১.
কী যেন খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে ড্রয়ারের ভেতরে পেলাম আমার অনেক দিনের পুরুনো খাতাটা। কী খুঁজছিলাম ভুলে গেলাম খাতাটা পেয়ে। এই খাতাটাতে আমি কবিতা লিখতাম। ভুলেই গিয়েছিলাম খাতাটার কথা। আমিও যে একটু আধটু কবিতা লিখতাম এককালে, সেই কথাটাও।হাসি পাচ্ছিল, দূর্বল কবিতাগুলো পড়তে পড়তে। একটা কবিতা পড়ে রীতিমত চমকে উঠলাম। এই কবিতা আমি লিখেছিলাম নাকি? ভালই তো হয়েছিল! হাসতে হাসতে সেই খাতাটা দেখতে দিয়েছিলাম এক বান্ধবীকে। কিছুদিন পরে খতাটা ফেরত আনতে গেলাম। এবার বান্ধবীর ছোট বোনের কথা শুনে আমার ভিমড়ি খাবার দশা।
--আপু, তোমার কবিতাগুলো আমি আমার খাতায় লিখে রাখছি। তুমি আরো কয়টা দিন পরে নাও।
--আমার কবিতা তুমি কেন তোমার খাতায় লিখে রাখছো? আমার কবিতা নিজের নামে চালানোর ফন্দি, না?
--নাআআআ, আপুউউউউ! তোমার কবিতা আমি নিজের নামে চালাব না।
--তাহলে?
--আপু, তুমিও যে কবিতা লিখতে এ কথাটা এই পৃথিবীর কেউ জানল না। আমি তোমার কবিতাগুলো লিখে রাখব।
বুকের ভেতরটা কে যেন দুমড়ে মুচড়ে দিতে লাগল। আর কানের কাছে বলতে লাগল, ‘’ তুমিও যে কবিতা লিখতে এ কথাটা এই পৃথিবীর কেউ জানল না। কেউ জানল না। কেউ জানল না।‘’না জানুক। কত কিছুই তো এই পৃথিবীর লোকে জানে না।তাতে পৃথিবীর কোন কালেই কিছুই যায় আসে নি।
--আপু, তুমি আবার লেখো না কেন?
হুঁশ ফিরে আসে আবার।
২
রিলেশনশিপ ব্রেক হবার পরে ‘অ’ আমার কাছে দু;খ করে বলছিল, ‘’আমি যে ওকে কতটা ভালবাসতাম, এ কথাটা এই পৃথিবীর কেউ জানল না। এমনকি সেও জানল না।‘’কথাটা বলে ‘অ’ চুপ করে বসে রইল। আবারও বুকের ভিতরে রক্তপাত হতে লাগল। আমি কাঁদতে শুরু করলে অ-এর ধমক খেতে হয়,’’তুই কান্দস ক্যান?’’
৩
পৃথিবীর মানুষ অনেক কিছুই জানে না। তারা জানে না, আমি প্রথম কোন কবিতাটা লিখেছিলাম। সে কথাই বলছি। কোন সময়ের কথা সেটা এখন আর ওভাবে মনে পড়ে না।হয়ত ক্লাস ওয়ানে পড়তাম, বা নার্সারী অথবা টুতে। ১৯৮৭ থেকে ‘৮৯ এর কোন এক সন্ধ্যা। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। আমি আমার একটা পুরুনো খাতার খালি পৃষ্ঠায় লিখে বসলাম--
‘’মেয়েটি কেন বাসে?
সে কোনদিকেতে নাচে?’’
আর কী লিখব? আর তো মিল পাই না! এর পরে আরো কয়টা লাইন মনে হয় লিখেছিলাম। কী লিখেছিলাম, মনে নেই।
কবিতাটা চোখে পড়ার পর আম্মা আর ভাইয়ার কত হাসাহাসি! কত ধরনের টিপ্পনী সহকারে মন্তব্য! ‘’খুব সুন্দর হয়েছে।‘’ ‘’আরো লেখ।‘’ ‘’তোমার লেখা কচি কাঁচার আসরে পাঠাবো।‘’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাসার সবার কাছে বিপুল আনন্দের খোরাক হয়েছিল এই কয় লাইনের কবিতা (???)টা। এখন সে কথা মনে পড়লে আমারও হাসি পায়। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ জানল না, কেন এই কবিতাটাই আমি লিখতে গিয়েছিলাম। সে কথাই বলব।
৪
১৯৮৭-‘৮৯ এর কোন এক রাত। রাত না সন্ধ্যা জানি না। শীতকাল, তার উপর গ্রাম। বিদ্যুৎ সেভাবে যায় নি তখনও গ্রামে। সন্ধ্যাবেলাকেই গভীর রাত বলে মনে হয়। আর আমার মত ছোট্ট মেয়ের কাছে তো রীতিমত ভুতূড়ে অন্ধকার! আমি, আম্মা আর আব্বা বাসে করে ঢাকায় আসছি। রাস্তার দুপাশের ঘন বন (ভাওয়ালের গড়) অন্ধকার আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তখনো বৃক্ষ নিধন সেভাবে শুরু হয়নি কি না!
এমন সময় বাসের ভেতর থেকে একটি মেয়ে কেঁদে উঠল, কিছুটা আমারই বয়সী। ঘটনা পৃথিবীর মানুষেরা উদ্ধার করল। মেয়েটি তার বাবা মা সহ বাসে করে যাচ্ছিল। তার বাবা মা কখন কোথায় তাকে বাসে রেখেই নেমে গেছে, তা সে বলতে পারে না। ছোট্ট একটা মেয়ে চোখের সামনে মহা বিপদ হয়ে গেল। তাকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে বলা হল,’’তুমি এইদিক দিয়ে যেতে থাকো। ঠিকই তোমার বাবা মাকে পেয়ে যাবে।‘’ মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ভুতূড়ে অন্ধকারে, দুপাশে গভীর বন রেখে রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল। আমাদের বাস আবার চালু; ঢাকার উদ্দেশ্যে।
সেই ছোট্ট মেয়েটার কথা আমার এখনো মনে পড়ে। আমি জানি না, সে তার মাকে-বাবাকে খুঁজে পেয়েছিল কি না। ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে যেতে পেরছিল কি না।আমি জানি না। পৃথিবী কেউ সেটা আমাকে জানায় নি। কেউ ঐ মেয়েটার কথা মনে রাখেনি। মেয়েটার কথা মনে হলে, আমি শুধু এ কথাটাই বিশ্বাস করতে খুব ভালবাসি যে, মেয়েটা নিশ্চয়ই তার মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পেরেছিল। পেরেছিল কি?
১৮ নভেম্বর, ২০১০