পাকিস্তানের লাল মসজিদ কাণ্ডের একচোট মহড়া হয়ে গেল বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে। তারই প্রতিধ্বনি উঠল চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে। একদিনে একই লগ্নে। ছকটা ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে কি? এই গোষ্ঠীই তো মোহাম্মদপুরে মসজিদে পুলিশ জবাই করেছিল। তারা কি অমিত শক্তিশালী? আমার তা মনে হয় না। ছাগল নড়ে খুঁটির জোরে।
এটা নিয়ে আগেও বলেছি, আবারও বলি: যুদ্ধাপরাধীদের সত্যিকারভাবে শাস্তি দেয়ার জন্যও যেমন সেনাপ্রধান উক্তি প্রদান করেন নাই তেমনি নারীদের অধিকার দেয়ার জন্যও নারী নীতির পয়দা হয়নি। এগুলো হলো একটি বড় সংঘাতের মালমশলা। যদি প্রয়োজন পড়ে, তাহলে উভয় পরে হারে রে রে'র ভলিউম বাড়িয়ে দিলেই কাণ্ড যা ঘটার ঘটা শুরু হবে। চাইকি একে উসিলা করে ইলেকশন রদ হওয়াও বিচিত্র নয়!
এই সরকার এসে দুটি শক্তির কেশটিও স্পর্শ করে নাই। একটি এনজিও তথা সিভিল সোসাইটি অন্যটি ডানপন্থি ইসলামী গোষ্ঠী। এর কারণ হিসাবে আমার মনে হয়, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমর্থনহীন এই মসনদের ভেতর যে পাকপন্থি (পাকিস্তান-সৌদি আরব-আমেরিকা) কানেকশন রয়েছে, তারা ইসলামওয়ালাদের মজুদ শক্তি হিসাবে ব্যবহার করে সরকারের ভেতর পশ্চিমাপন্থি (ভারত-ইইউ-ইউএসএ) অংশকে কাণঠাসা করতে চায়। আবার পশ্চিমাপন্থি এনজিও ও মুক্তিযুদ্ধওয়ালাদের ব্যবহার করে এদেরকে চাপে রাখতে চায় অপর কানেকশনের হোমড়াচোমড়ারা। প্রমাণ: কার্টুনকাণ্ডে হিজবুত তাহরীরকে মাঠে নামানো এবং আইন উপদেষ্টার দূতিয়ালি। এসব সবার জানা। তার সঙ্গে এবারে প্রথমে বায়তুল মোকাররমের বিক্ষোভ এবং চার উপদেষ্টার স্বউদ্যোগী হয়ে পুনর্বিবেচনা কমিটি করার ঘোষণা দেয়াকে মিলিয়ে দেখলেই চলে। প্রতিটি পদক্ষেপেরই ইঙ্গিত হচ্ছে, ''তোমাদের প্রতিবাদ আমলে নেয়া হচ্ছেÑ আগে বাড়ো''। তারা আগে বাড়ছে। নইলে নারী নীতিতে কী আছে তা জানার আগেই কীভাবে হুজুরেরা মাঠে নামার সুযোগ পায়! কেন তারা জরুরি অবস্থায়ও এত ছাড় পায়।
এর ফলে যা ঘটে তা হলো:
এক. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নারী নীতির বিরুদ্ধে তথাকিথত ইসলামী শক্তিকে দাঁড় করিয়ে দিলে একদিকে পশ্চিমাদের কাছে এই সরকার দেখাতে পারে মোল্লাদের জন্য পারছি না। কিন্তু কার্যত ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ অক্ষতই থাকে এবং আখেরে সরকারের রাজনৈতিক ভিত হিসাবে কাজে লাগে। ঠিক একই কাজ পাকিস্তানে মোশাররফ সরকার করেছিল। তারা এরকম একটি আপাত প্রগতিশীল নারী নীতি ঘোষণা করে মোল্লাদের প্রতিকুল পরিস্থিতিতে মাঠে নামার সুযোগ করে দেয়। একটা পর্যায়ে মোশাররফ সেই নীতি প্রত্যাহার করে আগের থেকেও পশ্চাদপদ জায়গায় বিষয়টিকে স্থাপন করে। বিনিময়ে মোল্লারা তাকে সমর্থন দেয়। রচিত হয় লাল মসজিদ পরিণতির পথ। বাংলাদেশেও কি তারই পুনরাভিনয় হচ্ছে না?
