েজ নয়, সত্য নয়। অতএব শিল্পও নয় যথার্থ শিল্প। ঘৃণা মুক্তিকামীর ইমানের শিরদাঁড়া। অনেক পরমহংস আমাদের দেখা হয়েছে,জমানো হয়েছে অনেক শান্তিবাদী মজমা। আর কত হে পাবক!
বিশুদ্ধ ধর্ম তো সভ্য মানুষের ব্যাপার। অন্যসব কুসংস্কার। তাদের প্রয়োজনে সত্তর আর আশির দশকে ইসলামের দুটো সংস্করণ হয় : মৌলবাদী আর লোকায়ত। আবার তাদের প্রয়োজনেই আজকে তা ইসলামো-ফ্যাসিস্ট আর মডারেট ধারায় বিভাজিত। সবই তাদের লীলা। অথচ বিশ্বের একমাত্র আত্মস্বীকৃত ধর্মরাষ্ট ইসরাইলকে বর্ণবাদী ও ফ্যাসিস্ট বলা যাবে না। তাকে রক্ষার বুশীয় দাপট, তার প্রতি পাশ্চাত্য সিভিল সমাজের বড় অংশের সমর্থন কোনো সাম্প্রদায়িকতা নয়? হলিউডি সিনেমায় অজস্র ক্রুশের ব্যবহার থেকে শুরু করে মার্কিন সমাজে
পাদ্রীদের প্রাধান্য কখনোও বিবেচিত হবে না রক্ষণশীলতা বলে। বুশ বা গোর বা ওবামা দুনিয়ায় ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব বললেও তাদের সেকু্লারিজমের সতীত্ব যায় না। বৈশ্বিক পোপতন্ত্রকে বলা যাবে না প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গ। (ভাগ্যিস মুসলিমরা এরকম কোনো বৈশ্বিক ধর্মতাত্ত্বিক ঘাঁটি এখনও বানাতে সক্ষম হয়নি। তাহলে তাদের যাত্রা আরো দূর অস্তই হতো কেবল) আর হিজবু্ল্লাহর মতো জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক দলকে বলা হবে ধর্মীয় সন্ত্রাসী। আমাদের বিবেক হিজবুল্লাহ বা হামাসের প্রতিরোধে সামিল হতে চায়, কিনতু চিন্তা বলে, ‘ও তো মৌলবাদী’। ঔপনিবেশিক ঠুলি পড়া চোখে আমরা কেবল তাদের দাড়ি বা টুপিই দেখি। যে সেক্যুলার বাস্তব জাতীয় সংগ্রামের মাটিতে তাদের পা পোঁতা সে জমিনে আমাদের নজর পড়ে না। লেবাননি প্রতিরোধ ধর্মীয় জেহাদ নয়, তা জাতীয় প্রতিরোধ। যদিও এ ফেকড়া তুলেই পশ্চিমা মিডিয়া ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রতিবাদস্পৃহাকে আধুনিকতার আংটা দিয়ে লটকে রাখে শূণ্যে। জনগণের ফরিয়াদকে যদি আমরা ধর্মের জিম্মায় রেখেই খুশি থাকি, তবে জনগণ ‘মৌলবাদের’ দলে গেলে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? জনগণের দায়িত্ব কী চেতনায় আর কী আমলে আমরা নিচ্ছি? (এর বিপরীতে আরেক জিঘাংসার রস চোঁয়াতে দেখি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আরবের প্রতিরোধ দেখিয়ে বঙ্গীয় প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম,তথা শরিয়াবাদীদের উত্থানকে মজলুমের উত্থান বলে চালাবার চেষ্টাও দেখি। বুঝি যে, একাত্তরের প্রত্যাঘাতের
জমিন তৈরি চলছে)
ফ্যানো একে বলেছেন, ‘‘জাতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য। এই শ্রেণীর আত্মিক দারিদ্র এবং তাদের মধ্যে গেড়ে বসা গভীর কসমোপলিটান মনোভাবও এর জন্য দায়ি।’’ যে সংস্কৃতির জমিনে তাদের আগডুম বাগডুম সেই জমিনে অনেককাল তাই কিছুই ফলে না। তারা জনগণকে ভয় পায়। এই ভয় থেকে জন্ম নেয় তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা। প্রভুকেও তারা ভয় করে, কিনতু তা রূপান্তরিত হয় ভক্তিমিশ্রিত আনুগত্যে। সেকারণে একই অঙ্গে মানবতাবাদী ছটফটানি এবং সাম্রাজ্যবাদের উন্নয়ন ও আধুনিকতার জোয়ার বইয়ে দেবার উদ্দীপনার দোলাচলে কাতরতা দেখি। আমাদের অবস্থা হয় না ঘরকা না ঘাটকা। আমাদের আত্মচৈতন্য অপরের ছাঁচে ঢালাই হবার কারণে তা এক নৈতিক সঙ্কটেরও কারণ হয়। আমাদের চৈতন্য আর সমাজ জীবনের মধ্যে এমন এক কাঁটাতারের বেড়া, যার আগম-নিগমে রক্তাক্ত হবার সম্ভাবনা। এ অবস্থা লজ্জাকর। মার্কস বলেছেন, লজ্জাও এক বিপ্লবী ব্যাপার। কারণ, সেখানে নিজেকে পাল্টাবার চেতনাগত তাগিদের বীজ থাকে।
