প্রথম আক্রমণের পর থেকে দুর্ভিক্ষ সবসময় যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে, এবং রোগবালাই দুর্ভিক্ষের কঠোর সহযাত্রী হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু অতীতে যা ইতিহাসকে প্রকাশ করার জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল তা এখন ঘটছে বলে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে। এখন আর কেউ দাবি করতে পারবে না যে পূর্ব বাংলায় কী ঘটছে তা সে জানে না। রঙিন টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে মৃতদেহগুলো সূর্যের আলোয় পচে যাচ্ছে। ছ-মাস আগে পৃথিবীর প্রতিক্রিয়া ছিল স্বয়ংক্রিয় এবং স্বাভাবিক। বন্যার পানি চারিদিকে বাড়তে থাকলে আশা-আকাঙ্ক্ষা, অকার্যকর হলেও, ধরে রাখা যায়। কিন্তু সেনাবাহিনী বন্যার পনি নয়। ছয় মাসের স্বল্প সময়ে চ্যারিটির রাজনীতি আরো অনেক জটিল হয়ে গেছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার খানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল উদাসীন ও উদ্দেশ্যপ্রবণ লোকজনই পশ্চিম পাকিস্তানকে নানা ধরনের সাহায্য করতে চাইবে। দু-সপ্তাহ ধরে জেনারেলের ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা এম এম আহমেদ আমেরিকান সরকার ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কাছে সুন্দরতম ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে অর্থসাহায্যের জন্য চাপপ্রয়োগ করছেন। তিনি তাদের বলছেন যে তার দেশ হলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। গৃহযুদ্ধের কারণে প্রতিদিন ২০ লাখ ডলার নষ্ট হচ্ছে। যুদ্ধ রফতানি-মুদ্রার সঞ্চয়কে গিলে খাচ্ছে, যার বেশিরভাগই আসে পূর্বাংশ থেকে। এরকম হিসেব করা হয়েছে যে মি. আহমেদ এবং তার প্রভুর ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন তাদের পশ্চিম-অংশকে রক্ষা করার জন্য। এখানে পূর্ব-অংশের কথা উল্লেখ করা হয় না যেখানে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগর কারণে দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তার আশু-পরিচর্যা প্রয়োজন।
স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অনুসারে ইয়াহিয়াকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দেয়াই যায়। পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামাবাদ সরকারের সম্পর্ক ভালোই , আগের দু'জন সরকারই সামরিক বাহিনী থেকে আসার পরও। পুঁজিবাদী সরকারসমূহ সাধারণভাবে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষেই রয়েছে। সার্বভৌম দেশমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করার জন্য বইতে আইন-কানুন লেখা রয়েছে, এবং তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলনসমূহে এই আইন নিন্দাজনকভাবে ভঙ্গ করা হয়। আমরা মুখে স্বীকার করি কোনো পক্ষ অবলম্বন করে তাদের মনে আঘাত দেয়াটা অন্যায় হবে, কিন্তু আমরা আসলে হস্তক্ষেপ করি এবং ক্ষমতার পক্ষেই থাকি। যাহোক, এক্ষেত্রে সচারচরের কায়দা-কানুন ততটা খাটে নি যেমন মি. আহমেদ আশা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে এব্যাপারে জনগণের অনুভূতি সরকারের পক্ষে যায় নি। এরকম ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে যে এটা শুধু স্থানীয় একটি সমস্যা নয়, এখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। পশ্চিম-পাকিস্তান যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে পারছে, সিনেটের পক্ষে তাদের অর্থসাহায্য করা কঠিন হবে।
ইয়াহিয়ার জন্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় শ্রদ্ধা পাবার একটি সার্টিফিকেট হবে। অনেক ধরনের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে তিনি এটা অর্জনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। একটি হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতাসহ বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়ে গেছে; ইউরোপীয়দের কাছে ব্যাপারটা রাজনৈতিক অর্থহীনতা লাগতে পারে। রক্ষণশীল হয়ে হিসেব করলেও শতকরা নব্বই ভাগ পূর্ব-পাকিস্তানী এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী।
