somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পূর্ব-পাকিস্তানের অপরাধীদের ও ধ্বংসযজ্ঞের ওপর গোপন ক্যাটালগ: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ২৪

০৮ ই জুন, ২০০৮ সকাল ৮:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট
দি টাইমস্, ৪ জুন, ১৯৭১।

মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক সমস্যাযুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গৃহযদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ও রোগবালাই দেখা দিয়েছে এবং যেকোনো সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হবার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো, বর্তমান অবস্থা থেকে পরিস্থিতির কেবল অবনতিই হতে পারে। বিশ্বনেতারা অবশ্যই আন্তরিকতার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন কীভাবে পূর্ব বাঙালিরা এবং পশ্চিম পাকিস্তানীরা একটি 'রাজনৈতিক সমাধান'-এ পৌঁছতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান-ঘটনাবলীর একজন সবচাইতে উদাসীন ছাত্রও জানেন রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারটি এখন প্রশ্নাতীত একটা ব্যাপার।

সামনের মাসগুলোয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে এবং বিশ্বের রাজধানীগুলোতে মানুষের তৈরি এই ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেয়া যাবে তা নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলবে। কিন্তু এই যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির জন্য যেসকল ইস্যু রয়েছে সেগুলো 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' ও 'গণহত্যা' এবং অন্যান্য অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কারণে আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে; এবং এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানী কোনো নেতার দিকে যদি কেউ অভিযোগের অঙ্গুলি তোলেন তবে, বলা যায়, তিনি ঠিক কাজটিই করবেন।

প্রসঙ্গত ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসের কথা তোলা যায়, যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এবং একটি নির্বাচিত সাংবিধানিক সংসদের লোভ দেখিয়ে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। সংবিধান-প্রস্তুতের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার জন্য এবং পশ্চিম-পাকিস্তানীদের (যারা এক-পাকিস্তানে বিশ্বাস করে ও পূর্ব-পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারণে যা বিপজ্জনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল) ভয় কমাতে, এর আগে প্রেসিডেন্ট একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) জারি করেছিলেন যা তাকে সংবিধান অনুমোদন বা বাতিল করার ক্ষমতা দিয়েছিল।

ইতোমধ্যে এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি মি. ভুট্টো সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবির্ভুত হবেন এবং অগ্নিগর্ভ পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান ইতোমধ্যে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন তুমুলভাবে চলছে তখন রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, উভয় নেতাই নিজ নিজ প্রদেশে তাদের মাথা খাটানো শুরু করেন এবং পাকিস্তানীরা সামনের দিকে চেয়ে গণতন্ত্রের প্রথম স্বাদ পাবার অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু যখন দুই নেতা তাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেন, এটা দ্রুত পরিস্কার হয়ে গেল যে তারা কঠোর ও বিপরীত দুই অবস্থান থেকে কথা বলছেন; আর সংসদে একই অবস্থান থেকে খুব কমই কথা হবে। মি. ভুট্টোর রাজনৈতিক শক্তি দাঁড়িয়ে আছে কাশ্মীর-বিতর্ক নিয়ে জঙ্গি পাঞ্জাবিদের মোহের ওপর, এবং তিনি পশ্চিমের প্রদেশগুলোতে এই বিষয়টিকেই কাজে লাগাতে শুরু করেন, ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধের কথা বলেন। এবং এই মনোভঙ্গি রক্ষার জন্য তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর কথা বলেন, কাশ্মীরকে স্বাধীন করার জন্য অধিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ভোট চান।