সভ্যতার সীমান্তদেশে আমাদের বাস।
জার্মান দার্শনিক হেগেল ইউরোপকে সভ্যতার কেন্দ্র তথা বিশ্ব ইতিহাসেরও কেন্দ্র বলে প্রতিষ্ঠা করার দার্শনিক প্রকল্প নির্মাণ করেছিলেন। আর অন্যরা? না অন্যদের কল্পকথা, মিথ-পুরান ইত্যাদি থাকলেও তা ইতিহাস নয়। সেসূত্রে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার জীবন অনৈতিহাসিক। প্রায় আড়াইশ বছর আগে বঙ্কিকমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় এবং তার ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টপাধ্যায় একযোগে আক্ষেপ করে উঠেছিলেন
‘আমাদের ইতিহাস নাই’। আমরা প্রান্তবাসী। আমরা বড়জোর সভ্য ইওরোপীয় বিশ্ব-ইতিহাসের উপাদান। যেমন আমরা উপনিবেশের অংশ, যেমন আমরা এখন পশ্চিমের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের বাধ্যতামূলক শরিক। তারা কর্তা, আমরা কর্ম। তারা আমাদের ওপর করেন, আমাদের দিয়েও করান। আমরা করে করে শৈশব হারিয়ে সাবালক ও সভ্য হয়ে উঠি। উঠতেই থাকি।
কিনতু এখন লেবানন, ফিলিস্তিন আর ইরাকে আরব গেরিলাদের প্রতিরোধযুদ্ধ রথের চাকা আটকে দিচ্ছে। আগের সকল উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন করে নিজেদের কর্তাশক্তি জাহিরের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এটাই উপনিবেশ বিরোধিতার মর্মকথা। তাই এটা কেবল রাজনৈতিক প্রশ্ন না, সমান তালে তা সাংস্কৃতিক জিজ্ঞাসাও বটে। এ অবস্থা মোকাবেলা করার কোনো চোরাপথ নাই। দাঁড়াতে হবে সামনাসামনি। আলবাত! প্রশ্নটা সোজাসুজি বি-উপনিবেশীকরণের। এর অর্থ হচ্ছে হারিয়ে ফেলা আত্মচেতনাকে
নতুন করে নির্মাণ করা। অতীতে ফিরে যাওয়া নয়, এই মামলা স্বাধীন ও মুক্ত জীবন নির্মাণের মামলা।
বগ্ধিকমের প্রায় শতবর্ষে পরে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপনিবেশের ফল দেখে আপে করে বলেছিলেন,‘আমরা আমাদের হারিয়ে ফেলেছি’। এই উপলব্ধি তাকে বিষন্ন করে তুলেছিল। বিষন্নতা বিপর্যয় সম্পর্কে চেতনতার প্রথম ধাপ। লেবানন-ইরাক-আর ফিলিস্তিন যদি আমাদের কিছুটা বিষন্নও করে তুলতে পারে, তবে সেটাকেই সপ্তস্বরের প্রথম স্বর ভাবতে পারি। যদিও তা কেবলই শৈশবিক, কেবলই প্রাণবিক। মানুষ হতে আমাদের আরো দেরি আছে।
অনেক বছর আগে সন্দীপন চট্টপাধ্যায় মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতার একটি চরণ তুলে নিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’। গণহত্যার পুতুপুতু প্রতিবাদ নয়, আজকের বাঙালি মধ্যবিত্ত লেখক-শিল্পীদের মধ্যে কুতুব ক’জনা, যে বলবেন, ‘আমিও
আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’?
(রচনাটি গতবছর ইসরায়েলের বৈরুত আত্রক্রমণের সময় রচিত, এবার কিঞ্চিত মার্জনা হয়েছে)