১৩ জুন, ১৯৭১
পাঁচ মিলিয়ন লোক বাস্তুভিটা ছেড়ে কেন পালিয়ে গেছে সে মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে পাকিস্তান থেকে এসেছেন সানডে টাইমসের রিপোর্টার।
মার্চের শেষ থেকে পাকাসেনারা পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে চলেছে। মার্চের শেষ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংবাদ-ধামাচাপা-দেয়ার পেছনের মর্মান্তিক কাহিনী হলো এই। কলেরা আর দুর্ভিক্ষ নিয়েও ৫০ লক্ষ লোকের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতে চলে আসার এই হলো কারণ।
সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এই প্রথামবারের মতো নিরবতার পর্দা উন্মোচন করলেন। তিনি সেখানে পাকসেনাদের কীর্তিকলাপ দেখেছেন। তিনি পাকিস্তান ছেড়ে এসেছেন বিশ্ববাসীকে সেসব জানানোর জন্য। সেনাবাহিনী শুধু স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ ধারণার সমর্থকদেরই হত্যা করছে না। স্বেচ্ছাকৃতভাবে খুন করা হচ্ছে হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান সবাইকে। হিন্দুদের গুলি করে বা পিটিয়ে মারা হচ্ছে তারা কেবল হিন্দু বলেই। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টের পেছনেও রয়েছে একটি দারুণ গল্প।
মার্চের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে দুই ডিভিশন পাকসেনা গোপনে পাঠানো হয় বিদ্রোহীদের 'খুঁজে বের করা'র জন্য। কিন্তু দু-সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার আটজন পাকিস্তানী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানায় পূর্ব পাকিস্তানে উড়ে যাবার জন্য। সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সাংবাদিকদের প্রভাবিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এই ধারণা দেয়াই এর উদ্দেশ্য ছিল যে, দেশের পূর্বাংশে 'সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে'। সাতজন সাংবাদিক তাদের কথামতো কাজ করেছেন। কিন্তু তা করেননি একজন -- তিনি হলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও সানডে টাইমসের পাকিস্তান-প্রতিনিধি অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস।
১৮ মে মঙ্গলবার তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির হন লন্ডস্থ দি সানডে টাইমসের কার্যালয়ে। আমাদের জানালেন, পূর্ব বাংলা ছেড়ে ৫০ লক্ষ লোককে কেন চলে যেতে হয়েছে তার পেছনের কাহিনী। তিনি সোজাসাপ্টভাবে জানালেন এই কাহিনী। এই কাহিনী লেখার পর তার পক্ষে আর করাচি ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি জানালেন তিনি পাকিস্তানে আর ফিরে না-যাবার ব্যাপারে মনস্থির করেছেন; এজন্য তাকে তার বাড়ি, তার সম্পত্তি, এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্মানীয় একজন সাংবাদিকের মর্যাদার মায়া ত্যাগ করতে হবে। তার মাত্র একটি শর্ত ছিল: পাকিস্তানে গিয়ে তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা যেন তার রিপোর্ট প্রকাশ না করি।
সানডে টাইমস রাজি হয় এবং তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। দশ দিন অপেক্ষা করার পর সানডে টাইমসের এক নির্বাহীর ব্যক্তিগত ঠিকানায় একটি বৈদেশিক তারবার্তা আসে। তাতে লেখা ছিল, 'আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন, সোমবার জাহাজ ছাড়বে।' দেশত্যাগ করার ব্যাপারে স্ত্রী ও সন্তানদের অনুমতি পেতে ম্যাসকারেনহাস সফল হন। তার দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে তিনি কোনোরকমে একটা রাস্তা পেয়ে যান। পাকিস্তানের ভেতরে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তিনি প্লেনে একজন তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকে দেখতে পান যাকে তিনি ভালোমতোই চিনতেন। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ফোনকল তাকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে কোনো ফোনকল হয়নি এবং তিনি মঙ্গলবার লন্ডনে এসে পৌঁছান।