গত বছর দেশের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ইয়াহিয়া খান ও তার অনুসারীরা নির্বাচনের ফলাফল কী হয় তা নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিশ্চয়ই মতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের একটি জোট-সরকার গঠন করতে বাধ্য করবে এবং এভাবেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা পাবে। কিন্তু জেনারেলরা দু'টি বিষয় বিবেচনায় আনেন নি। শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচন বয়কট করে এবং একারণে আওয়ামী লীগের জন্য পুরো মাঠ ফাঁকা হয়ে যায়। অন্যদিকে সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান প্রশাসন সময়মতো ত্রাণ সরবরাহ করতে পারে নি বলে ভোট সব আওয়ামী লীগের পক্ষেই যায়, এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রার প্রশ্নে নির্বাচনের ফলাফল ছিল বিপর্যয়মূলক।
প্রায় প্রত্যেক বাঙালিই শেখ মুজিবের ছয়-দফা-কর্মসূচিকে গ্রহণ করেছিল এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ বাঙালিদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে এবং পশ্চিমা প্রদেশের পাঞ্জাব-বিরোধী আঞ্চলিক দলসমূহের সমর্থন নিয়ে ৩১৩টি আসনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপরে শেখ মুজিব আস্থাবান ছিলেন। পশ্চিমাংশে মি. ভুট্টোর পিপলস পার্টি ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮২টি আসন লাভ করে। পাঞ্জাবি লোকটি এই ভেবে শংকিত হয়ে উঠেছিলেন যে সংসদ বসলে বাঙালিরা তাদের নিজের মতো করে সংবিধান রচনা করবে।

কিন্তু মি. ভুট্টো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি হতে পারবেন না বুঝতে পেরে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছিলেন। তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে প্রেসিডেন্টের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) মধ্যে তার স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে। সংসদকে ভেটো দেবার বা বাতিল করার যে-ধারাটি রয়েছে, তা এক অর্থে পাঞ্জাবেরই ভেটো। নির্বাচনের পরের রাতে এই ধুরন্ধর আইনজীবী আমার কাছে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন: 'আমি কী করব তা নিয় আপনি কী ভাবছেন? শেখ তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তার নিজের সংবিধান রচনা করবে আর সব দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়বে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে। পশ্চিম-পকিস্তানে অগ্রহণযোগ্য কোনো কিছুতে তিনি স্বীকার করবেন কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।'

অন্য অর্থে, এলএফও-কে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মি. ভুট্টোর স্বার্থ রয়েছে। কিন্ত তিনি আমাকে বলেন তিনি গোপন খবর পেয়েছেন যে শেখ মুজিব ঘোষণা করেছেন সাংবিধানিক সংসদ অধিবেশনে বসার সঙ্গে সঙ্গে একটি সার্বভৌম সংস্থাতে পরিণত হবে। অন্য কথায় এলএফও এবং পাঞ্জাবি ভেটো তখন থেকে অকার্যকর হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে বাঙালিদের মধ্যে উৎসবের আমেজ চলে এসেছে এবং তাদের দিক থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে 'আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রি' হিসেবে বর্ণনা করেন এবং সংসদ ঢাকায় বসার ব্যাপারে সম্মত হন। বাঙালিরা সংসদভবন ও শহরকে সাজাতে শুরু করেছিল এবং ঢাকার মেজাজ ছিল বিশ্রামমুখর। বাংলাদেশের স্লোগান আর দেয়া হয়নি এবং কেউই স্বাধীনতার কথা আর বলছিল না। কিন্তু মি. ভুট্টোর অন্য ভাবনা ছিল। প্রথমে তিনি শিগগীরই সংসদে বসার বিরোধিতা করেন কিন্তু ১৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে ৩ মার্চ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে।

কিন্তু দু-দিন পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফিরে যাবার ক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যা সৃষ্টি হয়। মি. ভুট্টো ঘোষণা দেন যে তার দল সংসদে যাবে না এবং একইসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের যারা ঢাকা যাবার পরিকল্পনা করছেন তাদের হুমকি দেন। সংক্ষেপে বলা যায় মি. ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চাপ প্রয়োগ করেন। সাথে সাথে তিনি ইয়াহিয়ার জেনারেলদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যারা পূর্ব-বাংলার ব্যাপারে কট্টরপন্থী। পূর্ব-বাংলার বর্তমান গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানও এদের মধ্যে রয়েছেন।

