শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুত
মার্টিন এডনে
দি গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১
ঢাকা, মার্চ ১৫। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবিধানিক সংকট সমাধানের জন্য আজ মেশিনগানসহ অর্ধ ডজন সামরিক ট্রাক পেছনে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এই সংকটের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বস্তুত দুইটি পৃথক দেশ হিসেবে বিরাজ করছে। একজন মুখপাত্র জানান প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন যার দল আওয়ামী লীগ পহেলা মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সেবাখাত ও অফিস চলবে কি চলবে না, তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
তারা কয়েক প্লাটুন রাইফেলধারীর প্রহরাধীন প্রেসিডেন্ট-প্রাসাদে, নাকি দুই মাইল দূরবর্তী শেখ মুজিবের তিন তলার বাসভবনে আলোচনায় মিলিত হবেন তা এখনও নির্ধারিত হয় নি। শেখ মুজিবের এই বাসভবনে সাদা-পোশাক-পরা আওয়ামী লীগের কর্মীরা কোন সেবা চলবে এবং কোনটা চলবে না এসংক্রান্ত জরুরি প্রশ্নের উত্তর দেন। যদিও প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিব পরস্পর মিলিত হতে রাজি হয়েছেন কিন্তু বিষটি নিশ্চিত করা হয় নি। এই দুই বাসভবনের মধ্যবর্তী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের তিনটি ফ্লোর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে -- বলা হয়েছে ফ্লোরগুলো রঙ করার জন্যই এটা করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট এগুচ্ছেন স্বপ্রণোদিতভাবে। বিমান থেকে নামার পরে তিনি একটি কালো আমেরিকান গাড়িতে চড়ে ঢাকায় আসেন। তার আসার পথে প্রায় এক ব্যটেলিয়ান সৈন্য ব্রেনগানসহ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। গাঢ় রঙের স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গাড়ির পেছন সিটে বসা ছিলেন, বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় তিনি হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-ভবনে প্রধান সামরকি আইন প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করার সময় তার হাতে ছিল না। কয়েক মিনিট পরে জেনারেল সাহেব রওয়ানা দেন।
প্রেসিডেন্টের আগমণে সপ্তাহখানেকের মধ্যে এটা পরিস্কার হয়ে যাবে কী সাংবিধানিক সমাধান হতে যাচ্ছে। ঢাকায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে এজন্য যে শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন এবং অনেকে মনে করছিলেন বাংলার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবার বিষয়টি তার অনুমোদনেই হচ্ছিল। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ওপরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার মাধ্যমে গত সপ্তাহের শেষে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কিছুটা কাটলেও আজ নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে স্কুল, আদালত ও সরকারী অফিস বন্ধ থাকবে কিন্তু উপযোগী ও শিল্পসংক্রান্ত সংস্থাগুলো বিধিনিষেধের অধীনে চালু থাকবে।
সবাচাইতে দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো রফতানির অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে আসছে না, ব্যাংকগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে রফতানি বন্ধ রয়েছে এবং দু'টি ব্যাংক ইতোমধ্যেই বিপদে পড়ে গেছে। একটি প্রচারণা-প্রত্যয় বাঙালিদের মধ্যে এভাবে কাজ করছে যে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী বিপুল অর্থ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। জনগণকে তাদের সম্পত্তি কিনতে বারণ করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগের দাঙ্গা সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও রূপ নেয় এবং এই বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা বেসামরিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো শুভ প্রচেষ্টা নয়।
জঙ্গী ছাত্ররা আজ ঘোষণা দিয়েছে তারা আজ 'বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধ করা'-র জন্য চেকপোস্ট বসাবে। আজ দুপুরের পূর্বে বিমানবন্দরের একটি চেকপোস্টে একটি স্কুটারকে থামানো হয়। কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন আরোহী একটি বন্দুক বের করে গুলি করে, একজন রিকশাচালক তাতে আহত হয় এবং আরোহী তার সহযোগীদের নিয়ে পালাতে উদ্যত হয়। তাকে ধাওয়া করা হয়, থামানো হয় এবং লাঠি ও ইটের সাহায্যে তাকে আঘাত করা হয়। এই গণপিটুনিতে ১,০০০ থেকে ২,০০০ জনের এক জনতাগোষ্ঠী অংশ নেয়। তাকে রক্তাক্ত ভূমিতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়। হাসপাতাল থেকে সরকারীভাবে জানানো হয় তারা দু-জন আহতকে ভর্তি করেছে। ঢাকা এই মুহূর্তে কতখানি উত্তপ্ত তার নিদর্শন হিসেবে এই ঘটনাকে ধরা যেতে পারে।
১০ দিন আগে দেয়া বেতার-ভাষণে ইয়াহিয়া যে প্রভুসুলভ মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন তা যদি এখনও বজায় রাখেন তবে সমাধান হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগের সদস্যরা বলাবলি করছে যে ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেই ফেলেছেন, কারণ সেখনে তিনি 'স্বাধীনতা' ও 'মুক্তি' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট যে-মনোভাব প্রদর্শন করেছেন তার চাইতে যথেষ্ট উদারতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও কৌশলের পরিচয় না দেখান এবং আজকের সেনামোতায়েনের বিপরীতে শেখ মুজিব যদি তার দলের চরমপন্থীদের শান্ত রাখতে না পারেন, তবে ঐতিহাসিক এক সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দিবে।
ইয়াহিয়া মেশিনগান-প্রহরায় ঢাকায় উপস্থিত হয়েছেন: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন
দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?
দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্তান.....
শেখস্তান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের বিয়ের খাওয়া
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন