লিংক---পদাতিক/৩৫,৩৬
৩৭
--এই ওঠো, সুবোধ, উঠে ঘরেই বস,বাইরে বসা ঠিক নয়—আব্বার নির্দেশ। চা আনছি,--বলে কুসুম ভেতরের ঘরে চলে গেল।
না কুসুম, আমি কোনো সমাধান জানি না। আমি হাঁটতে জানি শুধু। আমাকে হাঁটতেই শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। এক পা, দু পা করে।
হাঁটতে হাঁটতেই আমি ছড়িয়ে পড়ছি সংহত হওয়ার বদলে। এ-ও এক ইচ্ছা নিরপেক্ষ ঘটনা। আমাদের অপেক্ষা করার নিদান নেই কুসুম, শুধু অতিক্রম করা ছাড়া।
--কী হলো চা’ নাও—
--ও হ্যাঁ, এই দাও—ক’টা বাজে বলতো—শামীম এলোনা যে---
--আসবে ঠিক সময়। তার আগে তুমি বলতো তুমি এভাবে চলে গেলে কেন?
--বাধ্যত---
--কেন? কিছুদিন গা’ঢাকা দিয়ে কি এখানে থাকা যেত না?
--থাকছিলামই-তো, কিন্তু একসময় গা’ঢাকা দিতে দিতেই-তো ঢুকে পড়ি ওপারে---
--যদি বলি ওপার সম্পর্কে তোমার একটা অবসেশন ছিলই।
--আজ আর অস্বীকার করে লাভ নেই/
--না, এভাবে বললে মানবো না।
--আসলে এপার ওপার সম্বন্ধে তথাকথিত ইতিহাসের বানানো গল্পটাতে আস্থা রাখতে পারিনি। ফলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় সেই সব মানুষজনের মত যারা, ভোর রাতের নক্ষত্র মাথায় নিয়ে একের পর এক আলপথ ডিঙ্গিয়ে চলে গিয়েছিল এক পার থেকে অন্য পারে, তাদের পায়ের ছাপে পা রাখার ভীষণ একটা চাপ তৈরি হয়েছিল মনে মনে। আর তুমি-তো জান আমার অন্তত বহুশ্রুত সেই তথাকথিত সুখ সন্ধান থাকার কথা নয় ওদিকে।
--এত গভীর করে ফেললে উত্তরটা—প্রশ্নটা কিন্তু তা ছিল না।---এই চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
--হ্যাঁ—
উপায়-হীনতার চোখ সুবোধ দেখেছে। সাদা ও নির্মম। জেনেছে রাষ্ট্রশক্তির কাছে নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার পরিণতি। তার সশস্ত্র ব্যাপকতার মুখে খড়-কুটোর মত ভেসে যাওয়া।
শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত,নিষিদ্ধ করে দেয়া সংগঠনের সংগঠক সুবোধ কক্ষচ্যুত এক গ্রহাণুর মত আজ ঢুকে পড়েছে কুসুম শামীমের বাসায়। তাই প্রতি-রাতেই গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের কথাবার্তা পরামর্শ। মূল কথক সুবোধ সহজে ছাড়া পায় না। তাকে সব কথাই বলতে হয় । তার এই অভিযাত্রার সঙ্গী না হয়েও কুসুম শামীম এই অভিযাত্রার স্পর্শ পেতে গিয়ে সুবোধকে প্রশ্নের ভেতর ডুবিয়ে রাখে।
সুবোধ ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে একসময়। টের পায় ঠোঁটে করে মশারি গুজে দিচ্ছে কুসুম। আলো নিভিয়ে কপালে একটু হাত বুলিয়ে বলে যায় ‘বাকিটা কালকে’।
৩৮
এবার এসে থাকতে থাকতেই সুবোধ ঢাকার আকাশের সেই গোপন দরজাগুলোর একটার সন্ধান পেলো। সে জানে এই দরজাটি খুললেই মুনীরের সঙ্গে হয়ে যাবে। অবশ্য সেই মুনীরের সঙ্গে নয়, যে ছিল দেব-শিশুর মত দেখতে, যার মুখ দেখলে মনে হতো সে তখনও কোন স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। অথচ সে তাদের এম এ ক্লাসের একজন সেরা ছাত্র। ক্লাসের পড়ার বিষয় থেকে শুরু করে ছাত্র জীবনের চোখে দেখা পৃথিবীর যে কোন বিষয়ে সেই-ই ছিল আমাদের কাছে জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। আমাদের চেনা রাষ্ট্র নামক সত্তাটি এই সকল মানব সন্তানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠবে এ আর বিচিত্র কী !
