somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে দেখা এক জন্ম কথা

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফিরে দেখা---২৯,৩০
৩১
অধীর যাত্রাশেষের তামাক নিয়ে বসলো। তার মধ্যেই জামাইবাবাকেও ডেকে নিল। শান্ত সরিষার খালে নৌকা এখন । নিজের জায়গা। বুকে বাতাস যেন বেশি বেশি ঢুকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আমিত্তিপুরের ঘাটে নৌকা লাগাবে। বেলা খানিক ছোট হয়ে আসছে। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই আঁধার নামে। ঠিক হলো যে ঘাট থেকে মালপত্র নিয়ে পরাণ আর হানিফ জামাইয়ের সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত যাবে। অধীর নৌকা তেলিপাড়ার ঘাটে নিয়ে গিয়ে বাঁধবে। ঘাটের কাছেই তার বাড়ি। তাদের পৌঁছে দিয়ে হানিফ আর পরাণ হেঁটে বাড়ি ফিরবে। বেশি দূর নয়। এই কথাবার্তার মধ্যেই দিবাকর ছৈএর ভেতর থেকে টাকা নিয়ে এসে কথামত একশ টাকা অধীরের হাতে দিল। তাদের দিন তিনেকের জল-সংসার আপাতত শেষ হলো।

অনেক মাস হলো শ্রীমন্তপুরে সন্ধ্যাবাতি দেয়ার পাট উঠে গেছে। মানুষ নেই, বাতিও নেই। তবু যারা আছে এখনও সন্ধ্যে বেলা ঘরে অন্তত তাদের বাতি জ্বালাতে হয় একটু। সুপ্রভা বাতি জ্বালাতে গিয়ে মানুষের গলার আওয়াজ শুনে উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখেন দিবাকর---। দু হাতে তার দুটো বোঝা। বাকরুদ্ধ সুপ্রভা দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে দিবাকরকে ঘরে ঢুকতে দিলেন। দেখলেন পরপর বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়তি ও আরো দুজন আসছে। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিয়তি আর নিজেকে সামলাতে পারলনা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। যাওয়ার তিন দিনের মাথায় যখন তাদের পৌঁছানোর খবর আসার কথা তখন তারা নিজেরাই ফিরে আসলো। সুপ্রভা মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে শুধু বললেন---পরে কান্দিসনে---অইছে কিতা ক আগে, হুনি।

কারোর কাছে বোধ হয় খবর পেয়ে থাকবেন রবীন্দ্রবাবু। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে তিনিও বাড়ি এলেন। কিছুটা খবরাখবর যেহেতু এখন তিনি রাখছেন তাই খুব বেশি অবাক হলেন না। চরম বিধ্বস্ত অবস্থা,--এই অবস্থায় আর কথা বিশেষ বাড়ালেন না। সুপ্রভা শুধু নিয়তিকে নিয়ে রান্না ঘরে গেলেন। ভাত বসিয়ে তিনি নিয়তির কাছে সমস্ত বিবরণ শুনলেন। দীর্ঘশ্বাস কি আর তিনি লুকোতে পারেন! সব শুনে এখন পাথর হওয়া ছাড়া আর কোন পথ তিনি খুঁজে পেলেন না।

বিগত দু’তিন দিনের অসাক্ষাতের সব খবরাখবর নিয়ে খাওয়ার পর সকলেই বড় ঘরে ঢুকে বসলেন। বাচ্চারা শুয়ে পড়লো। দরজা আটকে কুপিবাতিও আগের মতই নিভিয়ে দেয়া হলো। গ্রামের নতুন খবর, যা নিয়ে গ্রামে চাপা উত্তেজনা,তা হলো জব্বারকে গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। কাজে যেমন যায় তেমনি সে গিয়েছিল,কিন্তু ফেরত আসেনি। সন্দেহ করা হচ্ছে মুক্তি যোদ্ধারা তাকে অপহরণ করেছে। যাই হোক আজ পর্যন্ত তার কোন খবর নেই। স্থানীয় বাজারে শান্তিবাহিনির যে দলটা টহল দিত সপ্তাহে একদিন, তাদের মধ্যে দুজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের একজন কমলপুরে সম্প্রতি শাদি করে সংসার পেতেছিল। সামনের সপ্তাহে বাজারে তার কী প্রতিক্রিয়া হয় কেউ জানে না। কিন্তু কোন লাশ কোথাও পাওয়ার খবর নেই। রবীন্দ্রবাবুর এইসব খবরের মধ্যে দিবাকর মাঝে মাঝে তাদের এই ফিরে আসার বিবরণটাও শোনাচ্ছে। বিবরণ শুনে রবীন্দ্রবাবুর গলায় কোন আফশোষ শুনতে পেলনা সুপ্রভা এবং দিবাকর। মনে হলো তিনি যেন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন। সুপ্রভা তার স্বামীকে চেনেন—তার এই সময় স্বস্তি পাওয়ারই কথা। কিন্তু তিনি নিজে কি স্বস্তি পাননি—তিনিত মা—তারত আরো বেশি স্বস্তি পাওয়ার কথা । সুপ্রভা জানেন এর কোন মীমাংসা নেই তার কাছে। সব শোনার পর মেয়েকে কাছে পেয়েও তিনি জানেন এক বিপর্যয় থেকে বেঁচে ফিরে এসে নিয়তি আরেক বিপর্যয়ের মধ্যে কি পড়লো না? কারণ তাদেরতো আর দুদিন পরেই দেশ ছাড়ার কথা, সব ঠিক হয়ে আছে। যা এখনও নিয়তিকে বলা হয়নি।

নিয়তি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পাননি—আজ সে মায়ের কাছে এই পাশে শুয়েছে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে বলে—ওপাশে বাচ্চারা। রাতে হাত পা ছোড়ার অভ্যেস ছোট ছেলেটার। সুপ্রভা নিয়তির গা’য়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন— পেটটা মাসের তুলনায় বড়ই ঠেকে—এইসব লক্ষণত মাইয়া হওনের—হউক--কত দুঃখের এই সন্তান— কী দিন পেটে নিয়ে নিয়ে পার হইতাছে মাইয়াডা---। মায়ের কাছে কেউ আর বড় হয় না- -ঘুমোলে এখনও কেমন ছোটই মনে হয়—মনে পড়লো বিয়ের আগে নিয়তিসহ এই জলপথ দিয়েই তারা কতবার মালনীর আশ্রমের বার্ষরিক উৎসবে গেছে। কত আনন্দ। একবার তার বাবা হারমোনিয়ামটাও তুলে নিয়ে গিয়েছিল নৌকায়। নিয়তি গান করবে বলে। নিয়তি গান করেওছিল---হাওর বিল পার হওয়ার পথে---খোলা জায়গায় সেই গান ছড়িয়ে পড়ছিল দিক থেকে দিগন্তে।কাছাকাছি থাকা কত নৌকা থেকে গলা বাড়িয়ে কেউ কেউ বলেছে—আহা কী সুন্দর গলা মাইয়ার --বড় ভালা গায়--। তার বাবা গান বাজনা জানতো—খুব যত্ন নিয়ে এই মেয়েটাকেই কী খেয়ালে যেন গানও শিখিয়েছিল। বিয়ে আগে মেয়ে দেখতে এসে তার শ্বশুরতো এক শ্যামাসঙ্গীত শুনে চোখের জলই ফেলেছিলেন। খুব ভালবাসতেন ছেলে বৌকে।

এসব পুরনো দিন এসে কেন যে আজ এই রাতে হাজির হলো সুপ্রভার মনে—নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে অন্ধকারে উত্তর খোঁজেন—উত্তর পাননা—টের পান অনেকদিন পর শুকনো চোখের কোনে একটু জলের আভাস। শরীর দিয়ে তিল তিল করে তৈরি এই সন্তান কত ভাবেই যে মায়ের কাছে আসে, থাকে, চলে যায়।কখনো মনে হয় নিজেরই একটুকরো প্রাণ,কখনো মনে হয় আদরের শত্রু একটুকরো ।

