ঠিক এই দিনে ব্রিটিশ-ফরাসি মদদে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ করে শহরের পর শহর দখল করে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের সবচে শক্তিশালী ও কদর্য মৌলবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। আজ সবাই যাচ্ছে ইসরায়েলে। জর্জ বুশ, স্টিভেন স্পিলবার্গ, নাদিন গর্ডিমারসহ অনেক বাঘা বাঘা কুতুব। তারা আজ উল্লাস করবেন, শরাব ছেটাবেন। আর ওদিকে দুনিয়ার বৃহত্তম ছাদখোলা বন্দিশিবির ফিলিস্তিনে চলছে গত শতকের দীর্ঘতম দখলদারিত্ব। ফিলিস্তিনীরা এদিনকে নাকবা বা 'বিপর্যয়' বলে স্মরণ করে।
স্পষ্ট করে শোনা যায় না এমন কণ্ঠস্বর। আবহে কারা যেন কথা বলছে। ফাঁসি কক্ষে কেউ কাউকে ডাকছে ‘আলী’ ‘আলী’ বলে ।
সাদ্দাম হোসেন : ‘ওহ! আল্লাহ।’ (ফাঁসির দড়ি গলায় পরার সময় আরব রীতি অনুযায়ী সাদ্দাম বলেন।) একটি কণ্ঠ মুসলিম ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রার্থনার নেতৃত্ব দিয়ে বলে : ‘হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর পরিজনদের প্রতি আল্লাহর রহমত নাজিল হোক’।
সাদ্দামসহ সবাইকসঙ্গে বলে, ‘হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর পরিজনদের প্রতি আল্লাহর রহমত নাজিল হোক।’
কয়েকজনের মিলিত কণ্ঠ শোনা যায় : ‘মুকতাদা ... মুকতাদা ... মুকতাদা’ (তরুণ শিয়া ধর্মীয় নেতার নাম)
কৌতুকের সঙ্গে সাদ্দাম উত্তর দেন : ‘মুকতাদা ... মুকতাদা! এই তোমাদের বীরত্বের নমুনা?’
কয়েকজন ব্যক্তি বারবার বলে : ‘জাহান্নামে যাও’।
পরিহাসের সুরে উত্তর দেন সাদ্দাম হোসেন : ‘সেই জাহান্নাম, যার নাম ইরাক!’
(ফাঁসির মঞ্চে সাদ্দামের কথোপকথনের সেই অংশ যা পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করেনি। সূত্র: http://www.global research.ca
এক. যুগের পর যুগ আরবরা একজন মুক্তিদাতার জন্য প্রার্থনা করেছে। স্বপ্ন দেখেছে একদিন কোনো এক বীর এসে তাদের মুক্তি দেবে। মুক্তি দেবে বাইরের শোষণ, অপমান আর দখলদারিত্ব থেকে। জাগরণে ও কল্পনায় তারা চেয়েছে জেহাদজয়ী বীর, ইউরোপের আগ্রাসী ক্রুসেডারদের পর্যুদস্তুকারী সারা-আরব বাহিনীর নেতা সালাদীনকে। ইতিহাসের সালাদীন আর আসেননি, এসেছেন সাদ্দাম। ইতিহাসের লীলা বোঝা ভার। সালাদীন খাঁটি আরব ছিলেন না, ছিলেন কুর্দ। আর ইঙ্গ-মার্কিন দখলদারির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সাদ্দামের হাতে ইরাকি কুর্দিদের রক্ত লেগে আছে। বর্তমানকালে সালাদীনের জাতির শত্র“ সাদ্দামকে সেই কুর্দি সালাদীনেরই ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিল আরবরা। আর আমেরিকা কিনা সেই কুর্দিদের নামেই সাদ্দামের স্বাধীনচেতা চরিত্রকে শাস্তি দিল। ইতিহাসের কৌতুক এমনই নিষ্ঠুর, এমনই বেদনাবিধুর আর এমনই জীবন্ত তার সংবেদন_ তাদের কাছে, যাদের মন দাসত্ব খেটে খেটে এখনও ঝামা হয়ে যায়নি।