দুই. আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে তলে তলে যে ঐক্য গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ইস্যু আসার সঙ্গে সঙ্গেই তা ভেস্তে যায়। কারণ, বিএনপি জামাতকে ছাড়বে না আর এ অবস্থায় আওয়ামী লীগও স-জামাত বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে (১৯৯৬ সালের মতো) সরকারের বিরুদ্ধে জোট গঠনে ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে ভারতীয় জেনারেলদের সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সম্বর্ধনায় নিয়ে আসার মাধ্যমে জনগণের একাংশের কাছে হলেও এই আন্দোলন সন্দেহযুক্ত হয়ে যায়।
তিন. এভাবে যারাই এ সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত একে একে তাদের সবারই কাবু হয় :প্রথমে দুর্নীতির দায়ে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়িরা, পরে ছাত্র-শিক্ষকেরা এবং এখন পাশ্চাত্য এলিট বনাম ইসলামী এলিটের দ্বন্দ্বে এক ঢিলে উভয় তরফই।
চতুর্থত. আমি বিশ্বাস করি সরকারের ওপরের খোসার অনেক নীচে যে কোর রয়েছে, তাতে নিরন্তর একটা ক্ষমতার প্রতিযোগিতা চলছে। একটা ভারত-মার্কিনপন্থি আরেকটা পাকিস্তান-মার্কিনপন্থি। এরা একে অপরকে কোণঠাসা করার জন্য গণআন্দোলন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন) ও গোষ্ঠীগত আন্দোলনকে (নারী-নীতির বিরুদ্ধে) ব্যবহার করে নিচ্ছে।
চার. জামায়াত হুজুরদের এ আন্দোলনে প্রকাশ্যে না থাকার কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের গুড বুকে নিজেদের মডারেট ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী খেতাব অক্ষত রাখা। আবার সেকুল্যারদের ক্ষমতাবৃদ্ধির সময় গোটা ইসলামী রাজনীতিকে নের্তৃত্ব দেয়ার সুবাদে সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করা।
এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম বনাম সেকুল্যারিজম, সৌদি-পাকিস্তান মদদপুষ্ট আরবি শিক্ষিত এলিট বনাম পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট ইংরেজি শিক্ষিত এলিটদের মধ্যে দ্বন্দ্ব পাকিয়ে উঠবে। প্রতিটি মুসলিম দেশেই এই কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। এটাই তাদের এখনকার ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি। ইসলামপন্থিরাও একে সুযোগ মনে করছে। কারণ এভাবে তারা জনগণের সামনে নিজেদের 'খ্রীস্টান' পাশ্চাত্যের প্রতিপক্ষের স্বীকৃতি নিচ্ছে এবং দেশের রাজনীতিতে আগে যেটা ছিল সফট ডান আর সফট সেকুলারের প্রতিযোগিতা, তা হয়ে উঠছে ইসলামী র্যাডিকাল ও সেক্যুলার র্যাডিকালদের দ্বন্দ্ব। কিন্তু এগুলো কি দেশের প্রকৃত ইস্যু?
দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। ইলেকশন নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। বিশ্বব্যাংক এখন কৃষিতে কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের প্রেসক্রিপশন লিখছে। সেনা-অর্থনীতি ছড়িয়ে পড়ছে। বিদেশী কূটনীতিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্ঘাত চালাচ্ছে। কয়লা-গ্যাস-বন্দর-ট্রানজিট নিয়ে হরিলুটের আয়োজন তলে তলে পাকা হচ্ছে। লুটেরা রাজনীতিবিদ কিংবা ডোনার নির্ভর সিভিল সোসাইটি কিংবা বিশ্বায়নের সুবিধা নিয়ে পুঁজি ও প্রতিষ্ঠানে নিরন্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট কেউই এসব নিয়ে চিন্তিত নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা এসবেরই সুবিধাভোগী ও সহায়ক।
এরই ফেরে পড়ে জেরবার হবে গরিব-মেহনতি মানুষ, কৃষক সমাজ এবং দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্ররা। ভেড়ার পালের মতো তাদের ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে সংঘাতের ময়দানে এবং তারা 'শহীদ' হবে। কিন্তু অক্ষত থাকবে আমিনী-নিজামীদের বেহেশতি মসনদ। এরা আরব গেরিলাদের সমগোত্রীয় নয়, এরা সৌদি রাজতন্ত্র আর মার্কিন পুঁজিতন্ত্রের সহযোগী। এদের সঙ্গে হিজবুল্লাহ ও হামাসের প্রতিরোধের গণতান্ত্রিকতার কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু বাংলাদেশেই কেউ কেউ আরবের প্রতিরোধ দেখিয়ে বাংলাদেশের কায়েমী স্বার্থের সেবক ইসলামপন্থিদের জায়েজ করতে চান। এর ফল অতি মারাত্মক। যারা তা করেন তাদের একটা বিষয় পরিষ্কার করতে হবে যে, বাংলাদেশে পরিচিত প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তি কী অর্থে জনগণের স্বার্থের পক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে? কবে তারা সেই বিরোধিতা অর্থপূর্ণভাবে করেছেন। যারা নিজ ধর্ম ও নিজ জাতির বিরাট একটি অংশকে শরিয়ার নামে নিজেদের মনগড়া সামন্তীয় নিগড়ে বন্দি রাখতে চায় তারা কীভাবে এই জনগণকে সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত করবে? আমরা পড়েছি উভসঙ্কটে। একদিকে লুটেরা বহুজাতিক পুঁজি ও তার সামরিকায়ন আরেকদিকে 'নিপীড়তের দীর্ঘশ্বাস' হয়ে ওঠার ছলে নিপীড়িতকে আরো চেপে ধরার ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। একদিকে নারীকে পণ্যের বাজারে আরো বেশি করে প্রবেশ করানোর এনজিওদের নারী নীতি আরেকদিকে সামন্তীয় বিধিবিধানের খাঁচা। প্রথমটার থেকে দ্বিতীয়টা হয়তো 'প্রগতি' কিন্তু বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তা প্রগতির নামে নয়, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের ফন্দি। ধর্মের নামে ক্ষমতা অর্জনের ফন্দিফিকিরের থেকে মিথ্যা প্রগতির ছল কম ধ্বংসাত্মক নয়!
অন্যদিকে বাংলাদেশে গরিব মাদ্রাসা ছাত্রদের যে অংশ ভোগ বেসাতি মুনাফা ও মার্কিন-ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়রে আশায় টুপিওয়ালা গডফাদারদের পেছনে জমায়েত হয়, তারাও রাজনৈতিকভাবে 'আত্মঘাতী' হওয়ারই (অর্থাত নিজ জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার) পথ নেয়। এ প্রবণতাকে আতর তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা চলে।
মিলটা প্রতীকী কিন্তু তাতপর্যহীন নয়। সিলেটের পাহাড়ে এখনো আতরের চাষ হয়। স্থানীয়রা ওইসব পাহাড়কে আতর পাহাড় বলে ডাকেন। আতর পাহাড়ে সারি সারি আতর গাছ। বয়স্ক গাছে দা দিয়ে কুপিয়ে রেখে দিলে সেখান থেকে রক্তের মতো ঘনরস পড়ে। গাছের সেই রক্ত বা রস থেকেই পরে তৈরি হয় সুবাসিত আতর_ পবিত্র ও সুন্দর। ঠিক তেমনি সাম্রাজ্যের আঘাতে তার শরীরের রক্তরণ থেকে জন্মায় পবিত্র ও সুন্দর এক স্বাধীনতা স্পৃহা। তা আতরের মতো সুবাসিত করে দেশ ও মাটিকে। আবার ধর্মের নামে তারা নিজ সমাজের মজলুমেরও রক্তরণ ঘটায়। তা থেকে জন্ম নেয়া আতঙ্ক মৃত্যুর মতো। মৃতের একমাত্র প্রসাধনও কিন্তু সেই বেহেশতি আতর।
আজকের মুসলিম সমাজের লড়াই যেদিন ওই আতর পাহাড় থেকে নেমে আসবে, নিজ সমাজদেহকে পীড়ন করে ঐ 'আতর চাষ' বন্ধ করবে, সেদিনই তা পথ খুঁজে পাবে মুক্তির_নিজের ও বিশ্বের।