somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"পুরনো পাকিস্তানের সমাপ্তি": বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ১৩

২৯ শে মে, ২০০৮ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডেভিড লোশাক
দি টেলিগ্রাফ, ১০ মার্চ ১৯৭১

ঢাকা। ভারতীয় উপমহাদেশে দেশবিভাগের কোলাহলের মধ্যে জন্ম নেয়া, অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও অপরিণামদর্শী জেনারেলদের মাধ্যমে খুঁড়িয়ে চলা, জিন্নাহ-সৃষ্ট, ইসলামের প্রতি অনুরক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র এখন মৃত। গত দুই সপ্তাহের দৃশ্যপট ও নিপীড়নমূলক রাজনীতির পর বলা যায় পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়াটাই সমাধান হতে পারে। ১২ কোটি পাকিস্তানীর, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত ৭ কোটি বাঙালির দুঃখজনক অতীতের চাইতে মলিন ভবিষৎ অপেক্ষা করছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণআন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার ফলে যে-সংকট সৃষ্টি হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারকে তা বিপদে ফেলে দিয়েছে। আর যদিও হবার কথা নয় তবু, রক্তপাত ছাড়াই, কোনোক্রমে তার সমাধান হতে পারে। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতারা যে আপসরফাই করে থাকুন না কেন, দুই জাতিকে একত্রে রাখার যে-নিরীক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ একটি সত্য যে এখানে দুই জাতি রয়েছে। এদের কোনো সাধারণ স্বার্থ নেই, কোনো পারস্পরিক নির্ভরতা নেই, কোনো সাধারণ ভাষা বা খাদ্যাভ্যাস নেই এবং এমনকি ইসলামও তাদের একত্রে রাখতে পারে না।

শেষ যে-বিষয়টি বোঝার দরকার তা হলো, ইসলাম কোনো ঐক্যের শক্তি নয়। এটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রমাণিত হয় নি; এখানেও হচ্ছে না।

ভারতীয় শত্রুতা

দেশটির দুই অংশের মধ্যে অনেক পার্থ্যক্যের সঙ্গে, যার অনেকগুলোই মীমাংসা করা সম্ভব নয়, যোগ হয়েছে এই ভৌগোলিক সত্যটি: দু-টি অংশ এক হাজার মাইলের শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। দুই অংশের মধ্যে আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গত মাসে ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে এই পরিস্থিতির আরও অবনমন ঘটে। কোনো আধুনিক রাষ্ট্রই -- অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে -- টিকে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের নেতারা ২৩ বছরের উদ্বিগ্ন সময়ে স্থিতিশীল, স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে ব্যর্থ হবার পেছনে এগুলোই হলো কারণ। একই কারণে পাকিস্তান সবসময়ই রোগগ্রস্ত থেকেছে। কিন্তু এর সমাধান হিসেবে পাকিস্তান দু-টুকরো হয়ে যাচ্ছে যা আবার আগের রোগের চেয়েও মারাত্মক। এখন দীর্ঘদিনের সংঘাত ফুটন্ত কড়াইয়ের পানির মতো ফুটছে, নেতাদের ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই।

দু-জন পাকিস্তানী এবং তার বন্ধুরা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ এই বিভক্তির জন্য দায়ী। গত ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসবকিছু ঘটছে। বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেবার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ফর্মুলা খুব মসৃণভাবে ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান সরকারব্যবস্থায় তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এটাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। নির্বাচন অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও হঠকারী জেনারেলদের জবাব দেয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি ও গরীব মানুষের মিলিওনার নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো 'ইসলামিক সমাজতন্ত্র'-এর কথা বলে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৫টি আসন লাভ করেন। বাঙালিদের প্রিয় জননেতা শেখ মুজিবুরের দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের দু-টি ছাড়া সব আসনই লাভ করে। নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ইস্যুর আবেগকে কাজে লাগিয়ে মুজিব এই সাফল্য পান। এভাবে তিনি ৩০০ আসনের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।

এর পরে মনে হয়েছিল রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নে সম্মত হবেন যার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দৃশ্যপট থেকে সরে যাবেন। এক্ষেত্রে আদর্শগত দিক থেকে তাদের বিভক্তি কম ছিল, এবং উভয় নেতাই সংবিধান-ইস্যুতে আপস করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কেবল দুই-দল-ব্যবস্থাই তৈরী করে নি, এটা এমন এক দুই-দল-ব্যবস্থা করে যাতে জনসংখ্যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করবে এবং বিরোধী দল কখনোই রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এই ফলাফল দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য তৈরী করে।

নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং উপনিবেশ ঠেকাতে পূর্ব পাকিস্তান প্রায় পুরোমাত্রার স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে যা আওয়ামী লীগের 'ছয় দফা'-র ভিত্তিতে চাওয়া হচ্ছে। এর অধীনে নিজেদের রাজস্ব ও ব্যয়, বৈদেশিক সাহায্য, বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিজেদের অধীনে থাকবে এবং কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি, এবং সম্ভবত মুদ্রা একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই প্রস্তাব ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। এটা মি. ভুট্টোর কাছে গৃহীত হয়নি -- কেবল এজন্য নয় যে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাতে ব্যাহত হবে -- আরও একটি ব্যাপার হলো, তার দর্শন অনুসারে ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধ চালাতে হলে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দরকার।

ইয়াহিয়ার কাছেও এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তার মনে হয়েছে এতে পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট হবে। এটা পাঞ্জাবী-প্রাধান্যের-সেনাবাহিনীর কাছেও গৃহীত হয় নি। তারা পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র দিতে চায়, কিন্তু তা এমন কোনো গণতন্ত্র নয় যে, বাঙালি-সংখ্যাগরিষ্ঠতার সেনাবাহিনীবিমুখ সরকারের প্রতি চিরদিনের জন্য তাদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। আর এটা অগ্রহণযোগ্য ছিল অন্য রাজনৈতিক কারণে। এরকম স্বায়ত্তশাসন পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশকেও অনুপ্রাণিত করবে এবং পাকিস্তানের সংহতি আরও সংকটের মুখে পড়বে। তাই আইনসভা বসার আগেই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

ভুল পদ্ধতি

এরকম গুরুতর সময়ে ইয়াহিয়া ভুল পথে এগোলেন। ইয়াহিয়া আইনসভার অধিবেশন স্থগিত করলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এক সপ্তাহের আন্দোলনের পর তিনি ২৫ মার্চ অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন, কিন্তু তার বেতার ভাষণ শুনে বাঙালিরা তার ইচ্ছার সামঞ্জস্য খুঁজে পায় নি। জেনারেলের চাইতে তিনি সার্জেন্ট মেজরের স্টাইলে পদক্ষেপ নেয়ায় তা পূর্ব পাকিস্তানের অধৈর্য জনতাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয় এবং স্বাধীন 'বাংলাদেশ'-এর ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকার মতো কিছু বলে তাদের আশ্বস্ত করতে পারেন নি। রোববারে শেখ মুজিব এই ঘোষণার কাছাকাছি চলে এসেছেন, সেনাবাহিনীর তড়িৎ ও কঠোর প্রতিক্রিয়া ছাড়াই তিনি এটা করতে পারতেন। সেনাবাহিনী যেকোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনকে প্রতিহত করবে, এর অর্থ অনেক রক্ত ঝরবে।

যদি 'বাংলাদেশ' স্বাধীনতা লাভও করে, তবে তার নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এমন একটি অর্থনীতি থেকে যা ইতোমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু যদি একে প্রতিহত করা হয় বা দমন করা হয়, তবে ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে কীভাবে হজম করা যাবে? আর দখলদার বাহিনী দিয়ে একটি জাতিকে কীভাবে দমিয়ে রাখা যাবে, যে-বাহিনীর ঘাঁটি এক হাজার মাইল দূরে? যদি পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তবে পশ্চিমেও একইভাবে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হবে, অর্থনৈতিক অবস্থা সেখানেও ভালো নয়।

পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবালী ভারতের সমস্যা-রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও গভীর প্রভাব ফেলবে। মার্কসীয় নেতা জ্যোতি বসু তার নিজস্ব 'ছয় দফা' দাবি করে দিল্লি থেকে পৃথক হতে চাইছেন। এসব হচ্ছে কেবল এজন্য নয় যে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বেশ কিছু চীনা 'পর্যবেক্ষক'-কে দেখা যাচ্ছে।
....

অনুবাদকের বাছাই বাক্য: ইসলাম কোনো ঐক্যের শক্তি নয়। এটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রমাণিত হয় নি; এখানেও হচ্ছে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০০৮ রাত ১০:৩৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×