ইতোমধ্যে অনেক নির্বাচিত পশ্চিম-পাকিস্তানী সাংসদ মি. ভুট্টোর হুমকি উপেক্ষা করে সংবিধান রচনায় অংশ নিতে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকা গিয়েছেন। গাণিতিক হিসেব অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ঢাকার সংসদে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি মি. ভুট্টো রাওয়ালাপিন্ডি উড়ে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেন, পাঞ্জাবি সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য কোনো সংবিধানকে অনুমোদন দিলে তাকে ভবিষ্যতে কী কী বিষয় মোকাবেলা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট তার ভুলটি করলেন। তিনি পাঞ্জাবি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং বৃহত্তর দলের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে কোনো রকম পরামর্শ না করেই পয়লা মার্চ সংসদ বাতিল করে দেন।

বাঙালিরা দেখল পুরো ব্যাপারটা একটা ষড়যন্ত্র, তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এবং ঢাকার বিশৃঙ্খলা দমন করতে সেনাবাহিনী তলব করা হল। বাঙালিরা প্রেসিডেন্টের ওপরে আস্থা হারালো এবং ঢাকার রাজপথে বাংলাদেশের জন্য প্রথম চিৎকার শোনা গেল। আওয়ামী লীগের উত্তেজিত সমর্থকরা স্বাধীনতা ডাকা শুরু করে দিল এবং শেখ মুজিব ৭ মার্চের গণবিক্ষোভের দিনে নাটকীয় ঘোষণার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ৬ মার্চ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঘোষণা দেন ২৫ মার্চ সংসদ ডাকা হবে। কিন্তু ততক্ষণে জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। পরের দিন শেখ স্বাধীনতার জন্য জঙ্গি আন্দোলনের ডাক দেন এবং ভবিষ্যতে কোনো আলোচনার জন্য চারটি পূর্বশর্তের কথা বলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত ছিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার (এলএফও-র কল্যাণে নিশ্চিত মি. ভুট্টোর মতা তাতে শেষ হয়ে যাবে)।

এই ডামাডোলের মধ্যে একটা জিনিস পরিস্কার: অনেক চাপ মোকাবেলা করা সত্ত্বেও শেখ একক পাকিস্তানে অংশ নেবার পক্ষে ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে (বাঙালিরা এক্ষেত্রে ওকালতি করেছিল) কাশ্মীর ইস্যুতে আপস করতেন না এবং তিনি বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিও অগ্রাহ্য করেন যার মাধ্যমে কেন্দ্রের কার্যকর ক্ষমতাকে বাতিল করে দিত। পাঞ্জাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কারণেই বাঙালিরা সংসদে বেশি আসন পেয়েছিল, কিন্তু পাঞ্জাবিরা বিশ্বাস অর্জন করে যে শেখের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো একজন নেতা তারা পেয়েছে।

কিন্তু ভারতের ওপারে বঞ্চিত পূর্বাংশে বিক্ষুব্ধ বাঙালি নেতা এবং তার আওয়ামী লীগের সৈনিকেরা স্বায়ত্তশাসনের জন্য পেশকৃত ছয়-দফার এক ইঞ্চিও ছেড়ে না দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখ মুজিব এটা পরিস্কার করে বলেছেন যে, যখন তিনি স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন তখন তিনি বিচ্ছিন্নতার কথা বলেননি। 'আমি এই অর্থনৈতিক শোষণ যাতে চিরতরে শেষ হয় তার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা চাই।' আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী রয়েছে; সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘিষ্ঠদের সঙ্গে কীভাবে পৃথক হয়ে যেতে পারে' -- তিনি সেসময় আমাকে বলেছিলেন। সামরিক শাসনের দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে অধিক ওজন দেয়ার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে বেসামরিক অসহযোগ-আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সারা প্রদেশের সার্বিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয় এবং বাংলাদেশের দাবি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতে থাকলে প্রেসিডেন্ট ১৬ মার্চ দু-টি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় উড়ে যান: (১) তিনি বলেন তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শিগগীরই ক্ষমতা ছেড়ে দিবেন যদি শেখ উভয় প্রদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে প্রাদেশিক জাতীয় সরকার গঠন করেন, অথবা (২) তিনি প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা দিবেন এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে যার প্রধান হবেন তিনি স্বয়ং এবং এই সরকার একটি সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রতিদিনকার কাজ চালিয়ে নেবে।

