ব্রাত্য রাইসুর সাম্প্রতিক একটি পোস্টকে (অধিকার বিষয়ে ব্লগের বুদ্ধিজীবীরা কী বলেন?) ঘিরে যূথবদ্ধ ব্লগারকূলের সঙ্গে বিতর্ক করলেন মানস চৌধুরী। এর পরিস্কার দুইটা অংশ আছে, রাইসুর উত্থাপিত প্রশ্ন ও মানসের মন্তব্যপরবর্তী ব্লগারকূলের আক্রমণ। কিন্তু এসবের কেন্দ্রে রয়েছে সামহোয়ারইন-এর চিরাচরিত আগুনইস্যু (একমাত্র চলমানও) মুক্তিযুদ্ধ বনাম জামাত-শিবির চক্র। আমার বিশ্লেষণ মোটা দাগে পুরো বিষয়টায় আলো ফেলার চেষ্টা করবে, কিন্তু সবকূল রক্ষা করতে পারবে, এমনটা আগাম দাবি করছে না। মানসকে আক্রমণের একপর্যায়ে আলম ভাই নামক ব্লগার 'মনে হয় ভুল হচ্ছে, মানস আসলে ওরকম নয়, ফাহমিদুল ভাইয়ের মতো বলা যায়' -- এরকম একটা মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। তবে আমার নাম চলে আসাটাই এই পোস্টের পয়দার পেছনের অন্যতম কারণ নয়, বলা দরকার।
প্রথমে ব্রাত্য রাইসুর পোস্ট সম্পর্কে বলি। একাত্তরের রাজাকার জামাত নেতা কামরুজ্জামানের পুত্র ওয়ামীকে ব্যান করা হয়েছে। কারণ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সভায় উপস্থিত কয়েকজনের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, এই সংবাদের রেশ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের 'সিংহের (নাকি বাঘের?) মুখোস পরা কুকুর'-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। রাইসু প্রশ্ন তুলেছেন যে ওয়ামীকে কোন নীতিমালায় ব্যান করা হয়েছে? তার দৃষ্টিতে এখানে কর্তৃপক্ষের আচরণ পক্ষপাতমূলক হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দিলে যদি ব্যান করা যায়, তাহলে অ-মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দিলেও ব্যান করা উচিত। অধিকার সমানভাবে বরাদ্দ থাকা উচিত। তবে তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যান-এর পক্ষে, যদি কর্তৃপক্ষ তা ন্যায্য মনে করে।
এই পোস্টের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা আবেগাক্রান্ত এবং জামাতীদের ঘৃণা করেন, তারা রাইসু সাহেবকে আক্রমণ করেছেন, আর মানস চৌধুরী কিছু সমর্থনবাচক মন্তব্য করায় পরবর্তী যাবতীয় আক্রমণ তার দিকে গিয়েছে। মানস চৌধুরী সেই সম্মিলিত আক্রমণ একাই মোকাবেলা করেছেন, রাইসুর সাহায্য ছাড়াই। বলাবাহুল্য আক্রমণটা বরাবরের মতোই পয়েন্টে থাকেনি এবং অশালীন অনেক গালির ময়লা তার প্রতি নিক্ষেপ করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক, রাজাকারসমর্থনকারী কয়েকজন সু শীলের তালিকা তৈরী হয়েছে
১. ব্রাত্য রাইসু
২. মাহবুব মোর্শেদ
৩. মিরাজ
৪. মানস চৌধুরী
প্রেক্ষাপট বর্ণনাটা দীর্ঘ হয়ে গেল। এসব আপনাদের বেশিরভাগেরই জানা। তবু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, নিজের জন্য ও পাঠকের জন্য (যারা জানেন এবং জানেননা)।
