১. উপরের শিরোনামটি দেখে নতুন প্রজন্মের তরুণেরা একটু ভ্রু কুঁচকাবে। কিন্তু আমার মত পুরোনরা নিশ্চয়ই জাহিদ হাসানের এই বিখ্যাত সংলাপটি ভুলে যান নি। হুমায়ূন আহমেদের ‘’সবুজ সাথী’’ নামের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকের এই সংলাপটি সে সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত।
২. স্কাউট হবার প্রথম শর্ত হল আস্তিক হওয়া। স্কাউটিং শুধুমাত্র আস্তিকদের জন্য। এছাড়াও স্কাউট হবার কিছু সহজ শর্ত আছে। যেমন-মিথ্যা কথা না বলা, প্রতিদিন মনে করে একটি ভাল কাজ করা, ইত্যাদি। প্রতিদিন আমরা সবাই মনের অজান্তেই কিছু না কিছু ভাল কাজ করি। কিন্তু স্কাউটরা ভাল কাজ করবে প্রতিদিন, একটি করে, মনে করে ।এবং এই কাজগুলো করতে যেয়ে তাদের কোন বাড়তি খরচ করার প্রয়োজন নেই। যেমন- রাস্তায় কলার খোসা পড়ে থাকলে তা ডাস্টবিনে ফেলা, বাসে বৃদ্ধ ব্যক্তিকে সিট দেওয়া, কাউকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করা, এমনি সব ভাল কাজ।
আপনারা যারা স্কাউটের সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁদের এসব নতুন করে বলার কিছু নেই।তবে এই ব্যাপারগুলো আমার জন্য একেবারে নতুন। কেননা, আমি ছাত্রজীবনে কখনো স্কাউট বা গার্লস গাইডে অংশ নেই নি।পরিবার থেকে এ ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেওয়া হয়নি। নিজে বরাবরই অলস প্রকৃতির। স্কাউট মানে আমার কাছে ছিল ছুটির পরেও এক্সট্রা ক্লাস আর প্রখর রোদে দাঁরিয়ে পিটি প্যারেড। এ সব কারণে নিজেরও উৎসাহ ছিল না। কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় আসার কারণে আমাকে ঘটনাক্রমে স্কাউটের সাথে জড়িত হতে হয়। শিক্ষার্থীদের স্কাউটে অংশ নেবার জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করতে হয়।
৩. আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন যে আমি স্কাউটে জরিত হয়েছি। অত্যন্ত সক্রিয় এটা অবশ্য আমার সম্পর্কে বলা যাবে না।যাই হোক, ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে, সময় পেলে আমি জানতে চাই, কারা কারা স্কাউটে নাম দিয়েছে, গতকাল কী ভাল কাজ করেছে, আজ সারাদ ইনে কন ভাল কাজ কি করা হয়েছে কিনা, এইসব। যখন আমি নবীন স্কাউটদের এসন প্রশ্ন করি অন্য শিক্ষার্থেরাও নড়েচড়ে বসে। ওরাও বলতে চায়, তারাও ভাল কাজ করেছে, স্কাউট না হয়েও। এভাবে আমি সব শিক্ষার্থীর কাছেই প্রশ্ন ছুড়ে বের করে আনি, তাদের ভাল কাজগুলো। নানারকম ভাল কাজের কথা জানতে পারি আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে কয়েকটি ঘটনা ভাগ করে নিই সবার সাথে।
ঘটনা ১
সপ্তম শ্রেণী। শিক্ষার্থীদের বয়স ১২-১৩। ক্লাসে প্রথমে স্কাউটদেরর কাছে জানতে চাই কী কী ভাল কাজ গতকাল ও আজ এই পর্যন্ত করেছে।
১ম ছাত্রঃ (চুপচাপ দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ কী ভাল কাজ করেছে তা সে মনে করতে পারছে না। অন্য শিক্ষার্থীরা ততক্ষণে ওর নামে নালিশ জানানো শুরু করে দিয়েছে, ‘’ম্যাডাম, ও আজকে মারামারি করেছে)।
২য় ছাত্রঃ (শার্টের বোতাম খোলা, তাকে বলা হল, স্কাউটরা পোশাক আশাকে হবে সব চেয়ে ফিটফাট। এবার লজ্জা পেয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে)--মাকে সাহায্য করেছি।
--খুব ভাল। মাকে সাহায্য করা খুব ভাল কাজ। কীভাবে সাহায্য করেছ?
(এদিক ওদিকে তাকিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা)
--কী? মনে করতে পারছ না?
--ঘরের কাজে যাহায্য করেছি।
--সত্যি?
--জ্বী, ম্যাডাম।
--মিথ্যা কথা বললে কিন্তু স্কাউটে থাকা যাবে না।
ঘটানা ২
এবার চতুর্থ শ্রেণী। শিক্ষার্থীদের বয়স ৮-৯।
১ম শিক্ষার্থীঃ মাকে সাহায্য করেছি।
--খুব ভাল। কী কাজে সাহায্য করেছ?
-- মাকে পেঁয়াজ রসুন এনে দিয়েছি।
--কোথা থেকে?
--যেখানে পেঁয়াজ রসুন রাখি সেখান থেকে।
-- খুব ভাল। সবাই হাত তালি।
২য় শিক্ষার্থীঃ মাকে সাহায্য করেছি।
- কীভাবে?
--সকালে স্কুলে আসার আগে বিছানা গুছিয়ে দিয়েছি।
(এমন উত্তর শুনে আমি ভেতরে ভেতরে চুপসে যাই। কেননা, এই ছোট্ট কাজটাও তো আমি করি না! মনে মনে ঠিক করি আজ থেকে আমিও সকালে স্কুলে আসার আগে বিছানা গুছিয়ে আসব।)
৩য় শিক্ষার্থীঃ রাস্তার মাঝে ইট সরিয়ে দিয়েছি।
--ভেরি গুড। রাস্তার এই ইটটাতে হোঁচট খেয়ে কেউ ব্যথা পেতে পারত, তাই না? সবাই হাত তালি দাও ওকে।
৪র্থ শিক্ষার্থীঃ গতকাল ৪ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছি। ফজরেরটা পড়তে পারিনি।
---খুব ভাল কাজ। আমরা আশা করব, তুমি এরপর থেকে সব ওয়াক্তের নামাজই পড়তে পারবে।
দু, একদিন এসব প্রশ্ন করার পরে আমি খেয়াল করি যে, প্রায় সব শিক্ষার্থীই একই ধরনের উত্তর দিচ্ছে প্রতিদিন। যেমন -মাকে সাহায্য করা, রাস্তার ইট সরানো, নামাজ পড়া, এই রকম। অর্থাৎ এই কাজগুলু ওদের অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। ক্লাসে এসে আমাকে ভাল কাজের কথা বলে প্রসংশা পাবার জন্য হলেও তো প্রতিদিন ওরা অন্ততএকটি ভাল কাজ করছে!
ওদের ভাল কাজের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে দিনের শেষে ভাবনায় পড়ি, আমি কি কোন ভাল কাজ করেছি আজ? তখন আমার অবস্থা হয় আমার ছাত্রদের মতই। অনেক হাতড়েও খুঁজে বের করতে পারিনা, কোন ভাল কাজটা আমি করেছি আজ সারা দিনে। খুব ছোট হয়ে যাই নিজের কাছে।
৪ নভেম্বর, ২০১০।