বৈশাখ এখন বাঙালির সবচেয়ে বড় উত্সবে পরিণত হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১ বৈশাখে ঘর থেকে বের হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। তাদের গন্তব্য ছিল রমনা বটমূল, টিএসসি, চারুকলার চত্বর এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল। বিভিন্ন জায়গায় জমে উঠেছিল বৈশাখী মেলা। এই লাখ লাখ মানুষের জন্য যানবাহন সহজলভ্য ছিল না। মানুষ চৈত্রের দহনকে উপেক্ষা করে দীর্ঘপথ হেঁটে আনন্দ-উত্সবে অংশ নিয়েছে, বরণ করেছে বৈশাখকে ।
বৈশাখের এ উত্সব, মানুষের সর্বজনীন এ অংশগ্রহণ দুই দশক আগেও এরকম ছিল না। বৈশাখের উত্সব আমেজ, ভালো রান্না আর অনুষ্ঠানমালা সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনা কিছু মানুষের মধ্যে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান হতো বটতলায়। সেখানেও অংশগ্রহণ ছিল সংস্কৃতিকর্মী ও মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণীর। গত দুই দশক ধরে বৈশাখ বরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বৈশাখ বরণের রং মধ্যবিত্তের গ ি পেরিয়ে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। বৈশাখের অনুষ্ঠানে বেড়ে চলেছে সর্বশ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ। আর গত একদশকে এটি চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করেছে। এখন বৈশাখে মানুষ ঈদ আর পূজার মতো নতুন কাপড় কিনছে। ঘরে ঘরেই তৈরি হচ্ছে মুখরোচক খাদ্য। একজন অন্যজনকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করছে বৈশাখের আয়োজন কি? বৈশাখের পোশাক কেনা হয়েছে কিনা। নিম্নবিত্ত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও বৈশাখের জন্য আলাদা করে রাখছে তার ঘামে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ। সাধ্যমত গায়ে তুলছে বৈশাখের পোশাক। ঘুরতে বের হচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে। মেলা থেকে কিনে আনছে শৌখিন কিছু।
১ বৈশাখে উত্সবের এ আমেজ, জাতির অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন আয়োজনকে নিয়ে বিভিন্নজনের মত বিভিন্ন রকম। বাঙালি উত্সব প্রিয়, বাঙালি হুজুগে। যখন যা মনে চায় তাই করে। বাঙালি অনুকরণপ্রিয়। অন্যের দেখাদেখি না বুঝেই অনুকরণ করা শুরু করে। আবার অনেকের ধারণা, ১ বৈশাখ নিয়ে এ মাতামাতি মিডিয়ার সৃষ্টি। ব্যবসায়িক একটা চাল। ফ্যাশন হাউসগুলোর কারসাজি পোশাক বিক্রির কৌশল। অর্থাত্ পুঁজির প্রচ্ছন্ন হাতের খেলা। বৈশাখকে নিয়ে এ ধরনের নানা মন্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি যাই থাক না কেন, এটি সত্য যে বৈশাখ বরণ এখন একটি সর্বজনীন স্থায়ী উত্সবে রূপ লাভ করেছে এবং প্রতিবছরই এটি আরও বৃহত্ ও ব্যাপক আয়োজনের জন্ম দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে বৈশাখ নিয়ে প্রচ আগ্রহ এবং উত্সব পালন নিয়ে এক ধরনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দেখা দিয়েছে। বৈশাখ উদযাপন তাই এখন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শ্রেণীভেদে নতুন এক মাত্রা লাভ করেছে।
বৈশাখ উদযাপনের এ প্রস্তুতি, উত্সবের আমেজ, অংশগ্রহণে সর্বজনীনতা যেমন প্রাণে উচ্ছ্বাস জাগায়, তেমনি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বর্ষবরণের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে একটি প্রশ্নও সামনে এসে পড়ে বৈশাখ বরণের এ ব্যাপক প্রস্তুতি আমাদের আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে তুলে ধরতে, তাকে টিকিয়ে রাখতে ও লালন করতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে। বৈশাখ বরণের এ সাজসাজ রব, বৈশাখ নিয়ে এত জল্পনা-কল্পনা, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, সাধারণ গৃহজীবন থেকে বের হয়ে আনন্দ-উত্সবকে ভাগ করে নেয়া। বৈশাখের জন্য প্রতীক্ষা সবকিছুর পরও বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ও ঐতিহ্য ধারণের ক্ষেত্রে বৈশাখ বরণের এ ব্যাপক প্রস্তুতি ও ডামাডোলে খুব একটা আশার বার্তা পাওয়া যায় না। বৈশাখ বরণের এ মহাযজ্ঞ যেন পুরোটাই একটা ক্রেজ ও উন্মাদনা। একদিনের বিলাস ও বাঙালিত্বের ভান। বৈশাখ এখন এক ধরনের ফ্যাশন। ১ বৈশাখে বাঙালি সাজতে হবে, ফ্যাশন হাউস থেকে একটা বাংলাগানের কলি অথবা একতারা ছাপ মারা ফতুয়া পরে রমনায় গিয়ে পান্তা-ইলিশ খেতে হবে, চেঁচিয়ে বাংলাগান গাইতে হবে—এটাই আধুনিকতা স্মার্টনেস। বৈশাখে এই ভড়ংটুকু না ধরলে ইজ্জত থাকে না।
বাঙালি সংস্কৃতির মূল যে বিষয়গুলো আবহমান কাল ধরে বাংলায় বৈশাখ বরণের যে ঐতিহ্য ও যে কৃষ্টি, যে রীতি তার সঙ্গে বর্তমান বৈশাখ বরণের কোনো মিল নেই। হাল ফ্যাশনের পান্তা-ইলিশ খাওয়া বাংলার আবহমান কৃষ্টির কোনো ধারাবাহিকতা নয়। এটি সত্য যুগের চাহিদা আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ব্যবধান যে কোনো উত্সবের পালনে কিছু ভিন্নতা সৃষ্টি করবে। এটিই সময়ের প্রবাহ। তারপরও যে কারণে এ উত্সবের জন্ম, যে স্বাতন্ত্র্য আর স্বকীয়তায় বৈশাখ বরণ উজ্জ্বল ও অনন্য এক উত্সব—তাকেই যদি ছেটে ফেলা হয় তবে এ আয়োজনের প্রয়োজনটা আর থাকে কোথায়?
বৈশাখ উদযাপনের এ ভিন্নতা, পুঁজিবাদী চরিত্রের কথা বাদ দিলেও বৈশাখ উদযাপন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, বাংলার গৌরবান্বিত অতীতকে সামনে এনে এ প্রজন্মকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলায় কি অবদান রাখছে? বাংলা, বাংলাভাষা আর বাংলা সংস্কৃতিকে এ প্রজন্ম কতটুকু ভালোবাসছে, কতটুকু প্রাণে ধারণ করছে? একদিন খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে বৈশাখ উদযাপন করলে আর জোরে জোরে বাংলাগান বাজালেই সংস্কৃতি চর্চা হয় না, বাংলাকে ভালোবাসা হয় না।
বৈশাখ উদযাপনকে প্রাণের টানের উত্সব, নাড়ির উত্সব বলা হলেও নতুন প্রজন্মের কাছে বৈশাখ অথবা বাংলা কোনোটাই খুব প্রাণের হয়ে উঠছে না। বৈশাখ বরণকে তার আবহমান বাংলার ধারা, নিজস্ব কৃষ্টি, ঐতিহ্য হিসেবে দেখছে না। তারা এটাকে এক ধরনের আনন্দ-উল্লাস ও একটা দিন একটু হৈচৈ করে কাটানো মনে করে। বাউল গানের সুরে নেচে নেচে ফুর্তি করা মনে করে। বাংলাকে তারা প্রাণের ভেতরে ধারণ করতে পারছে না। বাংলা আমার এ মাটির, বৈশাখ আমার স্বকীয়তা, আমার অহঙ্কার এ বোধ তাদের মধ্যে জাগরিত হচ্ছে না।
তাই প্রাণের মেলা, সর্বজনীন বড় উত্সব হিসেবে বৈশাখ বরণ আমাদের প্রাণের ভেতরে কোনো আশার সঞ্চার করে না। লাখো মানুষের ভিড়, উত্সব আমেজ বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ লালন ও চর্চায় অর্থবহ হয়ে ওঠে না। এ উত্সব, এ বিশাল সমাবেশ আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উন্নয়নে স্থায়ী কোনো প্রভাবই রাখে না। সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই সীমিত থাকে আমাদের বাংলার প্রতি ভালোবাসার স্ফুরণ ও নাচন। একদিনই বাংলা মায়ের দাবি মিটিয়ে বাংলার জন্য কর্তব্য শেষ করা হয়।
বাংলা সংস্কৃতির চর্চা থেকে দিন দিনই দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম। তারা বাংলায় ভালো করে কথা বলে না। বাংলা উচ্চারণ জানে না। বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলে। বাংলা গান শোনে না। তাদের পোশাক-আশাকও এ দেশের সংস্কৃতি বিবর্জিত। বাংলা সংস্কৃতিকে বিদায় জানিয়ে তারা ভিনদেশী সংস্কৃতি চর্চাতেই বেশি অভ্যস্ত । এ দেশ, এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তারা এত হেয় করে দেখে, এত বেশি বিদেশি সংস্কৃতির বন্দনা করে যে ভাবতে কষ্ট হয় আমরা এ দেশের সন্তান, আর ওরা আমাদের সন্তান।
বৈশাখ উদযাপনে প্রাণের এ সাড়া, হৃদয়ের টানে ছুটে আসার লক্ষ্য যদি এদেশ, এ মাটি ও এ বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির টানে না হয়ে শুধু একটি হুজুগের বিষয়ে পরিণত হয়, শুধু উত্সব উত্সব খেলা হয়, তবে তা বাংলা সংস্কৃতিকে ধরে রাখা ও তার বিকাশে কোনো অবদানই রাখতে পারবে না। মূলের দিকে ফেরা, নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করা মূল্যবোধগুলো চর্চায় এ উত্সবের কোনো ভূমিকাই থাকবে না। হয়ত বৈশাখ বরণের এ উত্সব আরও বৃহত্ হতে বৃহত্তর হয়ে উঠবে, ফ্যাশন হাউসগুলোয় ভিড় আরও হয়তো বাড়বে, পান্তা-ইলিশের হুজুগে ইলিশের দাম হয়তো আরও আকাশচুম্বী হবে, ব্যবসার আরও স্ফীতি ঘটবে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বৈশাখ বরণ তা কখনোই পূর্ণতা পাবে না। বৈশাখকে ঘিরে কলহাস্য, কলোরব আর এর কলেবর বৃদ্ধি পাবে কিন্তু দিন দিন বাংলার কৃষ্টি আর ঐতিহ্য অপসৃত হতে থাকবে। কারণ বেলুন যতই ফাঁপানো হোক না কেন, তার ভেতরে শুধু বাতাস ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে, মূলের বিকৃতি ঘটিয়ে বৈশাখ নিয়ে যতই মাতামাতি হোক না কেন, তাতে প্রকৃত কোনো মঙ্গল আসবে না। বাংলা সংস্কৃতির উন্নতি চাইলে, নতুন প্রজন্মের কাছে তা তুলে ধরতে হলে সেভাবেই বাংলাকে সাজাতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে এবং সেভাবেই নতুন প্রজন্মের কাছে তা উপস্থাপন করতে হবে । বিকৃত বা খ িত উপস্থাপন তাদের শুধু ভুল আর বিকৃত বিষয়ই শেখাবে, মূল জিনিসের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। হাজারও মানুষের এ মিলনমেলাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। এখান থেকেই বীজ বপন করতে হবে। বৈশাখ বরণের এ আয়োজন, এ প্রাণের মেলাকে তাই আমরা স্বাগত জানাই, তবে এর মধ্যে কিছু সারবত্তা থাকতে হবে, তাতে প্রকৃত প্রাণের স্পন্দন মেলাতে হবে তবেই এ প্রাণের মেলা, জনতার এই ঢল আর এ উত্সব শুভ-সুন্দর ও কল্যাণময় হয়ে উঠবে।