পর্ব ১: Click This Link
২
প্রেম করে বিয়ে হয় আমাদের। আমার স্ত্রীর নাম ছিল প্রীতি। সেই যুগে এখনকার মতো স্বাধীনতা ছিল না । তবে রহস্য ছিল, বাধা পেরিয়ে প্রেমের ভিন্ন এক আকর্ষণ কাজ করতো। বিবাহে পরিবারের সম্মতি পাওয়া সম্ভব হতো না।
আমার বয়স ছিল মাত্র ২৩ । বাবা ঘোড়াশালে কাঠের হার্ডওয়্যার দোকান চালাতো। ভীষণ রগচটা মানুষ। আমাদের প্রেমের কথা সে জানতো না। মার কাছে জেনেছিলাম বাবার ইচ্ছে আমি যেন তার বন্ধুতনয়াকে বিয়ে করি। ইলেক্ট্রক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম। ছাত্রাবস্থায় প্রীতির সঙ্গে পরিচয়।
বিয়েটা হয় কোন প্রস্তুতি ছাড়াই । প্রীতির বাবা ভীষণ দাম্ভিক মানুষ ছিলেন। তার রূপবতী কন্যার জন্য ধনবান এক পাত্র নির্বাচন করেন। উপায়ন্তর না দেখে প্রীতিকে গোপনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। আর সৌভাগ্যক্রমে ঠিক সেই সময় একটা রিসার্চ ফার্মে চাকুরী পেয়ে গিয়েছিলাম।
লুকিয়ে বিয়ে করাকে দুপক্ষের কেউই মেনে নেয়নি। বাবা ক্রোধান্ধ হলেন। প্রীতির বাবা তাকে ত্যাজ্য করে দিলো। পরের বছর এই তিক্তটাকে সম্বল করে স্কলারশিপ পেয়ে জার্মানীর হ্যানোভার শহরে চলে আসি।
রিসিতা, তুমি ভাবতে পারবেনা জীবন কেমন ছিল তখন। চারদিকে শুধু মৃত্যুর ভয়। দুনিয়া দু'দিন বলে তাকে ভোগ করার জন্য প্রস্তুতির অন্ত ছিল না। ৬০/৭০ বছরের গড় জীবনকে একটা ছকে বেঁধে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতো মানুষ, সন্তান হতো, তারপর একদিন প্রার্থনালয়ে গিয়ে পাপমোচনের জন্য কাঁদতো।
রিশিতা অধৈর্যভাবে বললো, তারপর কি হলো?
আমরা সুখেই ছিলাম। যদিও একটা সন্তানের আশা পূর্ণ হয়নি। জার্মানীতে আসার ৪ বছর পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে । সময়টা সম্ভবত: ২১১০ সাল। ফ্র্যাঙ্কফুর্টের শহরতলীতে একটা মালবাহী ট্রাক আমার মোটরগাড়িকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। দুটো চোখ নষ্ট হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে হৃদপিণ্ড, লিভার, কর্ণিয়া সহ অনেক অঙ্গ পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে আমি আবার জীবনে ফিরে আসি। চোখের কর্ণিয়া বদলে দেয়া হয়। দেখতে পাই। কিন্তু গালের ডান পাশে দগদগে সেলাইয়ের দাগ বসে যায়। আমাকে দেখাতো যেন এসিডে পোড়া মেয়েদের মতো। ডাক্তার বলেছিল এটা সেরে যাবে কিন্তু সময় লাগবে।
মানুষের চেহারা যে এত গুরুত্বপূর্ণ জানা ছিল না। একটা সেলাইয়ের দাগের জন্য সবাই আমার দিকে তাকাতো যেন আমি একটা পিশাচ। একে একে বন্ধুরা দুরে চলে গেল, উৎসবে আমাকে ডাকা কমিয়ে দিল। বাবা মায়েরা শিশুদেরকে ভয় দেখাতে আমার ছবি দেখাতো, কর্মক্ষেত্রে কেউ আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইতো না।
বাড়ির আয়নাগুলো কাল কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল কেননা নিজের চেহারা দেখলে নিজেই আৎকে উঠতাম। এর ভেতর প্রীতি ছিল ব্যতিক্রম। মাদার তেরেসার মতো দায়িত্ব ও মমতায় সে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। শুশ্রুষা করেছে। উত্সাহ দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা থেমে থাকে না। প্রায়ই মাঝ রাতে চিন চিন জ্বলতো জায়গাটা। আমার স্ত্রীর ভালবাসাকে মনে হতো করুণা। মনে হতো বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল ছিল। প্রীতি আমাকে বললো, চলো আমরা দুরে কোন দেশে চলে যাই।