তারপরও মরুভূমির তপ্ত বালি আর খরশান সূর্য আরব জাতীয়তাবাদের স্বপ্নকে উবে যেতে দেয়নি। গত ২০০ বছরে আরবদের একেকটি প্রজন্ম বড় হয়েছে আর রক্ত দিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আগুয়ান হয়েছে। প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক রামজি বারুদ লিখেছেন, ‘তরুণ বয়সে আমরা যখন নির্মম ইসরাইলি দখলদারিত্ব মধ্যে বেড়ে উঠছি, তখন আমি ও আমার বন্ধুরা বিশ্বাস করতাম, দখলদারিত্ব ও অপমানের একমাত্র নিদান আরবদের জাতীয় সংকল্প। গাজার উদ্বাস্তু শিবিরে ইসরাইলি কারফিউর মধ্যে হামেশাই এই আশা নিয়ে ঘুমাতে যেতাম যে, ঐক্যবদ্ধ আরব বাহিনী হয়তো রাতের যে কোনো মুহূর্তে সীমান্ত পেরোবে। আমাদের মুক্ত করবে এই গরাদখানা থেকে। তারা আসেনি, আজো না।’
এই স্বপ্ন কেবল রামজি বারুদের একার নয়, তার মতোই আরো বেশুমার আরব তরুণের। কিন্তু তারা বড় হতে হতে বুঝলেন, বিষয়গুলো এত সরল আর সাচ্চা নয়। আরব শাসকদের কেউই সালাদীন নন। বরং উল্টোটা, দু’একজন দলছুট নাসের-আরাফাত জন্মান ঠিকই কিন্তু বাকিরা দখলদারের পয়বন্দ নায়েব-গোমস্তা ছাড়া আর কিছু নন। তখনই সাদ্দাম দাঁড়ালেন। তিনি যখন ইসরাইলে মিসাইল পাঠান, তখন আরব শহরগুলোতে হুল্লোড় ওঠে। হয়তো হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহও আরব হৃদয়ের এই আকুতিতে বা নিজ গরজে যখন উঠে দাঁড়ালেন, বহু পুরনো আরব গেরিলাদের ইমেজ যেন আবার মূর্তি পেল। কেবল আরবেই নয় গোটা দুনিয়ার মুসলমানরাও ভুলে গেলেন একদা সাদ্দাম আমেরিকার কতটা বশংবদ ছিলেন। ভুলে গেলেন, মুসলিম বা আরব নয় নিজেকে তিনি সেক্যুলার শাসক হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। ভুলে গেলেন যে, সালাদীন ছিলেন কুর্দ আর সাদ্দাম কুর্দিদের জাতীয় শত্রু। প্রমাণ হলো ইতিহাস অতীত দিয়ে নয়, বর্তমান দিয়েই নিরূপিত হয়। সেই বর্তমানে হতাশায় মুষড়ে পড়া আরব জনতগণ একজন বীরের জন্য ক্ষুধার্ত। এতই ক্ষুধার্ত যে সত্যিকার বীরকে চিনতে তাদের দেরি হয়। ফিলিস্তিন, লেবানন আর ইরাকের কোন্ প্রতিরোধ যোদ্ধা বীর নয়? আরবে বীর আছে নেতা নাই। নেতা থাকলেও আদর্শ নাই। সাদ্দামও সেটি দিতে পারেননি সত্য. কিন্তু তার আকুতি জাগিয়েছেন নিজে তার ছায়ামূর্তি হয়েছেন। যতটা না রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তার থেকে বেশি বন্দিত্বের কালে। বন্দি সাদ্দামের কপালের ভাঁজে কি তখন আরবের ভাগ্যলিপি খোদিত হচ্ছিল না? অতি সাধারণ, অতি মহিমাহীন ও অতি পর্যুদস্তু ঐ মানুষটির জন্য তখন আর ছাড়ের দরকার হয় না। তখন তিনি নিজেই নিজের পাপস্খালনকারী। তার বৈধতার জন্য কারো সুপারিশের আর দরকার নাই। তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন গোটা আরবের হয়ে সওয়ালকারী। জালিম আমেরিকা তাকে সেই আসনেই বসিয়েছে। আমেরিকার বন্ধু সাদ্দামের ফাঁসি হয়নি, হয় না কখনো। যেমন হয় নাই পিনোশে’র, সৌদি বাদশাহ’র, কুয়েতের আমীরের, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর। তারা সকলেই আমেরিকার সাগরেদ, ইসরাইলের শ্যালক। যে সাদ্দামের ফাঁসি হয়েছে সে সাদ্দাম প্রতিরোধের নেতা ও প্রতীক_ সালাদীনের উত্তরসূরী। তার বিচারের সাধ্য সাম্রাজ্যের খয়ের খাঁ-দের নাই। বাগদাদের সাজানো বিচারালয়ে যার বিচার হয়েছে তিনি সাদ্দাম নন, বিচার হয়েছে সাম্রাজ্যের। সওয়ালকারী সাদ্দাম নিজেই, রায়দাতাও তিনি। সেই রায় হলো: ইরাকের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের নির্দেশ। মৃত্যুর মুখে সাদ্দাম পুনরায় তা স্মরণ করিয়ে দিলেন। কোন আরব তা খণ্ডন করার ক্ষমতা রাখে, করে অস্বীকার?