পূর্ব পাকিস্তানে ম্যাসকারেনহাস বিশেষ কর্তৃত্ব ও নিরপেক্ষতা সহকারে যা দেখেছেন তা লিখেছেন। তিনি গোয়ার একজন ভদ্র খ্রিস্টান, তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনোটাই নন। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন পাকিস্তানে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের উদ্ভবের পর থেকেই তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী। তখন থেকে তিনি পাকিস্তানের অনেক নেতার আস্থা অর্জন করেছেন এবং এই রিপোর্ট লিখছেন সত্যিকারের ব্যক্তিগত দুঃখবোধ থেকে।
তিনি আমাদের কাছে বলেন, 'তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের জানান সেনাবাহিনী যে বিরাট দেশপ্রেমের কাজ করছে, ব্যাপারটা সেভাবে উপস্থাপন করতে।' তিনি তার প্রতিবেদনের জন্য যা দেখেছেন এবং রিপোর্ট করেছেন সে-সম্পর্কে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না । তাকে একটি রিপোর্ট লেখার অনুমতি দেয়া হয় যা সানডে টাইমসে ২ মে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টটিতে কেবল মার্চ ২৫/২৬-এর ঘটনার বিবরণ ছিল, যখন বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনকি দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার প্রসঙ্গ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ সেন্সর করেছিল। এ-ব্যাপারটিই তার নীতিবোধকে পীড়া দিচ্ছিল। কিছুদিন পরে, তার ভাষায়, তিনি স্থির করলেন যে, "হয় যা দেখেছি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখবো, নয়তো লেখাই বন্ধ করে দেবো; নইলে সততার সঙ্গে আর লেখা যাবে না।" তাই তিনি প্লেনে চেপেছেন এবং লন্ডন চলে এসেছেন।
পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থী ও নিরপেক্ষ কূটনীতিবিদদের মধ্যে যাদের এসব ঘটনা সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা রয়েছে তাদের দ্বারা তার প্রতিবেদন আমরা বিস্তৃতভাবে যাচাই করতে সমর্থ হয়েছি।
...
শরণার্থীরা কেন পালিয়েছে: সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যাবার
পরের বিভীষিকার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
আবদুল বারী ভাগ্যের ভরসায় দৌড় দিয়েছিল। পূর্ব বাংলার আরো হাজার মানুষের মতো সেও একটা ভুল করে ফেলেছিলো -- সাংঘাতিক ভুল --ও দৌড়াচ্ছিলো পাকসেনাদের একটি টহল-সেনাদলের দৃষ্টিসীমার মধ্যে। পাকসেনারা ঘিরে দাঁড়িয়েছে এই চব্বিশ বছরের সামান্য লোককে। নিশ্চিত গুলির মুখে সে থরথরিয়ে কাঁপে। "কেউ যখন দৌড়ে পালায় তাকে আমরা সাধারণত খুন করে ফেলি", ৯ম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনস-এর মেজর রাঠোর আমাকে মজা করে বলেন। কুমিল্লার বিশ মাইল দক্ষিণে মুজাফরগঞ্জ নামে ছোট্ট একটা গ্রামে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। "ওকে আমরা চেক করছি কেবল আপনার খাতিরে। আপনি এখানে নতুন এসেছেন, এছাড়া আপনার পেটের পীড়া রয়েছে।"
"ওকে খুন করতে কেন?" উদ্বেগের সঙ্গে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
"কারণ হয় ও হিন্দু, নয়তো বিদ্রোহী, মনে হয় ছাত্র কিংবা আওয়ামী লীগার । ওদের যে খুজছি তা ওরা ভালমতো জানে এবং দৌড়ের মাধ্যমে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে।"
"কিন্তু তুমি ওদের খুন করছো কেন? হিন্দুদেরই বা খুঁজছ কেন?" আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম । রাঠোর তীব্র কন্ঠে বলেন: "আমি তোমাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে চাই, তারা পাকিস্তান ধ্বংস করার কী রকম চেষ্টা করেছে। এখন যুদ্ধের সুযোগে ওদের শেষ করে দেয়ার চমৎকার সুযোগ পেয়েছি।"