প্রীতি কিন্তু অন্তর্মূখী নয়। বরং প্রাণবন্ত একটা মেয়ে। বাঙালীদের পার্টিতে যেতে তার পছন্দ করতো। রান্না করতো। বন্ধুদের দাওয়াত করে খাইয়ে তৃপ্ত হতো। কখনো সে সাজগোজ করতো, বলতো, আজ সন্ধাটা হবে মোমের আলো এবং বিটোফেনের সঙ্গীতে।
রিসিতা ইঁচড়ে পাকা মেয়ের মতো বললো, তোমরা তো খুব রোম্যান্টিক কাপল ছিলে।
হ্যা, ছিলাম,
কিন্তু প্রীতি বিশাল ভারে ভেঙে যাচ্ছিল প্রায়। আমি তাকে বলতাম, দেখ, আমার যা হয়েছে আমি সামলাই। জগৎসংসার তো উদার হওয়ার জায়গা নয়? কতদিন এভাবে একটা কুৎসিৎ মানুষের সেবা করে চলবে। বিয়ের বাজারে তো কেউ ছাড় দেয় না - মেয়েদের সামান্য নাক বোঁচা হলে বা উচ্চতায় খারাপ হলে তার আর বিয়ে হয় না। শরীরের সৌন্দর্যকে অস্বীকার করে লাভ নেই। তোমার রূপ আছে, সময় আছে। তুমি নিজের সুখ বেছে নাও।
প্রীতি খুব রেগে গিয়ে আমাকে ধমকে দিতো। বলতো, শরীর বদলে গেলে কি মন বদলে যায়? আমরা তো এমনিতেই বুড়ো হতাম। আজ হোক কাল হোক ভেঙে যেত সব রূপ-সৌন্দর্য। আর প্রিয় মানুষটিকে বুকের পেয়ে আমি যে সুখী হয়েছি তা কি তুমি বোঝ না?
তারপর চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে বলতো, যখন তোমার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম পৃথিবীর একটি দিকে রেখে এসেছি জন্মদাতা বাবা মা, স্নেহময় ভাই বোন, বহুপরিচিত ঘর, খেলনা পুতুল, শৈশবের বাঁধানো ছবি।
রিসিতা শুনছিল কথাগুলো। তাকে বললাম, সেই বিশ্রী সেলাইয়ের দাগের পর ভালবাসা যেন বেড়েই গিয়েছিল। সে একলাই দোকানে যেত। পথ্য আনতো, অষুধ কিনে আনতো। মন খারাপ করতো না। আমার দিকে তার এক বিন্দু অভিযোগও ছিল না।
৩
আমরা দু'জন জার্মানীর একটা নির্জন গ্রামে চলে আসি। পেশা বদল করে কৃষিকাজ থেকে কিছু আয় হয়। সেটা দিয়ে চলি। একটা কথা প্রীতিকে বলতে পারিনি, দুর্ঘটনার পর স্নায়ুতন্ত্রের একটা অসুস্থতা কিন্তু গোপনে বাড়ছিল। ঘুম থেকে ওঠার পর পুরো শিরদাঁড়া অবশ হয়ে যেত। আবার যেন ঠিক হতো নিজে নিজেই। কখনো মেরুদন্ডে দাউ দাউ আগুন জ্বলতো। ডাক্তার জানিয়েছিল সময় বেশী নেই। রিসিতা মনে হয় বাকিটা আন্দাজ করে।
রিসিতা প্রশ্ন করেছিল আমার আয়ূ যে সীমিত সেটা কেন প্রীতিকে বলিনি। আমি বললাম, প্রীতি খুব বেশী সেনসিটিভ মেয়ে। বলতে চেয়েছি, কিন্তু সাহস হয়নি। আর আরেকটি কারণ ছিল স্টুটগার্ডের একটা জীন গবেষণা কেন্দ্র আমাকে যোগাযোগ করেছিল।
৪
-মি. প্রিতম, আপনার অনুমতির জন্য এসেছি
-যদিও আপনার মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। কিন্তু একটা সুসংবাদ জানাতে এলাম
-কী রকম সুসংবাদ? মরণের পর বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন? (হেসে বললাম)
-অনেকটা তাই। ইনটেলিরেপ্লিকেশন পদ্ধতিতে ৭৫% সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা আপনাকে সেভাবে বাঁচাতে চাই
-কী রকম সেটা?
