somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা - শেষ পর্ব।

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুদ্ধে নিহতদের নিয়ে সবচেয়ে অবাক হবার মতো সংখ্যা পাওয়া যাবে আশির দশকে ঘটে যাওয়া ৯ বছর ব্যাপী ইরান- ইরাক যুদ্ধে। সেখানে ইরান এবং ইরাকের প্রদত্ত্ব সংখ্যা যোগ দিলে দেখা যাবে যে, ইরাকের হিসাব মতে ইরানে মোট জনগোষ্ঠিকে কয়েকবার হত্যা করেছে ইরাক। ঠিক একই ভাবে ইরানও তাদের হিসাবে মতে কয়েকবার ইরাকের মোট জনগোষ্ঠীকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিল।



এবার দেখা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা গননায় কি হয়েছিল। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে - ঐ যুদ্ধে বিবদমান সকল দেশের হতাহতের নিজস্ব হিসাব আছে। এখানে বিজয়ী দল যা বলেছে পরাজিতরা সেটাই মেনে নিয়েছে। যেমন বলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লক্ষ ইহুদী নিহত হয়েছে। এটা এখন পশ্চিমা বিশ্বের জন্য আইন হিসাবে চালু হয়েছে। এটাকে এন্টি সেমেটিক আইনের আওতায় বিবেচনায় যদি কেহ ৬০ লক্ষ ইহুদী নিধন নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলে বা গবেষনা করার চেষ্টা করে তবে তাকে জেলে যেতে হবে। এই অপরাধে জেনডাল নামে এত জার্মান দেশ থেকে পালিয়ে ক্যানাডা এবং পরে আমেরিকা গিয়ে বাঁচতে পারেনি - ফেরত নিয়ে গিয়ে তার বিচার চলছে জার্মানের এক আদালতে। গত বছর অস্ট্রিয় এক আদালতে ডেভিড আরভিং নামে এক ইতিহাসবিদকে “হলোকাস্ট” অস্বীকার করার অপরাধে জেলে পাঠায়। এই তালিকা অনেক লম্বা করা সম্ভব। মুল কথা হলো ২য় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ইহুদীদের সংখ্যা ৬০ লক্ষ এবং সেটা নিয়ে কেহ প্রশ্ন করতে পারবেন না। কেহ জানতে চাইতে পারবেন না কিভাবে এই সংখ্যাটা পাওয়া গেল।



এবার আসা যাক ২য় প্রশ্নে - একটা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো নারী নির্যাতন। কিন্তু তার প্রকৃত সংখ্যা কি নির্ধারন সম্ভব। উত্তর নেতিবাচকই হবে। আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক কালে ভয়াবহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বসনিয়ায়। যদি পৃথিবীর সকল বিশেষজ্ঞকে এক করে প্রশ্ন করা হয় বসনিয়ায় নির্যাতিত নারীর প্রকৃত সংখ্যা কত - নিশ্চিত ভাবে এরা কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিতে ব্যর্থ হবেন। এখানে বিষয়টা অত্যান্ত বাস্তব যে, একজন নির্যাতিত নারী রেডক্রসের রিলিফের জন্য “নির্যাতিত নারী” হিসাবে নাম লিখাতে যাবে না বা এরা বলে বেড়াবে না যে এরা নির্যাতিত হয়েছিলেন। এটা বাংলাদেশের মতো রক্ষনশীল দেশের জন্যে আরো বেশি সত্য। তবে এটাও সত্য যে - যদি কোন দিন সুযোগ আসে (আসবে ইনশাআল্লাহ) তখন নিশ্চয় অনেক সাহসী নারী এগিয়ে আসবেন তাদের অপমানের কথা বলতে।

সুতরাং একটা যুদ্ধে নিহত এবং নির্যাতিতাদের সংখ্যা নির্নয়ের ক্ষেত্রে আদমশুমারীর মতো শান্তিকালীন প্রক্রিয়ার প্রয়োগের চিন্তা করা একটা কল্পনা মাত্র। তার পরও একটা প্রাক্কলিত সংখ্যাকে বাস্তবতার নিরিখে গ্রহন করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে। নীচে একটা তালিকাটায় দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন মিডিয়াতে যে হিসাব দিয়েছিল - তার থেকেই বাংলাদেশের তৎকালীন নেতারা সর্বোচ্চ সংখ্যাটা গ্রহন করেছেন।



