somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রান্তসীমায় টলমল: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ১৮

০৩ রা জুন, ২০০৮ রাত ১২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শেখ মুজিবের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন না পেলে পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতার ঘোষণার দিকে ঠেলে দিবে।

দি ইকোনমিস্ট, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

এই সপ্তাহের শুরুতে ঢাকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে অবস্থিত প্রবাসী নাগরিকেরা তাদের ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারসহ অন্য অনেক দেশ তার দেশের নাগরিকদের অতি প্রয়োজন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন সামরিক শাসন পুনঃপ্রয়োগের ফলে সৃষ্ট দাঙ্গা বোধহয় শেষ হলো। কিন্তু বিদেশীরা মনে করছেন এই শান্ত অবস্থা হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবারই পূর্বলক্ষণ।

এটা সত্যি যে গত রোববারে (৭ মার্চ) শেখ মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার যে 'ঐতিহাসিক ঘোষণা' দেবার কথা ছিল তা তিনি দেন নি। ইয়াহিয়া খান রোববার কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে তিনি বা তার সেনাবাহিনী এরকম কোনো ঘোষণাকে সহ্য করবে না, সম্ভবত সেই সতর্কবাণী তাকে ওরকম ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত রাখে। কিন্তু শেখ মুজিব এরপরই কাজের কাজটি করলেন। প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চে আইনসভার অধিবেশনের যে তারিখ ঘোষণা করেন, তার প্রত্যুত্তরে মুজিব জানান যে তিনি বা তার আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যোগ দেবে না যদি না চারটি শর্ত মানা হয়। এরমধ্যে দু-টি শর্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব সামরিক শাসন উঠিয়ে নিতে হবে এবং জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে -- যে-শর্তগুলো প্রেসিডেন্টের মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব শিগগীরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এটাই হয়তো মুজিবের সঙ্গে তার শেষ আলোচনা।

পশ্চিম পাকিস্তানের মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো অবশেষে কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই যে ২৫ মার্চের অধিবেশনে বসতে রাজি হয়েছেন, এখন তার সামান্যই মূল্য রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের প্রভাব মুজিবকে একটি নতুন জমিনে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এমনকি তিনি অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছেন বলতে হবে, তার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যেসব চরমপন্থী লোক রয়েছেন তারা শনিবার রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব আপাতভাবে আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তাদের এটা বোঝাতে যে, প্রেসিডেন্ট নতুন তারিখের যে-প্রস্তাব দিয়েছেন তার তা গ্রহণ করা উচিত, কিন্তু তিনি অবশ্যই সেক্ষেত্রে শক্ত শর্ত দেবেন।

ঢাকার মতোই কিছু পদক্ষেপ অন্যান্য শহর থেকে এসেছে -- কিন্তু এতে সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। তারা ঢাকা ও অন্যান্য শহর পরিচালনার দায়িত্ব একরকম মুজিবের হাতেই যেন ছেড়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছয় দফার প্রতীক ছয়টি রূপালি তকমা-বিশিষ্ট সবুজ টুপি পরে 'শান্তি রক্ষা'-র কাজ করছে যা পুলিশের চেয়েও ভালো কাজে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে পাঁচ দিনের সর্বাত্মক ধর্মঘট মুজিবের জন্য বিরাট সাফল্য ছিল। রোববারে তিনি এ সপ্তাহের প্রতিরোধ-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে আছে রাজস্ব প্রদান না করা, সরকারী অফিস-আদালত-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা এবং সব ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা। তিনি হুমকি দেন যে নতুন সর্বাত্মক ধর্মঘটের মাধ্যমে তিনি এই কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করবেন।

এখন পর্যন্তও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের কল্পব্যবস্থা বজায় রাখতে চান। যাত্রীপরিবাহী বিমানগুলোর মাধ্যমে তিনি ঢাকায় সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন এবং ট্যাংকগুলোতে চাকা লাগিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে রাজপথে লড়াই করার জন্য। কিন্তু জনগণ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা থেকে এটা বোঝা কঠিন যে শেখ মুজিব কীভাবে অহিংস নীতি কার্যকর করবেন। প্রেসিডেন্টের জন্য বাস্তবানুগ ভাবনা এটা হতে পারে যে এই মুহূর্তেই শেখ মুজিবের সঙ্গে একটি রফা করে ফেলা, কারণ কেবল তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণাকে আটকে রেখেছেন।

তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কী মেনে নেবেন? আইনসভা অধিবেশনে যোগ দেবার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের বেঁধে দেয়া চারটি শর্তের মধ্যে দু-টি সহজেই মেনে নেয়া যায়। সেগুলো হলো সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা এবং গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করা। সেনাবাহিনী ব্যারাকে থেকেও এখন যে কাজ করছে তা চালিয়ে নিতে পারবে এবং তদন্তের ফলাফল হয়তো তাদের জন্য খুব খারাপ কিছু হবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সরকারীভাবে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেয়া এবং নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সামরিক শাসন পুরোপুরি ওঠানো সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার বিকল্প কিছু দাঁড়াচ্ছে এবং যতক্ষণ না কোনো প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়াচ্ছে, বেসামরিক সরকার ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন চালাতে পারবে না। কিন্তু এই কাজটা আইনসভা অধিবেশন না বসা পর্যন্ত প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। যত দ্রুত অধিবেশন বসবে তত দ্রুত এই কাজটা সমাধা করা যায়।

এর ফলে নতুন আইনসভা সার্বভৌম একটি প্রতিষ্ঠান হবে এবং নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ভেটো দেবার মতা বিলোপ করবে; কিন্তু সেই ক্ষমতা ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে কারণ শেখ মুজিব খুব সহজেই এমনকি সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা পরিকল্পনা তখন নতুন সংবিধানে প্রায় নিশ্চিতভাবেই লিখিত হবে। এই ধরনের শিথিল ফেডারেশন -- যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে করেন -- পাকিস্তানের সমাপ্তি ঘটাবে; কিন্তু একমাত্র বাস্তবানুগ বিকল্প হলে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা। যদি প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে বলপূর্বক দমনপ্রক্রিয়া চালান তবে তাতে সফল হবার সামান্যই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তার জাতির উদ্দেশ্যে শনিবারে দেয়া ভাষণে তিনি সেই পথেই যাবেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি যদি তা করেন তবে এই কমনওয়েলথভুক্ত দেশটিতে নতুন একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে যা বিশেষত ব্রিটেনের জন্য সমস্যাজনক হয়ে দেখা দেবে। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অন্য খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বায়াফ্রার যুদ্ধে ব্রিটেন নাইজেরিয়ার সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল যেগুলো বিচ্ছিন্নতবাদীদের নির্মূল করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকে কেন ব্রিটেনের ভিন্নভাবে দেখা উচিত তার কারণ রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান এমন এলাকা যার সীমান্ত ইতোমধ্যে রয়েছে। বায়াফ্রার জন্য দাবিকৃত ভূখণ্ডে জেনারেল ওজুকুর যে-সমর্থন ছিল শেখ মুজিবের তার চাইতে অনেক বেশি সমর্থন রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন বাঙালিরা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে সাংস্কৃতিকভাবেই আলাদা নয়, তারা কেবল আত্মসচেতন ও দৃঢ়চেতা জাতি হিসেবেই বিকাশ লাভ করে নি, পাকিস্তানের পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোনো ব্রিটিশ সরকারেরই উচিত হবে না, পাকিস্তানের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া -- আর ব্রিটেন পাকিস্তানের মূল অস্ত্রসরবরাহকারীও নয়।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০০৮ রাত ১২:০৬
৪৫৬ বার পঠিত
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে আমি.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১১

কে আমি?.....

Jean-Paul Charles Aymard Sartre (আমরা সংক্ষেপে বলি- জ্যা পল সাত্রে) নাম ভুলে যাওয়া একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম, জার্মানীর অর্ধ অধিকৃত ফরাসীদের নিয়ে।

'হিটলারের সৈন্যরা প্যারিস দখল করে নিয়েছে। কয়েকশো মাইল দূরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে না!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৮


বেশ কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ করার জন্য সমাজের একটি বৃহৎ অংশ দাবী জানিয়ে আসছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি কে অনেকে দায়ী করছে কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পকে আধুনিকায়নের চেষ্টা

লিখেছেন জটিল ভাই, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(ছবি নেট হতে)

বনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:১৩

বর্তমান সময়ের রাজনীতি নিয়ে আমার আমার পর্যবেক্ষণ সমুহঃ
১। শেখ হাসিনা এখন হুমকি ধামকি না দিয়ে হাল্কা পাতলা কান্না কাটি করলে এবং দুঃখ প্রকাশ করলে আওয়ামী লীগের উপকার হত।
২।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। এবং খালেদা জিয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:২৬






২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার পর ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথম তিনি জনসমক্ষে উপস্থিত হলেন এবং রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। শেষবার তিনি ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×