বিশ্বব্যাংকের একটি দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে আসবেন এবং এমাসের শেষে তারা ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেবেন তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে। বর্তমান পাকিস্তান সরকার ইতোমধ্যে অন্তঃত যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে, তা দ্বারা পর্যবেকদের সন্তুষ্ট হওয়া-না-হওয়ার অনেক মূল্য থাকবে। সত্যি কথা বলতে ইয়াহিয়াকে কোনো অর্থ নগদ প্রদান করার অর্থ হবে যুদ্ধকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করা। যদি খাদ্যের সরবরাহ করা হয় তবে, পূর্ব-বাঙালিরা মনে করে, এটা প্রথমে দেয়া হবে সেনাবাহিনীকে, এবং বাকি যা থাকবে তা দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
ব্রিটেনের জন্য সমস্যা হলো কায়েমী স্বার্থের রাজনীতির সঙ্গে মানবীয় প্রতিশ্রুতিকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়। প্রাথমিক ধারণা অনুসারে যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার তাদেরকেই খাদ্য ও চিকিৎসার সরবরাহ দেয়ার মাধ্যমে এই সমন্বয়-সাধন সম্ভব হতে পারে। এখানে দু-টো সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, ত্রাণকার্য যেন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়, এব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে এমন নজির আছে যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এব্যাপারটায় বাধা প্রদান করবে। তবে এখানে সহজ একটা সমাধান আছে। উদ্বাস্তুশিবিরের পাঁচ বা ছয় মিলিয়ন লোককে খাওয়াতে ধনী দেশগুলো সরকারি অনুদান, জাতিসংঘ সংস্থাসমূহ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহের সাহায্য নিতে পারে। ভারত একাই সব সামাল দিতে পারবে না। আরেকটি সম্ভাবনাও আছে। সীমান্ত অঞ্চলে, আরেকবার বিশেষভাবে বলছি, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাঙালি সরকারের সমর্থকদের মাধ্যমেও সরবরাহের কাজটি করা যেতে পারে।
সূর্যের নিচে শুয়ে থাকা মৃতদেহগুলো শিগগীরই বর্ষার পানিতে তলিয়ে যাবে। বর্তমানের কলেরা মহামারীর পূর্বে পাঁচ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে। পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে ইয়াহিয়া কয়েক মাস আরো বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন যতক্ষণ না প্রথম শরতে প্রত্যাশিত দুর্ভিক্ষ চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে। তিনি তার ৮০,০০০ সৈন্যের বাহিনীর জন্য নাছোড়বান্দার মতো সাহায্য চাচ্ছেন যারা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে পদানত রাখার জন্য। তিনি এদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন আইয়ূব খানের পদচ্যুতির পর থেকেই, যিনি ছদ্ম বেসামরিক প্রশাসন গঠনের জন্য ফিরে এসেছেন। যদি কিছু নাও হয় 'বাঙালিদের শিক্ষা দেয়া গেছে' মনে করে একধরনের আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাকে অনেক কিছু হারাতে হবে, সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানকেই, যে দেশটিতে অনেক জাতি রয়েছে এবং বিভিন্ন উপাদান দিন দিন অস্থির হয়ে উঠেছে। এমনকি তার চীনা বন্ধুরাও তাকে সাহায্য করতে নাও পারে, স্যামসনের মতো, তার চারপাশেও মন্দিরের সব পিলার ধ্বংস হয়ে পড়বে।
ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রীরা কোনো কিছুতে সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ থাকলে তা এড়িয়ে চলতে চায়, যা বোধগম্য কিন্ত বিপজ্জনক। কারো প্রকৃত প্রভাবকে অস্বীকার করে দায়িত্ব এড়ানো খুব সহজ। আমেরিকান বা আইএমএফ-এর সাহায্য-সরবরাহের সঙ্গে ব্রিটেনের সহায়তাকে খুব কমই তুলনা করা হয়। কিন্তু এরপরও 'পাকিস্তান-জোটের' ব্যাপারে আমাদের ভিন্ন মতামত রয়েছে। যদি আমরা ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র এবং সৈন্যদের জন্য মাখন কেনা বন্ধ করি, ফ্রান্স, ইটালি, হ্যান্ড, কানাডা ও পশ্চিম জার্মানির মতো অন্যান্য দেশগুলোও আমাদের মতোই পদক্ষেপ নেবে। ভারতীয় উপমহাদেশকে তারা বিশেষ ব্রিটিশ-ভাবনায় গুরুত্ব দেবে।
ইয়াহিয়াকে সাহায্য দিতে অস্বীকার করা নৈতিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করা কেবল মানবীয় দুর্ভোগের ওপর সীমারোপই হবে না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভানাকে তা হ্রাস করবে, যে-যুদ্ধ হবে ভয়াবহ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা যা থেকে বেড়েই চলবে। যদি কোনো দেশ এখন ইয়াহিয়া খান ও তার অনুগত অনুসারীদের সাহায্য প্রদান করে তবে সে-দেশ গণহত্যায় অর্থ প্রদানের অভিযোগ এড়াতে পারবে না।
ছবির কৃতজ্ঞতা: ম্যাগনাম ফটোস, সূত্র: http://www.genocidebangladesh.org/?page_id=12