-সাধারণত মস্তিষ্কের মৃত্যুকেই মৃত্যু বলি। যেমন কারো হাত পা বা শরীর অন্যকিছু মরে গেলে তাকে মৃত বলিনা। আমরা যেটা করবো, মৃত্যুর পর আপনার মাথাকে একটা লিকুইড চেম্বারে ঢোকাবো। সেখানে পুরো স্মৃতি ও বুদ্ধিমত্তাকে ব্যাকআপ নিয়ে কৃত্তিম ভাবে নির্মিত সুস্থ একটা মস্তিষ্কে কপি করে দেয়া হবে। তারপর সেই শরীরে বসিয়ে দিলে প্রাণ ফিরে পাবে।
আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু সম্মতি দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী তখন সব জেনে গিয়েছিল। তারপর একদিন খুব ভোরে আমি মারা যাই।
৫
তারপর?
রিসিতার মন খারাপ হলে গল্পটা থামিয়ে দিতাম। কিন্তু সে শুনতে চাচ্ছে
স্বভাবতই আমার স্ত্রী খুব ভেঙে পড়েছিল। অনেকবার বোঝানোর পরও সে বিশ্বাস করেছিল না আমি বেঁচে আসতে পারি।
স্টুটগার্ড থেকে বিজ্ঞানীরা মৃতদেহ নিয়ে যেতে চাইলে সে রাজী হয়নি। বিলাপ করে বলছিন, প্লিজ আপনারা এখন যান, আমি একজনকে চেয়ে সব ছেড়ে এলাম, আল্লাহ, তুমি তাকে কেড়ে নিয়ে গেলে। আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে? আমি তখন মৃত। আমার জানার উপায় নেই। শুনেছি প্রীতির আমার লাশের ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদেছিল।
পরদিন সকালে বিজ্ঞানীরা আমার মস্তিষ্কের কপি করে ফেলে। কিন্তু আমার শরীরটি দুর্ঘটনায় এত ক্ষতিগ্রস্থ ছিল যে তাতে মস্তিস্ক প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়নি। একই সময় মর্গে এক বেওয়ারীশ লাশ আসে। বিজ্ঞানীরা সময়ের অভাবে সেই দেহেই মস্তিষ্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
-তারমানে তোমার এই যে চেহারা, সেটা তোমার নয়?
-না, আমার নয়।
রিসিতা আদালতের জেরার মতো করে বলে, তা তোমার স্ত্রীর রিএকশন কী হয়?
মাস চারেক হসপিটালে থাকি, তার পর আমাকে বাড়ি রেখে যায়। আমার চেহারা বদলে গেছে। লম্বায় খাট হয়ে গেছি, শ্যামলা শরীরটা ফর্সা হয়ে গেছে। কিন্তু ভিতরটা একই। প্রীতি আগন্তুকের দিকে চেয়ে বলেছিল,
-আপনি যে হোন, আমার স্বামী নন।
-প্রীতি, তুমি কি বলছ? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করো, এটা আমি, শুধুমাত্র শরীরটা পালটেছে।
-দয়া করে আপনি চলে যান, আমার রসিকতার মুড নেই।
-প্লিজ! তোমার কি মনে পড়ে না তুমি বলেছিলে, তুমি আমার ব্যক্তিত্বকে চাও। ভিতরের মানুষটাকে চাও। আমি দেখতে যেমনই হই, মনটাই চাও, বলনি?