দুই. প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংঘাত অনেক পুরনো। অস্টম শতাব্দীতে আরব বাহিনী স্পেনের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলে এর প্রথম পর্ব শুরু হয়। তারপর একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত পোপের ডাকে ইউরোপীয়দের একের পর এক ক্রুসেড চলে। এর মাধ্যমে সালাদীনের নেতৃত্বে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংঘাতের দ্বিতীয় পর্ব শেষ হয়। এরপর ২০০ বছর সময় নিয়ে আবার স্প্যানিশ-পর্তুগিজ-ডাচ ও ব্রিটিশ জলদস্যু বাহিনী আরব বন্দরগুলোতে হানা দেয়, একের পর এক এশিয়া-আফ্রিকায় ছড়ানো আরব ও মুসলিম বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো দখল করতে থাকে। এক্ষেত্রে বীরত্ব নয়, তাদের পন্থা হয়ে উঠেছিল ষড়যন্ত্র। জেদ্দা থেকে ওদিকে আফ্রিকা আর এদিকে ইন্দোনেশিয়া-মালয় হয়ে ভারতের কালিকট বন্দর পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয় গণহত্যা, ছলচাতুরি, একের বিরুদ্ধে অপরকে চালানো এবং বিশ্বাসঘাতকতার অস্ত্রে। এটিও এক যোগ্যতা বটে! আখেরে ঔপনিবেশিক দখলাধীন হয়ে পড়ে এশিয়া-আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল, খুন হয় লাখ লাখ প্রাচ্যীয় আদমকূল। অথচ কানা সভ্যতা ইহুদি নিধন নিয়ে যত সোচ্চার এমনকি ল্যাটিন আমেরিকার জনজাতিদের হত্যা-ধ্বংস যতটা স্বীকার করে, এশিয়া-আফ্রিকায় ঐ সভ্যতার একইরকম কীর্তির স্বীকার ততটাও করে না। (এমনকি আমাদের নিজেদের তরফেও না। হলিউডের বরাতে আমাদের সকল ক্রোধ ও শোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অন্যায়ভাবে নিহত ইহুদিদের জন্যই খরচ হয়ে যায়। আমরা যখন আর আমাদের নাই, তখন নিজ ক্রোধ আর নিজ কান্না নিজেদের জন্য রাগে না নিজেদের জন্য কাঁদে না। মন-হারা হয়েছে যে, তার আনন্দ-বেদনা দাসের মতো। প্রভু ভিন্ন অন্য মুক্তি, সে জানে না।)
বিংশ শতকের প্রথম ভাগে একের পর এক আরব অঞ্চল পোকায় খাওয়া স্বাধীনতার ফল খেয়ে যখন পেটের পীড়ায় বেসামাল, তখনই শুরু হয় দখলদারিত্বের চতুর্থ পর্ব। ফিলিস্তিন দিয়ে শুরু এবং ইরাক দখল, লেবাননে আগ্রাসন এবং সিরিয়া ও ইরান আক্রমনের মহড়ার মধ্যে তা এখনো চলমান। যা কিছু দেখা যায় এটা তার তালিকা, কিন্তু এরই ভেতরে কত কত অন্তর্ঘাত, গুপ্টহত্যা, পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা, বিনিয়োগের নামে প্রাকৃতিক সম্পেদের কর্তৃত্ব গ্রহণের ঘটনা আছে_ তার ইয়ত্তা নাই।
তিন . অনেক বছর আগে মিসরের জাতীয়তাবাদী নেতা, আরবদের মানসপুত্র বলে সম্মানিত গামাল আবদেল নাসের কায়রোয় বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। মিসরের বিপ্লবের সাফল্যের বর্ণনায় ভরা ছিল সে বক্তৃতা। কিন্তু ভিড়ের ভেতর থেকে ধ্বনি ওঠে, ‘ও গামাল, ফিলিস্তিনের কী হলো’! আজো এটা সত্য। আজো বেশিরভাগ আরব ফিলিস্তিনের সমস্যাকে তাদের ঘরের সমস্যা মনে করে। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে না পারার জন্য, দখলদারদের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য আরব জনগণ তাদের প্রতিটি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সাদ্দামের মৃত্যু তাদের এ তিক্ততাকে আরো শানিত করবে সন্দেহ নাই।