ব্রাত্য রাইসু একসময়ের নিয়মিত ব্লগার, আমি যখন রেজিস্ট্রেশন করি, ২০০৭ সালের অক্টোবরে, তার নাম সর্বোচ্চ ব্লগারের লিস্টে শোভা পেত। সেই ফিচারটি এখন নেই। আর আমি ব্লগে নিয়মিত হবার পরেই লক্ষ করি তিনি এখানে অনিয়মিত। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে: বিডিনিউজ আর্টসের ব্যস্ততা হতে পারে, ব্লগিং বস্তুটা তার কাছে পানসে হয়ে যেতে পারে বা অন্য কিছুও হতে পারে। গত কয়েক মাসে তার পোস্টের সংখ্যা ৪, ১, ১, ২ ...। এই মার্চ মাসে তিনি ৩টি পোস্ট দিয়েছেন, বিষয় একটাই। তার অধুনাদুর্লভ পোস্টসমূহের মধ্য থেকে যখন তিনটিই থাকে 'মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দেবার কারণে রাজাকারপুত্রের ব্যান'-এর যৌক্তিকতাসম্পর্কিত, তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবসেসড ব্লগাররা যে তাকে সন্দেহ করবেন, সেটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। সন্দেহটা তৈরী হয়েছে আগেই, তার অতি বিখ্যাত ও বিতর্কিত পোস্ট 'রাজাকারপুত্রদের ঘৃণা'সংক্রান্ত একটি পোস্টের কারণে। তাদের দিক থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তাকে তো ইদানীং দেখাই যায়না, ওয়ামীর ব্যান নিয়ে সরব হবার কারণ কী? তিনি কি রাজাকার বা তার পুত্রদের বিষয়ে দরদী? এই জামাতী লোকজনের উস্কানির ফাঁদে পা দিয়ে গালিগালাজ করতে গিয়ে কিছু দিন আগে যখন কিছু ভালো ব্লগার ব্যান হন, তখনই বা তিনি কোথায় ছিলেন?
তবে আমি ব্রাত্য রাইসুকে যেভাবে পাঠ করি, তিনি জাতীয়তাবাদ অপছন্দ করেন। (বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলের চাইতে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী দল হলো আওয়ামী লীগ, কারণ তাদের নেতৃত্বে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল ষাটের দশকে ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ হয়েছিল, তার ফলেই একটি জাতির [বাঙালি-মুসলমান] জন্ম হয়েছিল। বিএনপির জাতীয়তাবাদ তাত্ত্বিকভাবে খুব সবল নয়)। সেহিসেবে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আবেগ জাতীয়তাবাদী, (আওয়ামী লীগার না হয়েও এই আবেগের বশবর্তী হতে পারেন কেউ) তার উগ্ররূপ সামহোয়ারে প্রকটিত। যেকউ এখানে ঢুকলে এরকম ধারণা পাবেন, ইহা এমন একটি পাবলিক ব্লগ যেখানে ভার্চুয়াল মুক্তিযোদ্ধারা সর্বদা ছাগু তাড়ানোর নাম করে জামাতিদের গালমন্দ করেন। আর (হাতে গোনা) জামাতীরা ঠাণ্ডা মাথায় তাদের অতি রক্ষণশীল মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত জনাব রাইসু এই উগ্র জাতীয়তাবাদবিরোধী, যার সাইড ইফেক্ট হিসেবে তাকে জামাতীদের প্রতি দরদী বলে প্রতিভাত হয়। আর বাকি যা ইমেজ, তা ভার্চুয়াল মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত।
এই বলপ্রয়োগ সমানভাবে লক্ষ করা গেছে মাহবুব মোর্শেদের ক্ষেত্রে, মিরাজের ক্ষেত্রে এবং সম্প্রতি মানস চৌধুরীর ক্ষেত্রে। ব্রাত্য রাইসুকে আমি সামান্য চিনি, মাহবুব মোর্শেদকে কখনও চোখে দেখিনি কিন্তু লেখার মাধ্যমে চিনতাম, মিরাজ ঢাবির সহকর্মী হয়েও চিনেছি সামহোয়ারে এসে। কেবল মানস চৌধুরীকে আমি 'ভালমতো' চিনি -- মানে যেরকম পরিচয় থাকলে এরকম দাবি করা যায় সেরকম। তিনি আমাদের 'যোগাযোগ' পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। এদের প্রত্যেকের সু শীল ও জামাতী খেতাব জুটেছে। আমি জানি এরা কেউই জামাতী নন, এদের একমাত্র অপরাধ এরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবসেসড নন। ব্রাত্য রাইসু তো বলেইছেন তিনি জাতীয়তাবাদ অপছন্দ করেন, উগ্র জাতীয়তাবাদ যুগে যুগে দেশে দেশে অনেক রক্তপাত, জাতিঘৃণা সৃজন করেছে। সামগ্রিক মানবতাবাদকে করেছে খণ্ডবিখণ্ড।
যেপ্রক্রিয়ায় সামহোয়ারে জামাত/ছাগু খেদানো হয় কাঁঠালপাতার ছবি দিয়ে, তাতে জামাতকে খর্ব করা যায় কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। জামাতীরা মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা, বাঙালিত্বকে অবমাননা করে একের পর এক পোস্ট দেন, আর মুক্তিযোদ্ধারা দেন গালি। আমি খুব কম ব্লগারকে দেখেছি জামাতীদের উদ্ভট আদর্শিক কথাবার্তাকে যুক্তি-তথ্য-ব্যাখ্যা দিয়ে খণ্ডন করতে। এস্কিমো, অমি রহমান পিয়াল, রাশেদ এরকম হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখা যায় এই পরিশ্রম করতে। বাকিরা আছেন গালিগালাজের জন্য। এই গালিগালাজের বিরোধিতা করেই মিরাজ হয়েছেন কোপের শিকার (গালিগালাজ সম্পর্কিত মিরাজের পোস্টে আমার কিছু দ্বিমত ছিল, তা আমি তাকে জানিয়েছি)। অথচ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত পরিশ্রমী লেখা মিরাজের মতো করে কেবল পিয়ালই লেখতে পারেন। মাহবুব মোর্শেদও কর্তৃপক্ষীয় ভাষায় তাদের 'ইরিটেটিং গুণ্ডা' বলে 'শীর্ষ সু শীল' হয়েছেন। অথচ মাহবুবের ব্লগিং-এর যে ডাইভার্সিটি, যেকোনো ইস্যুকে বিশ্লেষণের যে ক্ষমতা, তা কয়জন ব্লগারের আছে?
আমি বিস্মিত হলাম মানস চৌধুরীকে যেভাবে হেনস্তা করা হলো তা দেখে। তার অপরাধ তিনি ব্রাত্য রাইসুকে ডিফেন্ড করে মন্তব্য করা শুরু করেন। অতএব তিনিও জামাত। তিনিও সুশীল। এবং দ্রুত লিস্টি করা হলো। তার ভাগ্যে নাম্বার ৪। তবে তিনি যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাল্টা জবাব দিয়েছেন, তাতেও আমি বিস্মিত। তার ভাষায় 'বিষম তর্কের পাটাতন', তার চুলদাড়ি নিয়ে কমেন্ট করা যাচ্ছে, কিন্তু যারা করছেন তাদের টিকিটি বোঝার উপায় নেই নিকের কারণে (এক হাসিব বা রাশেদ ছাড়া)। আমি বলছি মানস চৌধুরী মোটেই জামাতসংবেদনশীল নন, (তার হিন্দু পরিচয় ভুলে গেলেও), তিনি যদি ব্রাত্যর কোনো কথা সমর্থন করেন তবে, তার পেছনে একটা কারণ না খুঁজে ভিন্ন কোনো কারণ খোঁজার অবকাশ রাখা উচিত ছিল।
ব্রাত্যর ওয়ামীকেন্দ্রিক আপত্তি সন্দেহের জায়গা তৈরি করে (কিন্তু বিশ্বাস করি তিনি মগবাজারপুষ্ট নন)। তবে তার উগ্র জাতীয়তাবাদবিরোধিতা আমি সমর্থন করি। আর সমর্থন করি জামাতীদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যানের দাবি (সেহিসেবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেও)। যদিও এই দাবিটির প্রতি কারও কোনো সমর্থন দেখা গেলনা। ব্যক্তিগতভাবে আমিও আমার আদর্শিক ভাবনা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আটকে রাখতে চাইনা। আমি ৪৭-এর দেশবিভাগ, বঙ্গভঙ্গ, ব্রিটিশ শাসন, মুসলমানদের আগমন হয়ে সর্বভারত থেকে সর্ববিশ্বের ঘটনাবলী বুঝতে চাই। আমি এই সময়ে বুঝতে চাই এদেশে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের তৎপরতার হেতু কী? এই কারণেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্ধ থাকতেও চাইনা আমি। পাকিস্তানীরা বাঙালি নিধন করেছে, রাজাকাররা মিলিটারিদের সহযোগিতা করেছে এটা যেমন সত্যি, আবার বাঙালিরা বিহারী মেরেছে এই সত্যিও বেমালুম ভুলে যেতে চাইনা। তাহলে তো আমাকে পাহাড়িদের কথাও ভুলতে হবে, নারীর অবমাননায় নিশ্চুপ থাকতে হবে, নিম্নবর্গের মানুষকে তাচ্ছিল্য করতে হবে।
আমার মনে হয় সামহোয়ারের ভার্চুয়াল মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত করা দরকার। আমার পর্যবেক্ষণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও সংকীর্ণ রয়েছে, যে সংকীর্ণতা দাড়ি-টুপি মানেই রাজাকার, মোল্লা এই ভাবনার জন্ম দেয়। অথচ আমি ফরেন প্রেসের মুক্তিযুদ্ধের কাভারেজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে রাজাকার হিসেবে ঐ সময়ে যাদের ছবি ছাপা হয়েছে তাদের অনেকেরই কোনো দাড়ি ছিলনা। পাড়ার মাস্তান টাইপ, বখাটে চেহারা। এধরনের সরলীকরণে ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে জামাতের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। আমি 'মাটির ময়না' ছবির কাজী চরিত্রটির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করতে চাই। কাজীরা ব্রিটিশ-হিন্দুদের সম্মিলিত বঞ্চনা এড়াতে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল। তার মধ্যে গলদ ছিল দ্রুত প্রমাণ হয়েছে, কিন্তু সেই পাকিস্তান ছিল তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন খান খান হয়ে যেতে দেখে তিনি হতাশ হয়েছেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে মানতে পারেননি, কিন্তু তিনি তো রাজাকারদের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা করেননি। তিনি গোঁড়া ছিলেন, ছেলেকে মাদ্রাসা পাঠিয়েছেন হিন্দুয়ানি প্রভাবমুক্ত রাখতে, কিন্তু তিনি শেষপর্যন্ত রাজাকারি করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় টুপিওয়ালা এরকম অনেক লোক ছিলেন, কিন্তু আপনি যদি তাকে রাজাকার বলেন, তবে আপনার শত্রুসংখ্যা আরও বাড়লো।
এই পোস্টের পর আমার প্রিয় অনেক ব্লগার যেমন এস্কিমো, রাশেদ, জেনারেল, হাসিব, মুকুলসব আরও অনেকে আমাকে আর আগের মতো দেখবেননা, ভাববেননা জানি; তাদের নির্বাচিত পোস্ট বা লিঙ্ক থেকে আমাকে সরিয়েও ফেলতে পারেন, আমার ভাগ্যে অনেক গালাগালি ও নাম্বার ৫-ও জুটতে পারে। কিন্তু একথাগুলো আমি বলেছি বিশ্বাস করে।
জামাতী মতবাদে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, অকুণ্ঠ সমর্থন বা বাহবা দেবেন না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৯:১৬