এন্থনি মাসকারেনহাস
দি টাইমস, ১৩ জুন, ১৯৭২ (?)।
এন্থনি মাসকারেনহাসকে গ্রানাডা টেলিভিশন (পত্রিকাগুলো এনামেই ডাকে) গত সপ্তাহে সাহসী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ পুরস্কার প্রদান করেছে। করাচির একটি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক এবং সানডে টাইমসের প্রতিনিধি মাসকারেনহাস পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি জানতেন তিনি যা দেখেছিলেন তা তার দেশে ছাপানোর অনুমতি পাওয়া যাবে না। তিনি ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে আসেন এবং সানডে টাইমসে যে রিপোর্ট লেখেন, তা পূর্ব পাকস্তানে কী হচ্ছে সে-সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা পাল্টে দেয়।
স্থান: কুমিল্লা সার্কিট হাউস, পূর্ব পাকিস্তান। তারিখ: এপ্রিল ১৯, ১৯৭১। সময়: সন্ধ্যা ৬.১৮। এটা হলো সেই মুহূর্ত যা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিল। কারফিউ ছয়টার সময়ে শেষ হয়েছে। কয়েক মিনিট আগে আমি সেবাস্টিয়ান এবং তার চারজন সহযোগীকে রাস্তা দিয়ে স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর আগার অফিসে আসতে দেখলাম। পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টরের পেছনে তারা আসলো, তাদের হাত ও পা একটি দড়িতে আলগা করে বাঁধা। তাদের পরনে যে-ইউনিফর্ম পরা ছিল তা নতুন বলেই মনে হলো।
আমি সেই সাব-ইন্সপেক্টরকে স্মরণ করতে পারি। সে-সকালে মেজর আগার অফিসে নারিকেলের দুধ খেতে খেতে তিনি লক-আপে আটকে রাখা বন্দিদের তালিকা দেখালেন। তিনি তার গ্লাস পাশে সরিয়ে রাখলেন। এরপর চারটি নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন। তিনি বললেন, “এই চারজনকে নিকেশ করার জন্য আনেন”। এরপর তিনি আবার তার তালিকার দিকে তাকালেন। আবার পেন্সিল দিয়ে খোঁচা দিলেন। “এবং এই চোরকে তাদের সঙ্গে আনেন”। আমাকে জানানো হলো ‘চোর’টি হলো সেবাস্টিয়ান নামের একজন যে তার হিন্দু বন্ধুর জিনিসপত্র নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার সময় ধরা পড়ে। এখন কারিফউয়ের পরে আমাকে জানতে হলো নিকেশ করার অর্থ কী। হঠাৎ আমি মারধরের শব্দ শুনলাম এবং এরপর চিৎকার শুনলাম। আরও জোর-আঘাতের শব্দ এবং আরও বিকট চিৎকার শুনলাম। আমি ব্যালকনির শেষ প্রান্তে ছুটে গেলাম কী হচ্ছে তা দেখার জন্য। যখন আপনি দেখবেন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সেই দৃশ্য এবং সেই শব্দ আপনি আপনার স্মৃতি থেকে কোনোদিনই মুছতে পারবেন না।
আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি চিৎকার করতে চাইলাম কিন্তু কোনো শব্দ মুখ থেকে বেরুলো না। তার পরিবর্তে আমি আমার মাথা ও বুকে বিরাট ভার অনুভব করলাম। অসহায়ভাবে আমি চারিদিকে তাকালাম সাহায্যের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে-গণহত্যা চালাচ্ছে, তার মুখোমুখি আমি এই প্রথম হলাম, তা নয়। কিন্তু এই প্রথম আমি এতো নিষ্ঠুর কিছু দেখলাম। আমি জানালার পাশের একটি নিচু চেয়ারে বসে পড়লাম এবং মানুষগুলোর চিৎকারের দৃশ্য আর দেখতে চাচ্ছিলাম না। এরপর বিষণœœভাবে দেখলাম লেক পার হয়ে অনেকগুলো বাদুড় আমার জানালার দিকে আসছে। তাদের দেখতে ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছিল, কিন্তু তারা আসলে খাদ্যসন্ধানী ‘উড়ন্ত শৃগাল’। মনে পড়ে, আমি নিজেকে বললাম, “সত্যিকারের ভ্যাম্পায়াররা তো নিচের তলায়”।
