অস্ত্র কেনো রাখা হয়? চোর ডাকাত ধরার জন্য? নাকি সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস করার জন্য?
জানি প্রশ্নটা অসম্পূর্ণ হয়ে গেছে । এর উত্তর কেবল শর্তানুসারেই দেয়া সম্ভব ।
যেমন চোর ডাকাতকে ধরতে নিশ্চয় ড্রোন বিমান, মিশাইল, রাসায়নিক অস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র লাগেনা?
তাহলে এসব রাখা হয় কেনো? যাদের কাছে এসব অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রগুলো আছে, তারা এককথায় উত্তর দেবে সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস করে পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য ।
প্রশ্নের এধরণের উত্তর শোনেই আমরা অভ্যস্ত ।
শান্তিকামী মানবতাবাদীদের মন ভোলানো কথা শোনার আগে পরিসংখ্যানে দেখে নিই, কারা এই অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের স্রষ্টা ও সরবরাহকর্তা ?
বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যে ৩০ শতাংশ অংশদারীত্ব নিয়ে প্রথম অবস্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২৬ শতাংশ অংশদারীত্ব নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে রাশিয়া । এ তালিকায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আছে যথাক্রমে জার্মানি, ফ্রান্স ও চীন ।সূত্রঃ এখানে ক্লিক করুন
অস্ত্র বাণিজ্য শব্দটা যখন এসে গেছে তখন এর প্রায়োগিক ক্ষেত্রের প্রসঙ্গটা এড়ানোর সুযোগ নেই । প্রশ্ন না করতেই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আমরা যে উত্তর পাবো তা হোলো-
সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক শান্তিরক্ষীবাহিনী, বিশেষ সৈন্যবাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ দমন, গৃহযুদ্ধের অবসান ইত্যাদি।
এটা কাউকে বলে দিতে হবেনা যে, যতো রকম জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ ইস্যু আছে তা সিংহভাগেরেও অধিক মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে ।
মধ্যপ্রাচ্যের নাম শুনলেই সারা পৃথিবীর চোখের সামনে ভেসে আসে জঙ্গি সংগঠন গুলোর জঙ্গিবাদের চিত্র ।
কানে ভেসে আসে জেহাদ নামের বিষাক্ত একটা উচ্চারণ । আর মুখ ভরে থুথু আসে ঐ জেহাদী কট্টরপন্থী মোসলেমদের হাতে অস্ত্র দেখে । শান্তি প্রিয় মোসলেমরা কানে আঙ্গুল গুঁজে বলে ইসলাম শান্তির ধর্ম ।
কারো যেনো কোনো দায় নেই; সব দায় বুঝি ঐ জঙ্গিদের, মোসলেম জাতিটির !
অথচ যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গিবাদ দমনকরার নামে অথবা পারমাণবিক অস্ত্ররাখার সন্দেহবশত অথবা সরকারপক্ষের সাথে বিরোধীপক্ষের গৃহযুদ্ধ থামানোর কথা বলে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেয় । কিন্তু দেখা যাবে তাদের চাপিয়ে দেয়া গণতন্ত্রের ফলেই মোসলেম দেশে গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি । জঙ্গিবাদ দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বাড়িঘর উড়িয়ে দিয়ে কবরস্থানে পরিণত করে । বাদ যায় না নারী শিশু । ধর্ষণের চিত্র মিডিয়ায় ভেসে আসেনা । শিরোনামে ভাসে শুধু "জঙ্গিবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সফল অভিযান !" আর জাতিসংঘ মুচকি হাসিতে সাফল্যের পোজ দেয় ।
এতো বড় অন্যায়ের ক্ষীণকন্ঠে সামান্য প্রতিবাদ আসলেও প্রভূত্বের তাবেদারির বাতাসে তা মিশে যায় । বিশ্ববিবেক তখন যেনো অট্টহাসি দিতেও ভয় পায়।
ওদিকে নিঃস্ব-অসহায়-নির্যাতিত-গৃহহারা মোসলেম জাতিটি থেকে প্রতিবাদ স্বরূপ জন্ম নয় এক একটা সশস্ত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী । পরবর্তীতে যাদের নাম হয় তালেবান, আল কায়েদার মতো জঙ্গি দল ।
সম্প্রতি একটা ভাষণে হিলারি ক্লিনটন নিজেই স্বীকার করে বলেছেন, "We created Al-Qayeda"
সূত্রঃ ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন
আল কায়েদা যে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা মদদপুষ্ট, এসম্পর্কে Michel Chossudovsky এর দেয়া সাক্ষাতকারকে উড়িয়ে দেয়া যায়না ।
সূত্রঃ মাইকেল চসুডোভস্কির সাক্ষাৎকারটি পড়ুন
ইরাকের ISIL জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কে লেবাননের দৈনিক আদ দিয়ার পত্রিকাটি সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করেছে । বলা হয়েছে সংগঠনটির নেতা আবু বকর আল বাগদাদী ইহুদি পরিবারের সন্তান । তার প্রকৃত নাম শামউন ইয়লুত । এ তথ্যের সূত্র বেরিয়েছে আমেরিকার জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা NSA'র সাবেক কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা দলিল-দস্তাবেজ থেকে ।
