somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোগান্তির উদ্দেশ্যে যাত্রা: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ২৫

০৯ ই জুন, ২০০৮ সকাল ৮:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ বি ইউ
দি গার্ডিয়ান, ৫ জুন, ১৯৭১

গত সপ্তাহে যখন আমি আগরতলা-সার্কিট-হাউসে ছিলাম, রাতের বেলায় আমার বেডরুমের জানালা কেঁপে উঠত; কারণ প্রতি রাতে সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানি শেল বিস্ফোরিত হতো। আগরতলা হলো ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী, পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচটি জেলার সঙ্গে যে-রাজ্যটির সীমান্তরেখা আছে। দিনের বেলাতেও শেল বিস্ফোরন হতো যদিও তার সংখ্যা কম ছিল। সীমান্তে অবস্থানরত গেরিলাদের উদ্দেশ্যেই এই বোমা নিক্ষেপ করা হতো, কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, এসব এলাকার গ্রামবাসীদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য ভীতি-প্রদর্শনেও শেল ফাটানো হতো।

গত কয়েক দিনে যেহেতু সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য-সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা, পশ্চিম-বাংলা ও আসামে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্ব-বাংলা থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ শরণার্থী এখন ভারতে অবস্থান করছে। দু-মাস আগে ত্রিপুরার জনসংখ্যা ১৫ লক্ষ ছিল, বর্তমানে তার প্রায় অর্ধেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

আশ্রয়-শিবির

ত্রিপুরায় ৫০০,০০০-এরও বেশি নিবন্ধীকৃত উদ্বাস্তু রয়েছে, এছাড়া অনিবন্ধীকৃত প্রায় ১০০,০০০ শরণার্থী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে অবস্থান করছে। এ-পরিস্থিতিতে সাংঘাতিক খাদ্য-সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং উন্নয়ন-প্রকল্পসমূহের গতি মন্থর হয়ে গেছে। এক হিসেবে অর্ধেক শরণার্থীকে অস্থায়ী আশ্রয়-শিবির প্রদান করা হয়েছে। অনেক স্কুল ও মন্দির ক্যাম্পে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার লোককে চাটাই- ও খড়-নির্মিত কুঁড়েঘরে থাকতে হচ্ছে। ঘরগুলোকে দেখে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মনে হয়, কিন্তু ঝড়ে তা সহজেই উড়ে যেতে পারে। মধ্য-জুনে প্রবল বৃষ্টি হলে সেগুলো রা করা দায় হবে। হাজার হাজার পরিবার গাছতলায় ও খোলা জায়গায় অবস্থান করছে এবং সামনের সপ্তাহগুলোতে অনেক শিশু মারা যাবে।

আগরতলা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণে সাবরাম-এ ত্রিপুরার বৃহত্তম ক্যাম্পটি অবস্থিত। ২,০০০ জনসংখ্যার শহরটিতে এখন অধিবাসীর সংখ্যা পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। গত মাসে প্রায় ৮০,০০০ লোক সাবরাম হয়ে এসেছে। ক্যাম্প থেকে কয়েক হাজার গজ দূরে ফেনী নদী পূর্ব-বাংলার সঙ্গে সীমানা নির্দেশ করছে। ভারতীয় তীরে একটি ছইওয়ালা ছোট্ট নৌকা বাঁধা। একদল বাচ্চ-কাচ্চা নদীর অপর পাশটা দেখছিল। 'ঐযে!' একজন চিৎকার করে উঠল, 'ঐযে ওরা যায়'। দু-জন পাকিস্তানি অফিসার একসময়ের-ডাকঘর-বর্তমানের-সেনাবাহিনী-ক্যাম্পের চত্বরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। ওটা হলো রামগড় শহর। সেখানে অন্য কোনো শব্দ নেই। ডাকঘরের পেছনে বিস্তৃত খালি জায়গা। এরপর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলভবন ও অর্ধেক বিধ্বস্ত মসজিদ। কাছেই, অল্পকিছু ঘর-বাড়ি দেখা যায়।