আমি হিটলার সম্পর্কে যা কিছু পড়েছি, তার চাইতে ভয়াবহ কিছু প্রত্যক্ষ করলাম― এবং আমাদের নিজেদের মধ্যেই এসব ঘটছিল। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন, এই সত্য আমি সবাইকে জানাবো। কিন্তু আমি যা দেখলাম তা হলো, অন্য সৈন্যরা বন্দুক হাতে পুরো ঘটনাবলী দেখছিল এবং অন্যরা নিরবে রাতের খাবার তৈরি করছিল। আমি জানতাম কোনো আশাই কোথাও নেই। আমি হতাশ হয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম এবং খালি ব্যালকনির অপর প্রান্তে আমার রুমে ফিরে আসলাম। আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম রাতে জেগে জেগে ঠিক করালাম পরের দিন থেকে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে, যতটুকু সম্ভব দেখতে ও শুনতে হবে এবং বিস্তারিতভাবে আমার নিজস্ব সাঁটলিপি পদ্ধতিতে লিখে রাখতে হবে যাতে কেউ তা বুঝতে না পারে। এভাবে আমি হাজীগঞ্জের হত্যা ও পোড়ানোর দৃশ্য ও কোনো মানুষকে খুঁজে না পাওয়া, অফিসার্স মেসে ‘টপ স্কোর’-এর প্রতিযোগিতা, এবং ১৬ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে লক্ষ্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে আমাকে দেয়া সংজ্ঞা প্রভৃতি জিনিস লিপিবিদ্ধ করি।
আমি করাচিতে ২৫ এপ্রিল এসব নোট নিয়ে ফিরে যাই এবং বাড়ি পৌঁছি ভোর সাড়ে তিনটায়। সেদিন ছিল আমার স্ত্রীর জন্মদিন। সে তার কানের দুলের জন্য গোলাপী মুক্তো চেয়েছিল, কিন্তু আমি তার জন্য সে-উপহার না নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরলাম যা ছিল আমার পরিবারের জন্য বিরাট পরিবর্তনের একটা ব্যাপার। যতক্ষণ না পাচকটি এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি করল, স্ত্রী ইভন ও বড়ো দুই ছেলে অ্যালান ও কিথের সঙ্গে আলোচনা করলাম। আমি তাদের বললাম আমি কী দেখেছি এবং কী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইভন হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। এই সিদ্ধান্তের ফল কী হবে তা তার চাইতে আর কেইবা ভালো বুঝবে। এর ফলে আমাদের সবকিছু পরিত্যাগ করতে হবে, কারণ সামরিক শাসনের পরিস্থিতিতে আমরা কোনো সুযোগই পাবো না। এর অর্থ আমাদের মাথার ওপরের ছাদ, আয়, অর্জিত সম্পদ, সঞ্চয় দ্বারা ক্রয়কৃত বাড়ি করার জন্য জমি― কিছুই থাকবে না। একসময় কিথ বলল, “অবশ্যই আমরা তোমার সঙ্গে যাবো। তুমি অবশ্যই সবকিছু লিখবে”।
তারা সবাই আমার দিকে তাকালো, সম্ভবত প্রথমবারের মতো আমার চোখে গভীর একাকীত্ব তারা দেখতে পেল। আমরা একসঙ্গে কেঁদে উঠলাম, পরস্পরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। এটা ছিল সামনের ভয়াবহ দিনগুলোর ও পরবর্তী মাসগুলোতে লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করার পারস্পরিক আশ্বাস। আমাদের গোপন সিদ্ধান্তের কথা অন্য কেউ জানতো না। আমরা আমাদের আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব কাউকেই এর মধ্যে জড়াতে চাইনি, বলা যায়, এভাবে বিপদকে এড়াতেই চেয়েছি। আমি লন্ডনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এটা দেখতে যে সানডে টাইমস সংবাদটি ছাপে কি না। অভিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে আমার বিশ্বাস ছিল যে, একজন পৃথিবীর সেরা সংবাদকাহিনী নিয়ে ফ্লিট-স্ট্রিটের ভবনগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ছাপানোর জন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না, তা হতে পারে না। এরপর আমি পত্রিকার জন্য লেখা শুরু করলাম।