এর আগেও স্নোডেনের ফাঁস করা দলিল থেকে জানা গেছে, ইসরাঈলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কথিত আবু বকর আল বাগদাদীকে এক বছর ধরে ধর্মীয় ও সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং জেহাদ ও ইসলামের নামে ইসরাঈলের নিরাপত্তাবিরোধী বিশেষতই মোসলেম দেশগুলোতে সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্যই ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা MI-6, ইসরাঈলের মোসাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের CIA-এর তত্ত্বাবধানে জন্ম দেয়া হয়েছে ISIL-এর ।
অর্থ্যাৎ ব্রিটেন -যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাঈলের ঔরসে জন্ম নিলো জঙ্গি সংগঠন ISIL.
এটার যে যথার্থই সত্যতা রয়েছে, তার প্রমাণ মেলে আল-জাজিরা খবরে । সেখানে গত ২২.০৬.২০১৪ তারিখের টাইমলাইনে বলা হয় ISIL using US vehicles to fight Syria rivals. তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে তাদের দেয়া অস্ত্রেই ইরাকসহ সিরিয়াতে সন্ত্রাসী চালাচ্ছে ISIL.
অথচ এই সন্ত্রাসদের দেশ থেকে উৎখাত করার জন্য যখন ইরাকের প্রধাণমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র কিনতে চেয়েছিলো, যুক্তরাষ্ট্র নাকচ করে দিয়েছিলো ।
[সূত্র: আল জাজিরা, টাইমলাইন: ১২.০৬.২০১৪]
যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে বিশ্ব বাজারে অত্যাধুনিক অস্ত্রের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়া হয় । যখনই কোনো বড় ধরণের ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন করা হয়, তখন বিশ্বায়ন প্রতিযোগিতায় নিজেদের অস্তিত্বকে টিকে রাখা ও নিরাপত্তার তাগিদে ইরান,ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোও পারমাণবিক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র পুঁজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । অস্ত্র বাণিজ্যে ঠিক এসময়ে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যায় । তবে অস্ত্র রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে । একটা কথা মনে রাখতে হবে অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেই অস্ত্রের চাহিদা বাড়বে ।আর এ চাহিদার যোগান ঐ দেশগুলোই দিয়ে থাকে । অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করতে হিরোশিমা, নাগাসাকি, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, গাজার মতো ভূখন্ডকে ঝলসিয়ে দেয়া হয় । তালেবান, আইএসআইএল,আলকায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে, তাদের হাতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে মোসলেম দেশগুলোতে অরাজকতা, সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করা হয় । বাধ্য হয়ে সে দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধাণ জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের কাছে অস্ত্র কিনতে আগ্রহী হয় । যেমনটি ISIL কে নির্মূল করতে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মালিকি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র কিনতে গিয়েছিল ।
এথেকে কি বোঝা যায় না, সন্ত্রাসবাদ দমন নয়, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে অস্ত্রবাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করাই যূক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ?
যুক্তরাষ্ট্রই যে মানবতার বিপক্ষে তার প্রমাণ সম্প্রতি গাজা ইসরাঈল যুদ্ধেই প্রমাণ মেলে ।
জাতিসংঘসহ সমগ্রবিশ্ব যখন গাজার পক্ষে তখন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাঈলের কাছে সামরিক অস্ত্র বিক্রি করছে।
[খবর মানবজমিন: ৩১.০৭.২০১৪]
আমরা যদি অতীতের দিকে
লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টে যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা ফেলে । লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে । প্রতিবন্ধীর সংখ্যাটা তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ কিছুই ছিলোনা। তাহলে সেখানে কেনো মারণাস্ত্রের আঘাত হানা হলো?
ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা মনে আছে? ঐ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী অ্যাজেন্ট অরেঞ্জ ব্যবহার করে এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো? নাম দিয়েছিলে "অপারেশন রেঞ্চ হ্যান্ড ।"
এ যুদ্ধে ৪ লক্ষ মানুষ নিহত ও পঙ্গু হয় আর ৫ লক্ষ শিশু জন্ম নেয় প্রতিবন্ধী হয়ে। তখন কোথায় ছিলো তাদের মানবতা? কোথায় ছিলো জঙ্গিবাদ দমনের বুলি আওরানো? কোনো উত্তর দিতে পারবে কি?
আসলে এরাই মানবতার মোড়কে জঙ্গিবাদ বিক্রি করে ।
এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর সবাই যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাঈল ব্রিটেনের মদদপুষ্ট তা কিন্তু নয় । কিন্তু কথা হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে তারাই জঙ্গিসংগঠনের স্রষ্টা । যার সত্যতা হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য, স্নোডেনের ফাঁসকৃত তথ্য, আলজাজিরার নিউজ ইত্যাদিতে নিহিত রয়েছে ।
এই জঙ্গিবাদ ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই ছড়িয়ে পড়ে । জন্ম নেয় অসংখ্য জঙ্গি সংগঠনের । জঙ্গিবাদকে তখন আর কেউ ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে দেখেনা, বিবর্তনে জঙ্গিবাদ হয়ে যায় আদর্শ । আর এই আদর্শে সবাই এসলামকে ছিঃ ছিঃ বলে ।
কারণ হিসেবে নিন্দুকেরা বলে কোরানে জেহাদের কথা আছে, কেতালের কথা আছে, শহীদের কথা আছে, হুরপরী পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে ইত্যাদি ইত্যাদি ।
কিন্তু তাদের চোখে ভাসেনা যে, কোরানে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলা আছে ।
[কোরান: সূরা বাকারাহ-(১২,১৩), ২৭, ৩০, ৬০ সহ বহু আয়াত]
তাহলে আল্লাহ তবু কেনো জেহাদ-কেতালের কথা উল্লেখ করেছেন?
এ প্রশ্ন কি নিন্দুকের মনে জাগেনা?
জেহাদ, কেতাল ও সন্ত্রাস যে এক জিনিস না, তা মোসলেম জাতিটি ভূলেই গেছে । তাই তারা বারবার ইহুদি খৃষ্টানদের গভীর ফাঁদে পা দিচ্ছে । আর বিশ্ব মানুষের কাছে এসলামের নাম হয় সন্ত্রাসী ধর্ম ।
[জেহাদ, কেতাল ও সন্ত্রাস যে একজিনিস নয়, তা জানতে মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা "জেহাদ, কেতাল ও সন্ত্রাস" বইটি পড়তে পারেন ]
আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস বুঝতে পেরে ISIL এর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে ইরানের বিশিষ্ট আলেম ও তেহারানের জুম্মা সালাহর অস্থায়ী খতিব আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ আলী মুওয়াহহিদি কিরমানি জুম্মার খুতবায় তা উল্লেখ করেন । তিনি শুধু ইরাকে আইএসআইএল-এর সন্ত্রাসবাদ ও গাজার উপর ইসরাঈলের আক্রমণকে উল্লেখ করে বলেন, আজকাল ইরাকে যা ঘটছে তা শিয়া-সুন্নীর দ্বন্দ্ব না, বরং মানুষকে হত্যা ও মানুষকে সহায়তার মধ্যে দ্বন্দ্ধ ।
তিনি বিশ্বের সকল ফেরকা মাযহাবের মোসলেমদের ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান করেন ।
সত্যিকার অর্থেই আয়াতুল্লাহ কিরমানির এ আহ্বান অত্যন্ত যৌক্তিক । এখনো যদি বিশ্বের মোসলেমজাতিটি সহ অন্যান্য জাতিগুলো এই আধিপত্যবাদী ও মানবতার মোড়কে আবৃত ধূর্তবাজদের বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে গাজা, ফিলিস্তিনি, হিরোশিমা, নাগাসাকি, ভিয়েতনামসহ প্রভৃতি ভূখন্ডের মানুষদের মতো নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষিত হয়ে মরতে হবে । প্রত্যেকের স্বদেশ মৃত্যু উপত্যাকায় রূপ নেবে । মানবতার যেটুকু আছে সেটাও হারিয়ে যাবে পারমাণবিক, রাসায়নিক, জীবাণু যুদ্ধের দামামায় ।