কে রিপোর্ট করেছিল | কখন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল | সংখ্যাটা কত ছিল
১) বাল্টিমোর সান - মে ৫, ১৯৭১ - ৫ লক্ষ
২) দ্যা মোমেন্টো, কারাকাস - জুন ১৩, ১৯৭১ - ৫ - ১০ লক্ষ
৩) Washington Daily News - জুন ৩০, ১৯৭১ - ২ লক্ষ
৪) World Bank Report - জুন ১৯৭১ - ২ লক্ষ
৫) Die Zeit, Bonn - জুলাই ৯, ১৯৭১ - ৫ লক্ষ
৬) New York Times - জুলাই ১৪, ১৯৭১- ২ - ২.৫ লক্ষ
৭) Wall Street Journal - জুলাই ২৩, ১৯৭১ - ২ - ১০ লক্ষ
৮) The Christian Sci. Mon জুলাই ৩১, ১৯৭১ - ২.৫ - ১০ লক্ষ
৯) Newsweek - আগস্ট ২, ১৯৭১ - ২.৫ লক্ষ
১০) Time - সেপ্টেম্বর ২, ১৯৭১ - ২ - ১০ লক্ষ
১১) Newsweek - মার্চ ২৭, ১৯৭২ - ১৫ লক্ষ
১২) National Geographic - সেপ্টেম্বর ১৯৭২ - ৩০ লক্ষ


এখন প্রশ্ন আসে ত্রিশ লক্ষ কি আসলে শহীদ হয়েছিলেন? এই প্রশ্ন অনেকেই উত্থাপন করে বেশ আনন্দ পান আবার কেহ স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও এই প্রশ্নটি করেন। প্রশ্নের উত্তর হলো একটাই - হ্যাঁ, অবশ্য সংখ্যাটা বেশীও হতে পারে। যারা নদীর ধারে বাস করতেন - যারা পিতার লাশ সনাক্ত করার জন্যে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া অগনিত লাশের মিছিল দেখেছে - তাদের কাছে ৩০ লক্ষ সংখ্যাটা অনেক কম মনে হতে পারে।

আরো একটা প্রশ্ন আসে - কেন আমাদের জানতে হবে একটা নিদিষ্ট সংখ্যা। কেন কিছু মানুষ প্রকৃত সংখ্যা জানার জন্য অধীর। যদি আমরা বিস্তর শুমারী বা পরিসংখ্যানের পর জানতে পারি যে - প্রকৃত শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষের থেকে ১ লক্ষ কম বা এক লক্ষ বেশী তাতে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ভিন্ন ভাবে লিখা হবে? শহীদের সংখ্যা কমলে কি দালাল-রাজাকারদের অপকর্মের দায় কমে যাবে, নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের গুরুত্ব কমে যাবে? আসলে শুরুতে যা বলেছিলাম - যে দুই দল এই বিতর্কটা সৃষ্টির চেষ্টা করে তাদের মধ্যে অগ্রগামী হলো - ১৯৭১ সালের পরাজিত দালাল শ্রেনী এবং তাদের অনুসারীরা । তারা একটা পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই এটা করে। এরা ইদানিং এতোটা সাহসী হয়ে প্রকাশ্য বলার সাহস পায় এই বলে যে, আমাদের পুরোনো কথা ভুলে যেতে হবে। কেন ভুলে যেতে হবে - একদল লুটেরা দালালকে খুশী করার জন্য? প্রকৃত অবস্থা হলো এরা বিভিন্ন ভাবে বিতর্ক তুলে মানুষকে প্রকৃত ঘটনার থেকে আড়ালে নিযে যেতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ যত বেশী স্বাধীনতার ঘোষক, শহীদের সংখ্যা, দালালদের ক্ষমা করে দেওয়ার বিষয়ে বিতর্ক করে বিভক্তিতে পড়বে - দালাল-রাজাকারদের তত সুবিধা হবে - ততই তারা নিরাপদ অবস্থানে থেকে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার সুযোগ পাবে।