সানডে টাইমসের আমার কথা শুনল, সবকিছু গ্রহণ করল এবং আমি থমসন হাউসে প্রবেশ করার চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আমি পাকিস্তানে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হলাম। সংবাদকাহিনীটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গৃহীত হয় এবং সেখানে সাংবাদিকসুলভ সেই প্রবৃত্তি ও সততার পরিচয় পেয়ে এখন পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে রয়েছি।
পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আসাটাই তখন বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। বহিরাগমণের অনুমতি নিতে হবে। যত নিরবে পারলাম, গুছিয়ে নিলাম। কারণ গোপনীয়তা রক্ষা করতেই হবে। সৌভাগ্যক্রমে আমি লন্ডন থেকে হোটেলের কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলাম। আমি সেটা ব্যবহার করে তার ওপরে মিলান-প্রবাসী আমার স্ত্রীর একমাত্র ভাইয়ের (যিনি একজন বিখ্যাত ফ্যাশনডিজাইনার) পক্ষ থেকে তার বিয়েতে সপরিবারে যাবার আমন্ত্রণপত্র লিখলাম, তাতে তার ভাইয়ের সইও দিলাম। পুরো পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণবিষয়ক কাগজপত্র সেই চিঠির মাধ্যমে পাওয়া গেল। বাইরে থেকে এইমাত্র ঘুরে আসার কারণে আমি সেই ‘বিবাহঅনুষ্ঠান’-এ যেতে অস্বীকৃতি জানালাম।
এরপর আমি সানডে টাইমসে একটি টেলিগ্রাম পাঠালাম: “রফতানির প্রক্রিয়া সমাপ্ত। সোমবারে শিপমেন্ট শুরু হচ্ছে”। সেমতে ৭ জুন, সোমবারে আমি আমার পরিবারকে রোমগামী প্যান-আমেরিকান ফ্লাইটে তুলে দিলাম এবং নিজে লাহোর ও রাওয়ালাপিন্ডিগামী অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে রওয়ানা দিলাম। আমি সেখান থেকে আফগানিস্তানের পেশওয়ার বা কাবুলগামী বিমান ধরার জন্য এই রুটের আশ্রয় নিলাম কারণ উভয় দেশের ঐ দু’টি করে স্থানে পাকিস্তানি ও আফগানদের জন্য যাওয়া-আসা উম্মুক্ত ছিল। এটা একটা দুঃস্বপ্নের যাত্রা ছিল। বিমানে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন যারা আমাকে ভালোভাবে চিনতেন। তারা যদি সামন্যতম সন্দেহও করতেন তবে আমি গ্রেফতার হতাম। আমি কোনোক্রমে তাদের সঙ্গে আলাপ করে গেলাম এবং প্রতিশ্র“তি দিলাম তাদের সঙ্গে পরের দিন লাঞ্চ করব। রাওয়ালাপিন্ডিতে গিয়ে দেখলাম পেশওয়ারের ফ্লাইট পুরোপুরি বুকড্ হয়ে গেছে। সে-পর্যায়ে আমি যদি ধরা পড়তাম তবে সব ভেস্তে যেত। ফিরে আসার কোনো উপায় ছিল না।
সুতরাং আমি ঠিক করেছিলাম আমাকে বলিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতে হবে এবং সেখানে একজন আকর্ষণীয় পাঞ্জাবী তরুণী সাহায্য করেছিল। সে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে বসে ছিল এবং আমাকে দেখছিল। একজন বিমান কর্মকর্তার হাতে একশ’ রুপির একটি নোট গুঁজে দিয়ে মেয়েটির দিকে ইশারা করে চোখ টিপে গোপনভঙ্গীতে বললাম, “আমার একটি সিট দরকার। আমি মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে কিছু মজা করার জন্য কাবুলে যাচ্ছি।” এধরনের কাজ করা থেকে পৃথিবীর কেউই আমাকে আটকে রাখতে পারত না। আমি নিশ্চিত আর কোনো কায়দাই কাজে আসতো না। কর্মকর্তাটি আরেকজন লোককে চোরাচালানের সন্দেহে আটকে দিল এবং আমার জন্য একটি সিট যোগাড় করে দিল। আমার উষ্ণভাবে করমর্দন করলাম এবং পেশওয়ার ও কাবুল হয়ে সানডে টাইমসে আমার দেয়া সময় রক্ষা করতে রওয়ানা হলাম। যে-অচেনা মেয়েটি আমার জীবন রক্ষা করল তাকে ধন্যবাদ দেবার কোনো সুযোগ আমি পাই নি। সে আরেকজন মহিলার সঙ্গে সামনের দিকে বসেছিল। কিন্তু যখন আমরা আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করলাম তখন তার উদ্দেশ্যে মনে মনে শ্যাম্পেন দিয়ে উইশ করলাম।