"অবশ্য," তিনি তাড়াতাড়ি যোগ করেন, "আমরা শুধু হিন্দুদেরই মারছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ নই। তারা আমাদের রমণী ও শিশুদের খুন করেছে।"
পূর্ব বাংলার শ্যামল ভূমির ওপর ছড়িয়ে দেয়া রক্তের কলঙ্কচিহ্নগুলি আমার চেখে একে একে ধরা পড়ছিল। প্রথমে ব্যাপারটা ছিল বাঙালিদের প্রতি বন্য আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অবাঙালিদের হত্যা। এখন এই গণহত্যা ঘটানো হচ্ছে পাকসেনাদের দ্বারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এই সুসংগঠিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হিন্দুরাই শুধু নয়, যারা সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার ১০ শতাংশ, বরং হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানরাও। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যসহ সবাই এর মধ্যে রয়েছে। এমন কি ১৭৬,০০০ জন বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ যারা ২৬শে মার্চে অসময়োপযোগী ও দুর্বল-সূচনার একটা বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে চেয়েছিল, এর ভেতরে তারাও আছে।
এপ্রিলের শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় দশদিনে চোখ আর কানে অবিশ্বাস্য যকিছু আমি দেখেছি ও শুনেছি তাতে এটা ভয়াবহভাবে পরিষ্কার যে এই হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বিচ্ছিন্ন কোনো কার্যকলাপ নয়। পাক সেনাদের দ্বারা বাঙালিদের হত্যাকাণ্ডই অবশ্য একমাত্র সত্য নয়। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরাই একমাত্র হত্যাকারী ছিল না, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্য ও প্যারামিলিটিারির সদস্যদের বন্য আক্রোশের শিকার হয়েছে অবাঙালিরা। কর্তৃপক্ষের সেন্সর আমাকে এই তথ্য জানানোর সুযোগ দিয়েছে। হাজার হাজার অভাগা মুসলিম পরিবার, যাদের অধিকাংশই ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের সময় বিহার থেকে শরণার্থী হিশেবে পাকিস্তানে এসেছিল, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রমণীরা ধর্ষিত হয়েছে, বিশেষ ধরনের ছুরি দিয়ে কেটে নেয়া হয়েছে তাদের স্তন। এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রক্ষা পায়নি। ভাগ্যবানরা বাবা-মার সঙ্গেই মারা গেছে; কিন্তু চোখ উপড়ে ফেলা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়ে নেয়া হাজার হাজার শিশুর সামনে ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের মতো শহরগুলো থেকে ২০,০০০-এরও বেশি অবাঙালির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নিহতদের সত্যিকারের পরিমাণ, পূর্ব বাংলার সর্বত্র আমি শুনেছি ১০০,০০০-এর মতো হতে পারে; কারণ হাজার হাজার মৃতদেহের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পাক-সরকার ওই প্রথম ভয়াবহতা সম্পর্কে পৃথিবীকে জানতে দিয়েছে। কিন্তু যা প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি তা হলো, তাদের নিজেদের সেনাবহিনী যে-হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা ছিল দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড। পাক-কর্মকর্তারা উভয় পক্ষ মিলিয়ে নিহতদের সংখ্যা ২৫০,০০০-এর মতো বলে গণনা করেছে -- এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ এবং মহামারিতে মৃতদের ধরা হয়নি। দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশে সফল ধ্বংসকাণ্ড চালানোর মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান-সমস্যাকে তার নিজস্ব 'চরম সমাধানের' দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
[চলবে]
ছবির লিঙ্ক: http://www.genocidebangladesh.org/?page_id=12