চার. সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি এই ধারাবাহিকতারই অংশ। মৃত্যুর আগে সাদ্দাম নিজেও বোধহয় টের পেয়েছিলেন, তার মৃত্যু সামান্য নয়_হবে অসামান্য। এই বোধ তার মধ্যে ছিল। সেটাই প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে আটকের মুহৃর্ত হয়ে নিজেই ফাঁসির দড়ি গলায় পরার সময় পর্যন্ত তার মধ্যে বীরের সাহস আর আরবের জাতীয় নেতার দায়দায়িত্বের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। তার মধ্য দিয়েই কথা বলে উঠেছিলেন কিংবদন্তীর সালাদীন_ অর্থাৎ ইতিহাস। সেকারণেই সাদ্দামই উচ্চারণ করেন আরবের প্রাণের স্লোগান, যতদিন না মুক্তি, ততদিন প্রতিরোধ। সাদ্দামের দ্বিতীয় জন্মের এটাই প্রমাণ। ফাঁসিতে ঝুলন্ত সাদ্দামের ভেতর থেকে এভাবে নায়ক সাদ্দামের জন্ম হয়। নিপীড়িত জাতির কল্পনাশক্তির থেকে বিপজ্জনক আর কিছু নাই, দখলদারের জন্য। ক্ষুদিরামকে নিয়ে গানের কথা আমরা মনে করতে পারি।
কারো কাছে তিনি বীর, কারো কাছে খলনায়ক। তা হোক। যে মানবাধিকারের তত্ত্বের ভিত্তিতে সাদ্দামের সমালোচনা হয়, সেই মানবাধিকার আগে ইরাকে প্রতিষ্ঠিত হোক, অন্তত সাদ্দাম জমানার কাছাকাছি মাপের কিছু; তারপর সেই সমালোচনায় বসা যাবে। তার আগে এটা অপ্রাসঙ্গিক, অর্বাচীনের খেয়াল। ফন্দিবাজের কানপড়ায় আমাদের কাজ নাই। আপাতত আমরা জানি, তিনি সাম্রাজ্যের শহীদ। বন্দি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে এরকম দৃঢ়তা ও সাহসিকতার নজির এ দুনিয়ায় তৃতীয়টি দেখার সুযোগ নাই। সেই অর্থে জনমানসে তিনি নয়া শতা¦ব্দীর প্রথম বীর বলেই চিহ্নিত হবেন।
পাঁচ . সাদ্দামের ফাঁসির দৃশ্য দেখে কেউ হেসেছে, কেউ বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছে। কোনো নির্বোধ ইরাকি উল্লাসে আকাশে গুলি ফুটিয়েছে, কেউ ঘৃণায় মার্কিন সেনাদের মেরেছে। আকাশে থুতু ছিটালে তা নিজের গায়েইপড়ে, গুলিও তেমন। অধীনের এই আনন্দে প্রভুরই সৃষ্টি। আবার অধীনের এই ঘৃণার মধ্যেই মুক্তির নিয়ত জাগে। ঘৃণাই মুক্তিকামীর চোখের জ্যোতি, অন্তরের আগুন_অবরূদ্ধ অন্ধকারে।
ছয়. এই ইরাকেই আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে ‘হাম্মুরাবির আইন’ প্রণীত হয়_ পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন। ‘চোখের বদলে চোখ' এরই বিধান। প্রতিশোধ আর ঘৃণা সেখানে অচেনা নয়। তাই ঐ উল্লসিত আর ঐ ঘৃণায় জর্জরিত দু’জনই যে বন্দিশিবিরের মানুষ, এ সত্য একদা ফকফকা হবে। উভয়ের বংশধরই দখলদারদের ঘৃণা করতে শিখবে_ ইতিহাসই শেখাবে। তাই আজ যে শিশু সেখানে জন্মাচ্ছে, তার জন্ম নিরর্থক যদি না সে যোদ্ধা হয়। হয় নিজ সীমান্তের ভেতর সে বন্দি, নয়তো নিজ সীমান্তের ভেতরই তার যুদ্ধ_ জানবে সে। বন্দিশালায় শৈশব আসে না, চুরি হয়ে যায়। দখলের আগে কেবল অবরোধেই ইরাকের পাঁচ লাখ শিশু স্রেফ মরে গিয়েছিল, এখনও মরছে সমানে । দাসের শিশুও যে দাস সেটা সেই শিশু দাসটিও জানে_ ‘সভ্যতা’ নামক শাদ্দাদের বেহেশতের বাসিন্দারা জানে না। বোমা-বারুদ আর মৃত্যুর আবহে নারী-পুরুষের মিলন তবু হয় সেখানে, সন্তানের আশায়। এত জন্ম তবু কমে যায় জাতির আকার। জন্মের থেকে মৃত্যুর হার বেশি হয়ে গেলে, নতুন শিশু ছাড়া কীভাবে আত্মরক্ষা করবে ফিলিস্তিন? মুক্তির দীর্ঘ যুদ্ধে কীভাবে টিকে থাকবে লেবানন, উঠে দাঁড়াবে ইরাক? সেখানকার মায়েরা জানে, জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরো আরো জন্ম চাই, শহীদদের খালি জায়গা ভরাট করার জন্য আরো শিশু চাই। সহস্র সহস্র বছরের জাতীয় অস্তিত্ব টিকবে না যদি না শিশু জন্মায়, যদি না শিশু হাঁটাচলা শিখলেই শহীদ হতে যায়। আজ জন্ম আর মৃত্যুর এ কোন হৃদয় হিম করা অঙ্ক কষে যাচ্ছে ইরাক- ফিলিস্তিন-লেবানন?