যেখানে স্বাধীনতার ৩৫ বছর পর কিছু মহল বিভিন্ন বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে আত্নত্যাগকারীদের অবদানতে হেয় করার প্রয়াস সেখানে পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্যে কিছু অবশ্য করনীয় আছে। যেমন -

১) যারা বিতর্ক সৃষ্টি করে তাদের চিহ্নিত করা। যদি তারা রাজাকারদের মতাদর্শের হয় - ওদের চিহ্নিত সুষ্পষ্ঠ ভাবে করা এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে ওদের সাথে যুদ্ধ শুরু করা। ওদের সাথে কুটতর্কে না জড়িয়ে ওদের পরিচয় মানুষের কাছে পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপন করা এবং এদের সামাজিক ভাবে কোনঠাসা করা। আর যদি বিতর্ক সৃষ্টিকারী কোন নতুন প্রজন্মের কোন একজন হয় - তবে ওদের কথা মনযোগ সহকারে শুনতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে ওদের বিভ্রান্তির কারন। যুক্তি এবং প্রমানসহ আন্তরিকভাবে ওদের সাথে বিতর্ক এবং আলোচনা করে তাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বুঝতে সাহায্য করা।

২) মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে এবং এর বিকৃতির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার হতে হবে।

৩) আমাদের মনে রাখতে হবে আত্নত্যাগকারী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন দিয়ে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমাদের জন্যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সেই মহামূল্যবান সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমরাদের সবার। তাই মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশ নিয়ে যতরকমের বিভ্রান্তিকর প্রচারনা তার বিরুদ্ধে আমাদের সোজা হয়ে দাঁড়ানো কর্তব্য।

আসুন, বিজয় দিবসে আমাদের শপথ হোক, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের মর্যাদা রক্ষায় সকল বিভ্রান্তিকর প্রচারনার বিরুদ্ধে আমাদের সকল মেধা আর শক্তি দিয়ে সংগ্রামই হবে আমাদের প্রধান কাজ।

(সমাপ্ত)

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা - ১ম পর্ব


মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা - দ্বিতীয় পর্ব।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১:০৩
১৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রসঙ্গঃ ডক্টর ইউনুস স্যারের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য...

লিখেছেন জুল ভার্ন, ৩০ শে মে, ২০২৫ সকাল ৯:০৪

প্রসঙ্গঃ ডক্টর ইউনুস স্যারের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য...

জাপান সফরে ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস স্যার উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন- "দেশের একটামাত্র দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়"।


কথাটা আংশিক সত্য।
কারণঃ
★ দেশে রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কৃমির হাজার বছরের ঘুম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩০ শে মে, ২০২৫ সকাল ১০:০৬




রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার পারমাফ্রস্টে ৩০০টি প্রাগৈতিহাসিক কৃমি আবিষ্কার করেছেন, যার মধ্যে দুটিকে সফলভাবে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছে। এই কৃমিগুলি হাজার হাজার বছর ধরে বরফে আটকা পড়ে ছিল, তবুও গলানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নির্বাচন চাইলে নির্বাচন কমিশনের কাছেই চাইতে হবে, ড. ইউনুসের কাছে নয়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ৩০ শে মে, ২০২৫ দুপুর ১২:১৯


বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে—বিএনপি আসলে নির্বাচন চায় কার কাছে? সম্প্রতি নানা বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, দলটি যেন নির্বাচন চাচ্ছে ড. ইউনুসের (অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টার) কাছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভাবে মটরবাইকে স্বস্ত্রীক ট্যুর দেই

লিখেছেন অপলক , ৩০ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৫০



আসলে আমি ফ্রিডম পছন্দ করি। আদেশে নয়, অনুরোধে মন গলে আমার। শহুরে হট্টগলের চেয়ে প্রকৃতি ভাল লাগে। দল বেঁধে ট্যুর দেবার চেয়ে একাকি ট্যুর দিতে ভাল লাগে। বনের কুকুররা... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি".....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ৩০ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৬

"বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি".....


বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হতে হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। হতে হবে সকল প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এই দর্শনের নিহিত রয়েছে আত্মসামাজিক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×