সেসময় দুই নেতা বলেছিলেন আশার কথা এখনও আছে। কিন্তু মি. ভুট্টো ইতোমধ্যে প্রস্তাবগুলো শুনেছেন এবং জনসম্মুখে ঘোষণা করেন যদি কোয়ালিশন সরকারে পিপলস পার্টিকে অন্তর্ভুক্ত না করা হয় তবে পশ্চিম-পাকিস্তানে আগুন জ্বলবে। তার কথার প্রমাণস্বরূপ তিনি পাঞ্জাবে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ করেন এবং ২১ মার্চ অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। যখন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে ভুট্টোকে নিতে প্রস্তুত আছেন কি না, শেখ তখন গণতান্ত্রিক রীতির কথা বলেন এবং জানান একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সহযোগী হসেবে তিনি কাকে নেবেন না নেবেন তা পছন্দ করার অধিকার তাকে দিতে হবে। এখানেও বোঝা যাচ্ছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বিষয়ে শেখের অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রমাণ করে তিনি বিচ্ছিন্ন হবার পরিকল্পনা করছিলেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুনরায় মি. ভুট্টোর জোর হুমকির কাছে নতি স্বীকার করেন এবং কোয়ালিশন সরকারের প্রস্তাব এভাবে বাতিল হয়ে যায়।

সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে শেখ এবং ইয়াহিয়া দ্বিতীয় আপস-ফর্মুলায় রাজি হন: প্রাদেশিক পর্যায়ে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সামরিক শাসন তুলে নেবার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আদেশ জারি করার জন্য এবং পূর্ব বাংলায় ও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশে ক্ষমতা দেবার জন্য বলেন। শেখ মুজিব একটি সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত একটি প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্র-পরিচালনার বিষয়টি মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে পাকিস্তানের ভাগ্য অন্যান্য শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। মি. ভুট্টো সেনাবাহিনীর কট্টর জেনারেলদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন এবং পূর্ব-বাংলার রাজপথের আন্দোলন মুজিবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।

সৈন্যরা ব্যারাকে যুদ্ধের পোশাক পরে ফেললে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে শুরু করে। প্রেসিডেন্টকে পূর্ব-বাংলায় আগুন জ্বালাবার সিদ্ধান্ত নিতে ভুট্টোই বাধ্য করেন। মি. ভুট্টো প্রেসিডেন্টকে বোঝান সামরিক শাসন তুলে নিলে, প্রদেশে ক্ষমতা প্রদান করা মাত্র পাকিস্তান পাঁচটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যাবে। তিনি আশংকা প্রকাশ করেন যে মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকারকে শেষ করে দিতে চায়। সামরিক শাসন তুলে নিলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে থাকতে আর কোনো অবস্থা থাকবে না। অর্ধ-প্রভাবিত হয়ে প্রেসিডেন্ট আবার মুজিবের কাছে যান এবং আশংকাগুলো প্রকাশ করেন। তিনি মুজিবের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন জাতীয় সংসদ বসলে ও কেন্দ্রীয় সরকারকে এক ধরনের মূল্য দেয়া মাত্র তিনি সামরিক শাসন তুলে নেবেন। শেখ মুজিব দ্রুত সামরিক শাসন তুলে নেবার কথা পুনরায় দাবি করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপলব্ধি হয় যে তিনি একজন বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কথা বলছেন এবং পুনরায় তার জেনারেলদের দলে চলে যান।

যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছতে চাইলে বলা যায়, বর্তমান হত্যাযজ্ঞের দায়-দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপরই পড়ে, যখন তিনি বাঙালিদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই সংসদ বাতিল করে দেন, কিন্তু মার্চের ৩ তারিখে মি. ভুট্টো সংসদ বয়কট করলে তার ঘাড়ও অধিক দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়ে।

ছবির লিঙ্ক: http://www.kothon.org/frame11.htm








৮টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×