দীর্ঘ এই সংসার জীবনে রক্ত ঘাম অশ্রু সবই ঝরিয়েছেন সুপ্রভা। আজকের মত নিজেকে এত রিক্ত আর কখনো যেন মনে হয়নি। ছোট ছোট দুইটা ছেলেকে যখন, এইতো কয়বছর আগের কথা, মেজছেলে আর শ্বাশুরির সঙ্গে না-জানা এক দেশের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন সেদিনও এমন রিক্ত বোধ হয়নি। আজ কেন হচ্ছে! মনে হচ্ছে প্রবল স্রোতের মধ্যে সবাই পরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ছে দিক- বিদিকে—কীসের স্রোত—জল কই—বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই—তবু যেন কেউ কারো হাত আর ধরে রাখতে পারছে না। সবাই সবার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে—ছুটে ছুটে মিলিয়ে যাচ্ছে—শোনা যাচ্ছে হাহাকার—ক্রমে যা দূরে, আরো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে--। সুপ্রভা হঠাৎ করে বিছানায় উঠে বসলেন। হাত দিয়ে অনুভব করলেন সবাই ঘুমন্ত। দুঃস্বপ্নের রেশ কাটতে অনেকক্ষণ সময় নিল। ঠায় বসে রইলেন বিছানায়। দরজা খুলে বাইরে থেকে একবার ঘুরেও এলেন। ঘরে এসে অন্ধকার হাতড়ে খুঁজে পেতে জলের পাত্রটা নিয়ে অনেকটা জল ঢাললেন গলায়। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৪৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শু সাইন বয় ইন্ডিকেটর

লিখেছেন মুনতাসির, ০৭ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:১২

অর্থনীতি ও বিনিয়োগের জগতে একটি বিখ্যাত গল্প প্রচলিত আছে, যেটি "Shoeshine Boy Indicator" নামে পরিচিত। এটি একটি উপকথার মতো শোনালেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর সত্য—যখন সবাই বিনিয়োগে লাফিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুম্মাবার

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ০৭ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৪০

জুম্মাবার
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

প্রতি শুক্রবার ইমাম এর নেতৃত্ব
মেনে নিয়ে আমরা মুসলিমরা
হই একত্রিত, হই সম্মিলিত
ভুলে যাই সবাই হৃদয় ক্ষত!
খুতবা শুনি আমরা একাগ্রচিত্তে
চলে আসি সকলে একই বৃত্তে।
কানায় কানায় পরিপূর্ণ প্রতিটি মসজিদ
ঐক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসলে "ওরফে গফুর" এর উদ্দেশ্য কি....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭

আসলে "ওরফে গফুর" এর উদ্দেশ্য কি....


'ওরফে গফুর' এর লেখা আমি বহুবছর থেকেই পড়ি। ওনার লেখা পড়ে ওনার মতবাদ, আদর্শে আমি বিভ্রান্ত হয়েছি বারবার। কারণ, কোন এক পত্রিকায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষেরা একজোট হতে চাই

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৭ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫১



ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে কি করতে পারি আমরা? একজন নীতিবান, যুদ্ধবিরোধী ও মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে একক এবং সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। চলুন নিচে দেখা যাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

অপারেশন সিদুঁর বনাম অপারেশন নারায়ে তাকবীরের নেপথ্যে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:২৮


বলতে না বলতেই যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেল। না, যুদ্ধ না বলাই ভালো—রাষ্ট্রীয় অভিনয় বলা ভালো। ভারত ও পাকিস্তান আবার সীমান্তে একে অপরকে চেঁচিয়ে বলছে, "তুই গো-মূত্রখোর ", "তোর দেশ জঙ্গি"।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×