somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কীসের জন্য তারা পালিয়ে গেল?: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ২৯

১৬ ই জুন, ২০০৮ রাত ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কলকাতা থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট
দি ইকোনমিস্ট, ১২ জুন, ১৯৭১

'আমাদের জনসংযোগের যন্ত্র প্রস্তুত ছিল না। আমাদের সেনাবাহিনীর জনসংযোগ-কর্মকর্তারা ২৫ ও ২৬ মার্চে ঢাকায় ছিলেন না, এবং আমরা অবশ্যই সেখানে বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা ভুল করেছিলাম।' একজন সিনিয়র পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিক এভাবে স্বীকার করলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে তার সরকার যেভাবে মোকাবেলা করেছে তা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে কী এমন ঘটেছে যে পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এবং দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর ৫০ লক্ষ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো?

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ২৫ মার্চের রাতে অভিযান চালিয়ে গুলিবর্ষণ করে ও ঢাকার একাংশ ধ্বংস করে ফেলে এবং পরের ছয় মাসে পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ অংশে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এর ফলে লাখ লাখ উদ্বাস্তু সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর মতে মার্চে আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারীরা ( এরা পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সবসময় ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) বাঙালিদের দ্বারা নিগৃহীত হতো। আর সেনাবাহিনীর সেদিনের দ্রুত পদক্ষেপ সবকিছু রক্ষা করে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সদস্য এবং পুলিশ ও আধা সামরিক সীমান্তরক্ষীরা সেদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা ভারতে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তারা স্বীকার করেছেন বেশ কিছু পাঞ্জাবী ও বিহারী নিহত হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। কী ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝার আগেই অনেক সৈন্য ও পুলিশকে ধরা হয়েছিল, অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে তার বাসভবন থেকে ধরা হয়েছিল এবং তারা দলের নেতাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, কেউ অল্পের জন্য পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সহিংসতা দুই দিক থেকেই হয়েছিল, এবিষয়ে অল্প হলেও সন্দেহ আছে। কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু (এবং খ্রিস্টান), শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উদ্বাস্তুর ঢল দেখে বোঝা যায়, জনগোষ্ঠীর প্রধান কেন্দ্রগুলোত নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য যা করা প্রয়োজন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার চাইতে বেশি কিছু করেছে।

সেনাবাহিনী কী করেছে? প্রতিটি অভিযানের পর দেখা গেছে গ্রামগুলো পুড়ে ছাই হয়েছে এবং মানুষগুলো মরেছে। একটি ব্যাখ্যা এরকম আছে যে, মাত্র ৭০,০০০ সৈন্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার পুরো পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে এধরনের সহিংসতার পথই নিতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য এধরনের নীতি ক্ষতিকর। কারণ রাজনৈতিক সমাধান অস্ত্রের শক্তির ওপর নির্ভর করে না, এখানে মানুষের গণহারে দেশত্যাগের ব্যাপারও রয়েছে। কিছু শিক্ষিত উদ্বাস্তু ব্যাখ্যা দিলেন, 'সৈন্যদের গুলি করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অফিসাররা তাদের বলে যে এটা একটা ধর্মযুদ্ধ। তারা বলেছে যে ইসলামী রাষ্ট্রটি হিন্দু, আওয়ামী লীগ নেতা ও বুদ্ধিজীবিদের কারণে হুমকির সম্মুখিন।'

মৃত, ধৃত অথবা পলাতক বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও আওয়ামী নেতাদের হিন্দু দেখতে পেলে সেনাবাহিনী খুশি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি জনগোষ্ঠীর এক কোটি হিন্দু এবং এরা গণহারে সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু কেবল সেনাবাহিনীই হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়েছে তা নয়। বিহারী ও ডানপন্থী মুসলিম লীগারদের নিয়ে সম্প্রতি গ্রামে গ্রামে গঠিত তথাকথিত শান্তিকমিটির সদস্যরাও হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে, লুট করেছে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

