এইতো কিছুদিন আগে, একটি সিনেমা দেখে কিছু সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ালাম আবারও নতুন করে। নতুন কিছু উপলব্ধি তৈরি হল। ‘’মানুষ যা চায়, তার সবটা পেলে কি সে সুখী হতে পারে?’’ কী জবাব হতে পারে এ প্রশ্নের?
নিজের মেধা ও যোগ্যতায় এক বিলেতি প্রতিষ্ঠান- হিন্দুস্থান পিটার্স লিমিটেডের উচ্চ পদে নিজের স্থান করে নেওয়া এক শ্যামলেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে এ সিনেমার কাহিনী। উপরে উঠার সিঁড়ি ধরতে খুব বেগ পেতে হয় নি শ্যামলেন্দুকে। কলকাতার সবচেয়ে বড় ফ্যান ও লাইট তৈরির কারখানা হলো এই পিটার্স লিমিটেডের, যেখানে শ্যামল চাকরি করছে। তার সুন্দরী স্ত্রী দোলনের সময় কাটে ফ্লাটের অন্য অফিসারদের স্ত্রীদের সাথে গল্প করে, পার্লারে রূপসজ্জা করে আর স্বামী পদোন্নতি পেয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হবে সে স্বপ্ন দেখে। শ্যামলেন্দু নিজেও কঠোর পরিশ্রমী, পরিচালক পদের জন্য সেও নিজেকে যোগ্য করে তুলছে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। সামনেই রয়েছে তার যোগ্যতার একটি বড় পরীক্ষা। তার কোম্পানীর তৈরি ফ্যানের একটি বিরাট কনসাইনমেন্ট পাঠাতে হবে ইরাকে। কাজটি ঠিকঠাকমত করতে পারলে বিশ্ববাজারে কোম্পানীর যে শুধু নামই বাড়বে তাই নয়, শ্যামলেন্দুর পদোন্নতির রাস্তাটাও খুলে যাবে। নিজের কোম্পানীতেও তাকে অনেক প্রতিযোগিতা করে চলতে হয়, পদোন্নতি বলে কথা
এমনই এক সময় শ্যামলের বাড়িতে বেড়াতে আসে তার শ্যালিকা সুদর্শনা। সাইকোলজিতে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে অবসর সময় কাটানোর জন্য তার কলকাতায় আসা। বেড়াতে এসে ভগ্নিপতিকে কথার মারপ্যাঁচে বারবার ঘায়েল করে দেয় সে। প্রথম দিনে কলকাতায় আসায় পরে তার বোন দোলন জিজ্ঞেস করে, ‘’রাস্তাঘাট দেখে মনে হচ্ছে কলকাতায় এত লোক মরেটরে?’’
বোনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুদর্শনা শ্যামলকে উলটো প্রশ্ন করে বসে, ‘’আপনি এদের কাউকে চেনেন?’’
--যারা মরছে?
--না, যারা মারছে।
দোলন বলে, ‘’দূর পাগল, ওর সংগে কী করে ওদের আলাপ থাকবে?’’
বোনের কথায় কান না দিয়ে আবারও সুদর্শনা শ্যামলকে প্রশ্ন করে, ‘’চেনেন?’’ উত্তর না পেয়ে আবারও সুদর্শনা খোঁচায়, ’’ বলুন না, চেনেন?’’
আপাত দৃষ্টিতে এসব কথোপকথন শ্যালিকা ও ভগ্নিপতির ইয়ার্কি বলে মনে হলেও এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় সিনেমার একদম শেষে।
শ্যামলকে মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে পার্টি দিতে হয়। তাতে মদ্যপানও চলে। সুদর্শনার কাছে এসবই কেমন নতুন ঠেকে। যেন অনেকটা কনফেশনের মতই শ্যালিকার কাছে শ্যামল কোনকিছু লুকোয় না। স্কুল কলেজের পরীক্ষায় পাস করার জন্য অপ্রিয় বিষয় জিওগ্রাফি যেভাবে পড়তে হয়েছিল একসময়, ঠিক তেমনি চাকরির স্বার্থে বাড়িতে এমন পার্টি ও মদের আয়োজন করতে হয় তাকে। এমন কি ঘোড়ার রেসে যাওয়াটাও স্রেফ জিওগ্রাফি শ্যামলের কাছে।
আর অল্প কিছুদিন পরেই ইরাকে ফ্যানের বিরাট কনসাইনমেন্ট যাবে। কিন্তু এমন সময়ই ধরা পড়ল ফ্যানগুলোর একটি ত্রুটি। ত্রুটিযুক্ত ফ্যান বিদেশে পাঠানো হলে বিশ্ববাজারে যে শুধু কোম্পানীরই বদনাম হবে তাই নয়, দিতে হবে মোটা অংকের ক্ষতিপূরনও। সেই সাথে এ সমস্যার পুরো দায় নিতে হবে শ্যামলেন্দুর, যার ফলে তার পদোন্নতিও আটকে যাবে। এসব সমস্যার কথা জানতে পেরে সুদর্শনাও বিচলিত হয়ে পড়ে, জানতে চায় কো্ন সমাধান আছে কিনা। শ্যামলেন্দুর কাছে কোন সমাধান নেই, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া। আর তা সম্ভব হবে না, যদি না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটে। যদি না God নিজে এখানে act করেন। সুদর্শনাও খোঁচাতে ছাড়ে না, ‘’God কি আর আপনাদের জন্য act করবেন?’’
--‘’ফ্যাক্টরিতে যদি একটা গণ্ডগোল বাঁধত
-- তাহলে গণ্ডগোল একটা বাঁধিয়ে দিন। আপনারা তো সব পারেন।
শেষ পর্যন্ত শ্যামলেন্দুকে গণ্ডগোল বাঁধানোর পথেই এগুতে হলো। উর্দ্ধতন দু’এক হর্তাকর্তা ছাড়া আর কেউই এই কৃত্রিম শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে জানতে পারলো না। দুপুরের খাবারের মত সামান্য ব্যাপার নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল, সেখান থেকে তৈরি হলো আন্দোলন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বোমাও পড়ল। একজন শ্রমিক গুরুতর আহত হলো। তালা লাগলো কারখানার গেটে।
এ অবস্থাতেও শ্রমিকদের জীবন নিয়ে খামোখা চিন্তা করতে দেখে শ্যামলেন্দুকে তালুকদার বলেন,’’ মরে গেলে আপনার কী? লোক কী মরছে না কলকাতা শহরে? মরে গেলে ম্যাক্সিমাম সাইজের একটা মালা কিনে পাঠিয়ে দিতেন।‘’
দু এক দিন পরেও শ্যামলেন্দু পদোন্নতি পেয়ে পরিচালক হলো। উপরে উঠার সিঁড়ির ধাপ একটার পর একটা পেরুতে থাকে শ্যামলেন্দু। কিন্তু তার সব প্রাপ্তি ফিকে হয়ে গেল সুদর্শনার সামনে এসে দাঁড়ালে। সুদর্শনা আজ চলে যাবে। যাবার আগে দুজনের মধ্যে আগের মত আর কথা হয় না। দুজনের নিরবতা যেন অনেক প্রশ্নের প্রতিধ্বনি তৈরি করে দর্শকের কল্পনায়।
‘’আপনি এদের কাউকে চেনেন?
--যারা মরছে?
--না, যারা মারছে।‘’
অথবা ‘’মানুষ যা চায়, তার সবটা পেলে কি সে সুখী হতে পারে?’’
বলছিলাম শংকরের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিত রায় নির্মিত ‘’সীমাবদ্ধ’’ চলচ্চিত্রের কথা।