কলকাতা থেকে ৬০ মাইল দূরে এবং ভারতীয় সীমানার দু-মাইল ভেতরে ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায়, যেখানে হাজার হাজার মা কোলে শিশু নিয়ে রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে, রান্না-বান্না করছে অথবা ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। দুর্ভাগ্য তাদের মুখমণ্ডলেই লেখা রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে লোকজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিদিনের ৪০০ গ্রাম চালের রেশনের জন্য। শরণার্থীদের বৃহৎ অংশই শিশু। অনাহারে শীর্ণ, নিরব, মনমরা বাচ্চাদের এক হৃদয়বিরাক দৃশ্য সেটা। এমন এক দুর্ভাগা জগতে তারা জন্ম নিয়েছে, যার জন্য তারা দায়ী নয়।

কিন্তু, বাচ্চারা আহত করলেও তাদের মুক্তিবাহিনীর বড়ো ভাইয়েরা সবাইকে উজ্জীবিত করে। সীমান্ত এলাকায় আগরতলা থেকে কয়েক মাইল দূরে আমি এক বনের প্রান্তে একটি মুক্তি ফৌজ ট্রেনিং-ক্যাম্পে এক ঘণ্টা কাটাই। লুঙ্গি ও শার্ট পরিহিতদের সশস্ত্র পাহারা পেরিয়ে আমাকে একটি কাঠের পুরনো ভবনের সামনে আনা হয়, যেখানে একজন তরুণের সঙ্গে দেখা হয়, যার বয়স বড়োজোর ১৮ বছর হবে। তিনি নিজেকে কমান্ডার হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি ঢাকার মিলিটারির একাডেমির একজন সাবেক ক্যাডেট। তিনি তার নেতৃত্বাধীন কিছু যোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন যারা সবাই ছাত্র-বয়েসী, এবং শার্ট-লুঙ্গি পরিহিত। তাদের একজন রাইফেলের স্তূপ পাহারা দিচ্ছে। কমান্ডার যোদ্ধাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রতিদিনের যুদ্ধের কথা বলছিলেন। তিনি বিজয়ের ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী। কমান্ডার বললেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক জোর প্রচণ্ড'। তিনি বারবার একথা বললেন। যখন আমি ড্রয়িংটা শেষ করলাম, তিনি এসে তা দেখলেন। (এই রিপোর্টের সঙ্গে একটি স্কেচ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়) 'তাকে সন্ত্রস্ত দেখাবেন না', কমান্ডার বললেন। 'তার চোখে আপনি অবশ্যই সাহসের চিহ্ন দেখাবেন। আমাদের মনের জোর খুবই বেশি'। ছেলেটাকে যেমন দেখাচ্ছিল, আমি তেমনই এঁকেছি। মনে হয় সে তার মায়ের কথা ভাবছিল।

ছবির লিঙ্ক: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০০৮ সকাল ৮:৩৮
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে না!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৮


বেশ কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ করার জন্য সমাজের একটি বৃহৎ অংশ দাবী জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি কে অনেকে দায়ী করছে কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫

মুসলিম
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়ে এখন সে মুসলিম
বৌদ্ধ ঘরে জন্ম নিয়ে এখন সে মুসলিম
খ্রিস্টান ঘরে জন্ম নিয়ে এখন সে মুসলিম
ইহুদি ঘরে জন্ম নিয়ে এখন সে মুসলিম
মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পকে আধুনিকায়নের চেষ্টা

লিখেছেন জটিল ভাই, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

বনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:১৩

বর্তমান সময়ের রাজনীতি নিয়ে আমার আমার পর্যবেক্ষণ সমুহঃ
১। শেখ হাসিনা এখন হুমকি ধামকি না দিয়ে হাল্কা পাতলা কান্না কাটি করলে এবং দুঃখ প্রকাশ করলে আওয়ামী লীগের উপকার হত।
২।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এবং খালেদা জিয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:২৬






২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার পর ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথম তিনি জনসমক্ষে উপস্থিত হলেন এবং রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। শেষবার তিনি ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×