সীমান্তাঞ্চলে যে যে স্থানে সেনাবাহিনীর শক্তি বেশি এবং যে যে স্থানে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান চালিয়েছে সেখানকার লোকজনের সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে যাবার হার বেশি। প্রথমে এই পালিয়ে যাবার হার ছিল মোটামুটিভাবে অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। কিন্তু মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, হিন্দুদের পালিয়ে যাবার হার তখন অনেক বেড়ে যায়। ভারতের যেসব রাজ্যে তারা বেশি পরিমাণে যেতে থাকে, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা, সেসব রাজ্যে এই আশংকা কাজ করা শুরু হয় যে সীমান্তের ওপারে একজন হিন্দু থাকা পর্যন্ত এই প্রবাহ চলতে থাকবে। প্রথমে উদ্বাস্তুর সংখ্যা শুনে মনে হয়েছে রাজ্যগুলো কেন্দ্রের সাড়া দ্রুত পেতে হয়ত সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু জাতিসংঘের স্থানীয় সংস্থাগুলো ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এই সংখ্যাই যে সঠিক তা গুরুত্বাসহকারে বলেছে। বরং মোট সংখ্যার অর্ধেকরও বেশি ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে সহজে গণনা করা গেছে। বাকিদের সীমান্তে এবং খাবার বিতরণের স্থানে গণনা করা সম্ভব হয়েছে। গত সপ্তাহের মাঝামাঝি ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে সাম্প্রতিকতম মোট সংখ্যা হলো ৪৭ লক্ষ, যার মধ্যে ২৭ লক্ষ ক্যাম্পে অবস্থান করছে এবং বাকিরা বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করছে অথবা নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

ভারতের প্রাথমিক নীতি ছিল উদ্বাস্তুদের সীমান্তের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ রাখতে। এখন সেটা আর কার্যকর নেই। ত্রিপুরার জনসংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সীমান্ত এলাকায় বেড়ে গিয়েছে, যেসব উদ্বাস্তু ক্যাম্পে নেই তাদের কারণে শ্রমের মজুরি কমে গেছে। কিছু এলাকায়, যেমন পশ্চিমবঙ্গে, নতুন ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য খুব সামান্যই স্থান খালি আছে। সহিংসতার হুমকি প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে কারণ ভারতীয় সীমান্তাঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই হলো মুসলমান। ক্যাম্পগুলোর প্রশাসননিক সাফল্য ভালোই বলতে হবে, যেক্ষেত্রে সীমান্তঅঞ্চলগুলোতে কাজ করাটাই ম্যজিস্ট্রেটদের জন্য বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে এসেছে। কলেরা মাহামারি বাকি বিশ্বকে হতবাক করে দিলেও, অনেক বৈদেশিক সংস্থাই কলেরা প্রতিরোধের জন্য কয়েক সপ্তাহ যাবত কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভারতীয় সরকারের মে মাসের কেনাকাটার তালিকায় ২৫০,০০০টি তাঁবু ও ত্রিপল থাকলেও তাকে বাড়াতে হবে, যদিও কেউই জানে না কখন প্রকৃত দাবিকে স্পর্শ করা যাবে।

যদি ভারতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে থাকে, তবে পাকিস্তানে অবস্থা অবশ্যই তার চাইতেও খারাপ। এঅঞ্চলের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহর এবং গ্রামে জনগণের অসম চলাচল রয়েছে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত এখনও সারিয়ে তোলা হয়নি। যানবহনগুলোকে খাদ্য-পরিবহণের পরিবর্তে সৈন্য-পরিবহণের কাজে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক এলাকাতেই বর্ষা-পরবর্তী প্রধান ফসল ধানের বীজ বপন করা হয়নি। পাকিস্তান নীতিগতভাবে পূর্বাংশে জাতিসংঘের সাহায্য গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন। একজন কেবল এটাই আশা করতে পারে যে, প্রক্রিয়াটিতে যেন খুব বেশি দেরি না হয়।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০০৮ রাত ১১:০৫
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×