-হ্যা, বলেছি, কিন্তু আপনাকে না। আমার স্বামীকে। যে এখন কবরে ঘুমাচ্ছে। আমি ফুল দিয়ে এসেছি।
-না সে শুধুই একটা শরীর। এতই যদি অবিশ্বাস, হাতটা ধরে দেখ সেই আমিই আছি। আমি বলেছিলাম,
অন্তরটাকি সব নয়? আমি হাসপাতালে শুয়ে ভেবেছি, একদিন তোমার হাত ধরে পার্কে ঘুরেছি। লুকিয়ে বাদাম খেয়েছি। সিনেমা দেখেছি। মনে আছে, তুমি একটা খাম দিয়েছিলাম কোন চিঠি ছাড়াই! এসব আমি ছাড়া কে জানে। তোমার লেখা কবিতা,
ফুল দিয়ে ফিরে আসা জোনাকীর পাখা,
সুখ এলে যায় তাকে ঢাকা।
প্রীতি এক আগন্তুকের গলায় ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো সহ্য করতে না পেরে দু'হাতে তার কান চেপে ধরে। বলে, প্লিজ এবার আসুন। আমি কাছে এগিয়ে যাই। সে খুব আতঙ্কিত হয়, চিৎকার করে অন্যঘরে ছুটে যায়। এমন সময় একটা ফোন বাজে।
৬
সাইকিয়াটিস্ট ফোন করে। ওরা আজকের ঘটনাটা শুনে বললো। বললো, মি. প্রিতম, আমরা জানি, এমনটা খুব হতে পারে। আপনি দু'চারদিন স্ত্রীর সঙ্গে কাটান। দেখবেন আবার সব ফিরে পাবেন। আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু নতুন জীবনের উপলব্ধিতে এত উত্তেজিত ছিলাম যে টের পাইনি কখন রাত ২টা বেজে গেছে।
পাশের রুমে গিয়ে দেখি প্রীতি শুয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে শোয়ার ঘরের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছে। চুল উন্মাদিনীর মতো এলোমেলো। তাকে কম্বলে ঢেকে দেই। চুলগুলো ঠিক করে দেই। তারপর ক্লান্ত দেহে শুয়ে পরি তার পাশে।
রিসিতাকে বললাম, এরপর গল্পটা আর আগায় না।
খুব ভোরে উঠে টের পেয়েছিলাম বাড়িতে কেউ নেই। চিত্কার করে ডাকলাম কিন্তু কেউ নেই। আমাদের ফার্মল্যান্ডের একপাশে একটা নদী, অন্যদিকে উঁচু পাহাড়। বাড়িতে হেটে ট্রেন স্টেশন। পুলিশ এসেছিল। বহু খুঁজেও প্রীতিকে পায়নি। নিয়মিত বেওয়ারিশ দেহগুলো দেখতে নিয়ে যেত। কোনটিকেই প্রীতি মনে হতো না। আর যদি শরীর দেখে নিশ্চিত হওয়া যেত সে আমার স্ত্রী, তবে আমি নিজেই তো আর বেঁচে নেই।
শত বছর কেটে গেছে। অন্য সমস্ত মানুষের মতো আমার শরীরটা বদলে গেছে। রিনিউ হতে গিয়ে আমার মৃতমানুষটি আমার নিজের কাছেই এক স্মৃতি।
৭
ভালবাসায় একটা অদৃশ্য মিল থাকে। হয়তো সেজন্যই রিসিতার মাঝে প্রীতির ছায়া খুঁজে পাই। সকাল থেকেই তার সঙ্গে কাটাচ্ছি। হয়তো সময় কাটবে এভাবে। আমাদের বিয়ে হবে। সন্তান হবে। সুখ হবে। সংসার হবে। শুধু জানা হবে না মানুষের শরীরের পরিচয়টাই সব কিছু কিনা।
---
ড্রাফট ১.০ / ভুলগুলো শুদ্ধ হবে একদিন
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:০৪