সাদ্দামের মৃত্যু এরই অংশভাগ, এই বহমান কাহিনীরই একটি অধ্যায়।
সাত. জোরোলো যুক্তি নাই, তবু সাদ্দামের মৃত্যুর মধ্যে আরেকজনের মৃত্যুর কথা বলক দিয়ে ওঠে যদি, তবে তা বাহুল্য হয় না। তার দেশবাসী বেদুঈনরা তাকে মরুর সিংহ নামে আজো স্মরণ করে। তিনি লিবিয়ায় ইতালির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকারী মুজাহিদদের নেতা। ওমর আল মুখতার। লিবিয়ার মরু আর পাহাড় তার যোদ্ধাদের ঘাঁটি হয়েছিল। তার নেতৃত্বেই অনেক বছর প্রতিরোধ চলেছিল। লিবিয়া দখলের সময় ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনি বলেছিল, ‘যে আমার সঙ্গে নাই সে আমার শত্রু’। এই ব্যবসায় বুশই প্রথম পুরুষ নয়। এ ধ্বনি তুলেই লিবিয় জনগণের অর্ধেককেই ফাঁসি. গুলি অথবা অনাহারে ও পীড়নে নিহত হয়। এর জবাবেই গ্রাম্য মক্তবের শিক্ষক মুকতাদা বাহিনী গড়ে তোলেন, প্রতিরোধ যুদ্ধ চালান। তাকে দমনের জন্য মুসোলিনি গ্রাসিয়ানি নামে এক জল্লাদ সেনাপতি পাঠায়। রাজি হওয়ার আগে গ্রাসিয়ানি মুসোলিনীকে যে শর্ত দিয়েছিল, চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন বাহিনী আজ তার বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে। (অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও মার্কিন বাহিনী তাদের যে কোনো কাজের জন্য সকল দুনিয়াবি আইনের ঊর্ধ্বে। আর তারা তো নিজেরাই খোদার আসন নিয়েছে।) গ্রাসিয়ানির সেই শর্তটি এই : লিবিয় প্রতিরোধ দমনে তার কোনো কাজের জন্য ইতালি বা দুনিয়ার অন্য কোনো দেশের আইন প্রয়োগ করা হবে না। এবং হয়ওনি। ১৯৩১ সালে মুজাহিদদের খাদ্য ও তথ্যের যোগান ফুরিয়ে আসছিল। গোলাবারুদও শেষ প্রায়। এর আগেই মুখতার বার দুয়েক অসুস্থ হয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাকে মিনতি করে, নিজের বয়স এবং শরীরের কথা বিবেচনা করে তার উচিত অবসর নেয়া এবং দেশত্যাগ করা। জনগণের দেয়া নাম তিনি রক্ষা করেন। মরুসিংহ যুদ্ধরত অবস্থায় আটক হন। ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে লিবিয়ার সলুক শহরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তখন তার বয়স আশি বৎসর। শহরের বাসিন্দাদের বাধ্য করা হয় তাদের নেতার ফাঁসিতে ঝুলন্ত মৃত্যু দেখতে। শেষকালে সাদ্দামের বয়সও হয়েছিল মুখতারেই কাছাকাছি_ সত্তর বছর। তার ফাঁসির দৃশ্য প্রচারের উদ্দেশ্যও এ ভিন্ন আর কিছু ছিল না। কর্পোরেট মিডিয়া আমাদের তা দেখতে বাধ্য করেছে। আর আমরা ভাবি আমরা মুক্ত। হা দাসত্ব, হা আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা!