(ছবি কৃতজ্ঞতায় - অমি রহমান পিয়াল)
বিশ্বায়ান আর এক কেন্দ্রিক পরাশক্তির কারনে বিশ্বের মোড়ল হিসাবে এখন আমেরিকার কোন প্রতিদ্বন্দী নাই। সেই বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া সত্যিকার অর্থেই একটা ডেসপারেট মুভ নিয়েছেন। উনার সামনে আর কি বিকল্প ছিলো! যুদ্ধাপরাধের বিচারের এই পর্যায়ে খালেদার রিজার্ভ ফোর্স জামাত/শিবিরের ক্যাডাররা ব্যস্ত সন্ত্রাসে - তাদের বিষয়ে জনমত একটা ফাইন লাইনে চলছে। যদি জামাত/শিবির এইভাবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে থাকে তবে তাদের ভোট কমবে এবং তাদের মিত্র হিসাবে বিএনপির উপর জনসমর্থনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই সময়ে খালেদা জিয়া ঘোমটা পুরোটাই খুলে নাচতে নেমেছেন - যদি আগে গোপনে আমেরিকায় লবিষ্ট নিয়োগ করেছিলেন বিস্তর ডলার খর্চা করে - তার ফলাফল তেমন আসেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াত্ব নতুন না। আগেও বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন উনারা - অহরহ দিচ্ছেন। কিছু দিন পরপর দেখি কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশীরা দেশের রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসাবে কানাডা সরকারের কাছে দরখাস্ত দেয় - বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানান নালিশ করে। কিন্তু তাতে তেমন কোন কাজ হয় - কারন দেখলাম কানাডার ইমিগ্রেশন বিভাগ বাংলাদেশকে একটা নিরাপদ দেশ হিসাবে নতুন ভাবে তালিকা ভুক্ত করেছে - সুতরাং রাজনৈতিক কারনে রিফিউজী হিসাবে কানাডায় এসে লাভ হবে না। এর পিছনে বিরাট বাণিজ্য মার খেয়ে যাচ্ছে - সেই বিষয়ে অন্য একসময় বলবো। শুধু বলে রাখি - বিদেশে দেশের বিরুদ্ধে নালিশ করার পিছনে রাজনীতির চাইতে অভিভাসন বাণিজ্যই বেশী ভুমিকা রাখে।
কিছু কাল আগেও খালেদা জিয়ার প্রিয় শ্লোগান ছিলো - বিদেশে আমাদের প্রভু নাই - কিন্তু সেইটা ছিলো মুখে মুখে - ভিতরে ভিতরে প্রভুদের তুষ্ঠির নগদ নারায়নের বিষয়ে উনাকে ব্যষ্ত দেখা গেছে। ইউএস ফেডারেল জাস্টিজ বিভাগের ওয়েব সাইট থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় উনি ২০০৭ সালে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার দিয়ে একটা লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিলেন। এবার আর ঘুরাপথে না গিয়ে ঘোমটা খুলেই নেমে পড়েছেন - পেটে ক্ষমতার ক্ষিদা রেখে লজ্জা না করাই ভাল। সেই হিসাবে এই লেখালেখি অনেকটাই যৌক্তিক।
যাই হোক - খালেদা জিয়া আমেরিকার ওয়াশিংটন টাইমস ( পোস্ট না) এর মতামত বিভাগে একটা বিবৃতি ছাপিয়েছেন। সাদা চোখে দেখলে এইটা কোন বড় বিষয় না। বাংলাদেশের পত্রিকায় চিঠিপত্র বিভাগের মতো মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নন হিসাবে অনেকে অনেক কিছু লেখেন - তেমনি খালেদা জিয়া একটা বিবৃতি ছাপিয়েছেন - যা বাংলাদেশের অনলাইন কমিউনিটি প্রচুর হিট করে টপ লিস্টে তুলে দিয়েছে এবং যথারীতি গালাগালি সমৃদ্ধ করেছেন। এতে কার কি লাভ হয়েছে জানি না - একটা লো-প্রোফাইল পত্রিকা হটাৎ প্রচুর হিট পেয়ে র্যাংকিং এ অনেকটা উপরে উঠে গিয়ে হয়তো ব্যবসায়ীক ভাবে লাভবান হবে। এই বিষয়ে হৈ চৈ না করে যদি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর একই ভাবে তাদের বক্তব্য পাঠিয়ে দিতো - মামলা খতম হয়ে যেতো। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গা। বেগম খালেদা জিয়া এই বিবৃতিতে কিছু কথা বলেছেন যা ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যাচার। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বক্তব্যগুলো আসলেই হজম অযোগ্য - যার প্রতিবাদ না করা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
খালেদা জিয়ার ওয়াশিংটন টাই্মসের অপিনিয়ন বিভাগে কমেনটারী লেখার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক না - অবশ্যই এইটা উনার মতপ্রকাশের অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সেই লেখার ভিতরের বক্তব্যগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন তোলা এবং তার ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে। বিশেষ করে একটা দেশের কিছু ষ্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে পরাশক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করার যে ভয়াবহ পরিনতি পাকিস্তানীরা দেখছে ড্রোন আক্রমনের মাধ্যমে - সেই দিক বিবেচনা করে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য প্রদানের বিষয়ে প্রতিটি নাগরিকের সতর্ক থাকা এবং খালেদাকে প্রশ্নের সন্মুখিন করা একটা অবশ্য কর্তব্য হিসাবে দেখা দিয়েছে।
যদি আমরা বিবৃতির উল্লেখ্যযোগ্য অংশগুলো ব্যবচ্ছেদ করি - তাহলে দ্বিমতের কোন অবকাশ থাকবে না যে খালেদা জিয়া ক্ষমতার জন্যে অন্ধত্ব বরন করেছে এবং তাকে থামানোর জন্যে দেশবাসীকে ঐক্যব্ধ হওয়া জরুরী - নতুবা যে সর্বনাশ পাকিস্তানে হয়েছে - বাংলাদেশও সেই পরিনতির দিকে যাবে।
দেখা যাক উল্লেখযোগ্য অংশগুলো।
১) পদ্ম সেতুর দূর্নীতি - পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক ২ বিলিয়ন ডলার ঋনের পরিমানের কথা বলেছেন - যা আসলে ১.২ বিলিয়ন ডলার। সংখ্যার এই হেরফের উনার পদ্ম সেতু তথা তথ্যের বিষয়ে সিরিয়াসনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
২) পদ্ম সেতুর দূর্নীতিতে যতটা নির্বাচিত কর্তারা জড়িত ততটাই আমলা এবং টেকোক্রেটরা জড়িত - তার মানে বাংলাদেশের পুরো ব্যবস্থাপনার দূর্নীতির বিষয়ে একটা তথ্য উনি আমেরিকার জনগনের উদ্দেশ্যে বলছেন - কিন্তু যদি কেউ বাংলাদেশের দূর্নীতি নিয়ে গুগোল সার্চ করে তবে উনার ছেলে কোকোর নামই উঠে আসবে - যা উনার জন্যে বুমেরাং হয়ে উঠেছে।'
৩) খালেদা জিয়া এবং উনার উপদেষ্টার এখানে ড. ইউনুসকে ট্রাম কার্ড হিসাবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছেন - যদিও ড. ইউনুস বয়সসীমা লংঘন করে পদ আকড়ে থাকায় সরকার তাকে পদচুত্য করার সুযোগ পেয়েছে এবং ইউনুস সাহেব সর্বোচ্চ কোর্টে গিয়ে মামলায় হেরেছেন। যখন কেউ জানবে যে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে উনি পদ ছেড়েছেন - এখানে বেগম জিয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়কেও আমেরিকানদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে উপস্থাপন করেছেন।
৪) "Now Ms. Hasina is attempting to remove from the constitution the need for a caretaker government -- six months before the election. " - এইটা একটা মিথ্যাচার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের ছয় মাস আগে নয় বহুআগেই বাতিল করেছে কোর্ট এবং এই ধরনের সরকার আনলে তা কোর্টে চ্যালেঞ্চের মুখে পড়ার সম্ভাবনা আছে। দু্ইদল মিলে বিকল্প কিছু একটা বের না করে বিদেশে নালিশ করার জন্যে মিথ্যাচার করা ঠিক হয়নি।
৫) যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথা বলাটা খালেদাকে জামাতের এজেন্ট মনে হয়েছে। জামাত মিলিয়ন ডলার খরচ করে যা বলার চেষ্টা করেছেন - বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের পক্ষে সেই কথাগুলোই বলেছেন - সা সত্যই লজ্জাষ্কর বাংলাদেশের জন্যে। খালেদা জিয়া আবারো প্রমান করলেন উনি বাংলাদেশের না - জামাতের মিত্র।
৬) সবচেয়ে মজার যে কথাটা খালেদা জিয়া বলেছেন - তা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা এক পরিবারের হাতে চলে যাওয়ার কারনে গনতন্ত্রের ক্ষতি হবার আশংকা প্রকাশ - " If Bangladesh succumbs to the rule of one family, it would be a major step backward for the region." -বেগম জিয়ার উপদেষ্টারা আসলেই বুদ্ধির জড়তায় ভুগছে - না হলে এই ধরনের কথা কিভাবে উনি বলেন। বলাই বাহুল্য উনি শেখ হাসিনাকে টার্গেট করেছেন - আশংকা থেকে যে জয় রাজনীতিতে আসবে। কিন্তু উনার ছেলে তারেকে তো উনি উনার পিছনে লাইন করিয়ে রেখেছেন ক্ষমতার জন্যে। একপরিবারের ক্ষমতা দখলের আশংকা তো উনিও তৈরী করেছেন।
৭) পুরো লেখায় শেখ হাসিনার নাম এসেছে ৯ বার - প্রায় সবগুলোই অত্যান্ত দূর্বল ভাবে অভিযোগের সুরে, যেমন- কেন শেখ হাসিনার নবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত না তার কারন হিসাবে উনি বলছেন - Most Bangladeshis would disagree that Ms. Hasina has any claim on the prize. Just ask the families of some 300 people who have been registered as missing since 2009 at the hands of Ms. Hasina's Rapid Action Battalion — a paramilitary wing of the police - রেবের হত্যাকান্ডের কারনে শেখ হাসিনা নবেলের অনুপুযুক্ত - হাস্যকর এই কথাগুলো যে উপদেষ্ঠা লিখেছে তাকে বিএনপি থেকে বের করে দেওয়া উচিত - কারন এরা বিএনপিকে দল হিসাবে হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছে।
মজার বিষয় হলো এই বাহিনী কিন্তু খালেদা জিয়াই বানিয়েছিলেন এবং আমেরিকার সাথে চুক্তি্ও করেছিলেন প্রশিক্ষনের সহায়তার জন্যে। সেখানে - শেখ হাসিনার রেপিট একশন বেটেলিয়ান কথাটা কেমন জানি সস্তা অভিযোগ হিসাবে আসছে না!
একটা দেশের রাজনৈতিক বিরোধকে দাম্পত্য কলহের সাথে তুলনা করাটাই নিরাপদ - নতুবা এই কলহের কথা বাইরে প্রকাশ পেলে দুইদলেই ক্ষতির সম্ভবনা থাকে। নিজের দেশের মানুষের উপর নির্ভর করেই রাজনীতি করা ভাল। নতুবা ধার করা লাঠিতে ভর দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বিপদ হলো যে কোন সময় লাঠি মালিকের হাতে চলে যেতে পারে।
বেগম খালেদা জিয়ার এই লেখক হয়ে যাওয়া অথবা উপদেষ্টাদের অতি উৎসাহের কারনে উনি যেভাবে পরাশক্তিকে বাংলাদেশের উপর হস্তক্ষেপের জন্যে আহ্বান জানালেন - তা সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া চরম আস্থাহীনতায় ভুগছেন। যেন যেত ভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার মিশন হিসাবে উনার ভারত সফরও অনেককে অবাক করেছে - বিশেষ করে ভারতের নেতৃত্বের কাছে বাংলাদেশের মাটিকে ভারত বিরোধী সন্ত্রাসের জন্যে ব্যবহার না করতে দেওয়ার অংগীকার অনেকের জন্যে খটকা লেগেছে। পুরো বিষয়টা আমি দেখছি একজন মরিয়া হয়ে উঠা মায়ের ছেলেদের বাঁচানোর চেষ্টা হিসাবে। বিএনপির দূর্বল এবং জড়তায় আক্রান্ত নেতৃত্ব আর কর্মীরদের সাথে দলের বিচ্ছিন্নতা খালেদা জিয়াকে হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
শেষ কথা হলো - খালেদা জিয়ার এই বিবৃতি ছাপানোর বিষয়টি যথেষ্ঠ গুরুত্বের সাথে আলোচিত হবে সর্ব মহলে এবং হয়তো আগামী নির্বাচনে বিএনপির ভুমিকা আর তার ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করবে খালেদা জিয়ার এই সর্বমূখী মরিয়া হয়ে ক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা এবং বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষের সুষ্পষ্ট অবস্থানের উপরেই।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৬:১৫