এই মুনীরের বদলে অন্য এক মুনীরকে পাওয়া ছিল সে-দিন আমাদের কাছে আসলে মুনীরের চিরতরে চলে যাওয়া। আমরা মুনীরের লাশ পেয়েছিলাম। শরীরটি তার শরীর ছিল না—অথচ মুখটি ছিল সেই বাৎসল্য-জাত এক টুকরো লাবণ্য।
যেন অনেকদিন পর সুবোধ তার ফেলে যাওয়া সেই সময়টা আবার ফিরে পেল। একা একা সুবোধ হালকা অন্ধকারে ভেতর আবার ছুঁতে চাইলো সাদা চাদরে ঢাকা মুনীরকে। যেন একবার ডাকলেই উঠে পড়বে। বলবে—লও ভাই একটু ফুঁইকা আসি। মানে সিগারেট টানবে। নতুন নতুন টানা শিখেছে সবে। বলবে—খুব ভালা বস্তু একখান মাইরি !
এভাবেই সেদিন সকালে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনটা ঢোকার একটু আগে সে মুনীরকে ডেকে তুলেছিল ঘুম থেকে। জেগে উঠে টয়লেট থেকে মুখ চোখ ধুয়ে আসতে আসতেই ট্রেনটা ঢুকে পড়লো স্টেশনে। তারপর ঢুকলো সুবোধ নিজে এবং বের হওয়ার মুখেই চমকে উঠলো গুলির শব্দে। গুলির শব্দ ততদিনে তাদের খুব চেনা । গুলির শব্দ আর পরক্ষণেই চীৎকার। প্রথমে তেমন কিছু না বুঝে সুবোধ লাফিয়ে নেমে দৌড়তে শুরু করলো। আশা ছিল তার মত মুনীরও কোনোদিকে দৌড়চ্ছে। কিন্তু কোথায় মুনীর? এদিক ওদিক—ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল স্টেশন চত্বর। ভিড়টা একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এসে গেল পুলিশ। লাশ তুলে নিয়ে তারা চলে যাচ্ছিলো—আরে এতো মুনীর ! এত রক্ত---। সুবোধ দেখলো ভার্সিটির অনেক ছাত্রই যারা এই ট্রেনে করে হোস্টেলে ফিরছিল, তারাও পাশে। মুহূর্তের মধ্যেই তারা পুলিশের ব্যারিকেডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেখানে চীৎকার আর ধস্তাধস্তিতে জায়গাটা প্রায় অগ্নিগর্ভ। উত্তরোত্তর ছাত্রদের ভিড় তখন বেড়েই চলেছে।
‘স্বাধীনতা’ আর ‘গণতন্ত্র’ নামের দুটি শব্দের আড়ালে যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্ররা সেদিন অভ্যুত্থানের ছক কষেছিল তার উপর অনেক আঘাতই এসেছে—কিন্তু মুনীরের মৃত্যুর পর তারা প্রায় পাগলের মত ঢাকা শহরটাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। দু’দিন পর সেই স্তব্ধতার মধ্যে এক মিছিলে কেমন ছবির মত ঠাণ্ডা মর্গ থেকে বেরনো মুনীর শুয়ে থাকলো সাদা কাপড়ের নিচে।শুধু কথা বলল না।
মিছিলের মধ্যেই হঠাৎ কানে কানে অচিনের গলা—সুবো, তোর নামেও ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে, এইমাত্র খবর পেলাম—মোট দশজন শুনেছি—শেল্টারে চলে যা শিগ্গির।
সুবোধ এক ফাঁকে বেরিয়ে পড়লো মিছিল থেকে।
না, আর মুনীরকে ওরা আর ধরতে পারছে না। মুনীর দৌড়োচ্ছে, পেছনে সুবোধ---সুবোধ টের পেল ভোর হচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে স্নান ঘরে ঢুকে চোখে মুখে জল দিয়ে এলো। অনেকটা জল খেল। টেবিল থেকে কাগজ কলম নিয়ে লিখলো একটাই শব্দ ‘চললাম’।
সূর্য ওঠার আগেই সে পথে নামলো। ঢাকা শহর তখনো ঘুমে। রাজশাহী-গামী প্রথম বাসটাতেই সে চেপে বসলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর ছাড়িয়ে বাস হাইওয়ে ধরলো। তার টান টান স্নায়ু ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এলো। কানে বেজে উঠলো কুসুমের গলা। যেন হঠাৎ টের পেয়ে দৌড়ে দৌড়ে এসেছে—হাঁপাচ্ছে, বলছে—জাহানারা আর লালনকে নিয়ে যে ভাবেই পারো ফিরে এসো সুবোধ—আমরা আছি এখানে—কোনো অসুবিধা হবে না তোমার। কী ফিরছ-তো?
বিগত কতগুলো ঘণ্টা মুহূর্ত শুধু জাহানারাকে নিয়ে কেটেছিল তাদের। ‘জাহানারা’ নামের বাস্তবতাটির স্পর্শ পেতে অনেক সময় লেগেছে তাদের। লাগারই কথা। আসলে-তো সুবোধকেও চিনতে হচ্ছিলো নতুন করে। কথার মাঝে শামীমই প্রথম প্রস্তাবটা তোলে। বলে—সব ঠিক আছে,ভুল কিছু হয় নি। ওদেরকে নিয়ে চলে আস এবার। আমরা আছি। যে কোনোরকম সাহায্যের জন্য আছি আমরা। ঠিকানা রইলো। যোগাযোগ করতে দ্বিধা করো না।(ক্রমশঃ)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:০২