বিচিত্র ও রহস্যময় মানব মনের প্রতি আমার আকর্ষণ বরাবর। আর তাই মনোবিজ্ঞান বিষয়টির প্রতিও। যখনই দেখেছি বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত কেউ মনোবিজ্ঞানে পড়ছে, তাদেরকে বুকিং দিয়ে রেখেছি, ‘’তোমাদের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায় আমাকে স্যাম্পল হিসেবে নিও’’। কেউ নেই নি আমাকে। কেউ আমাকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নি। কিন্তু আমি ঠিকই তক্কে তক্কে থাকি সুযোগ নেবার। তেমনি একটা সুযোগ মিলে গেল সেদিন। ঢাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজন করেছিল শিক্ষা ও উপোদেশনা মনোবিজ্ঞানের উপর একটি কনফারেন্স। শাহীন ম্যাডাম যখন খবরটি দিলেন আমাকে, আমি রীতিমত লুফে নিলাম সুযোগটা। খুব ভাল লাগছিল অনেক দিন পরে কিছু চেনা মানুষদের পেয়ে। সেই সাথে কনফারেন্সে আমার আগ্রহের বিষয় নিয়ে কর্মশালা। অনেক কিছু দেখলাম, শিখলাম। পিতামাতা, সন্তান, তাদের আচরণ, সম্পর্ক অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হল। সবগুলো সম্পর্কে তো আর এখানে বলা সম্ভব না। তাই সেখান থেকে আজ আমি শুধু Time out সম্পর্কে এখানে তুলে ধরছি। সময় সুযোগ হলে অন্য পদ্ধতিগুলোর কথাও না হয় বলা যাবে অন্যদিন।
২.
প্রথম দিনে কর্মশালাটি হয়েছিল কীভাবে শিশুদেরকে বকা বা শাস্তি না দিয়ে শৃংখলা শেখানো যায় তার উপর। আর এটা পরিচালনা করেছিলেন ঢাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জনাব মাহজাবিন হক। মূলত ৩ থেকে ৬ বছর শিশুদেরকে শৃংখলার পাঠ দেবার উপরেই আলোচনা হচ্ছিল এখানে। প্রথমেই প্রশ্নের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে বের করে আনা হল ‘’শৃংখলা কী’’ এই প্রশ্নের উত্তর। এছাড়া রোল প্লের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি দৃশ্য দেখানো হল আমাদের। দেখছিলাম, বাচ্চাদের সাথে কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় আর মিলাচ্ছিলাম আসলে আমরা কী করে থাকি। সত্যি আমরা সব কিছুই জানি। তবুও এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার ফলে নিজের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হয়। একটা ধনাত্নক পরিবর্তন বা সচেতনতা তৈরি হতে থাকে মনের মধ্যে। ‘’এটা করতে হবে, এটা করা যাবে না’’ এমন সাধারণভাবে বললে হয়ত এতটা প্রভাব ফেলত না।
ধীরে ধীরে আলোচনার বিষয়ে এলো ‘’Tools for Discipline’’ অর্থাৎ বাচ্চাদের শৃংখলা শেখাতে হলে কী পদ্ধতি অনুসরন করা উচিত। শিশুদের নিয়ম-কানুন ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হয়। নয়ত, একটু বড় হলে তার আচরণের কাংখিত পরিবর্তন আনা সহজ হয় না। নানা রকম পদ্ধতি্র কথা জানতে পারলাম। পরিস্থিতি বুঝে যখন যে পদ্ধতিটি বেশি কার্যকর হবে, সেটাই প্রয়োগ করতে হবে। তারই মধ্যে একটি পদ্ধতি হলো Time out। মনে রাখতে হবে, এটিই শিশুদের শৃংখলা শেখাবার একমাত্র পদ্ধতি নয়। অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে একটি।
৩.
শিশুকে শৃংখলা শেখাবার জন্য Time out পদ্ধতিটিও ব্যবহার করা যায় প্রয়োজন বোধে। শিশুর কোন অনাকাংখিত আচরণ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কিছু সময়ের জন্য তাকে কোন বোরিং কাজে নিযুক্ত রাখা। যেমনঃ ঘরের কর্নারে বসিয়ে রাখা, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা, কোন লেখা বারবার লেখানো (এটাকে কায়িক পরিশ্রম ভেবে কেউ ভুল করবেন না যেন! এবং এটার উদ্দেশ্য তার পড়ালেখার মান উন্নয়ন নয়। বরং শৃংখলা শেখানো।), চেয়ারে চুপচাপ বসিয়ে রাখা ইত্যাদি। যেহেতু ৩ থেকে ৬ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাই সময় বেঁধে দিতে হবে শিশুর বয়স অনুযায়ী। শিশুর বয়স যত, সে তত মিনিট ঐ একঘেঁয়ে কাজটি করবে। ৩ বছরের একটি শিশুর জন্য তিন মিনিট অনেক বড় সময়।
Time out কোন শাস্তি নয়। বরং শিশুর আচরণের কাংখিত পরিবর্তনের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা সব সময় এতটা সহজও নয়। যেমন ছোট শিশু হয়ত প্রথমে বুঝতে পারবে না। কিছুক্ষণ ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলে আসতে পারে। তাকে আবার সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং নতুন করে সময় গননা করতে হবে। শিশু যেন বুঝতে পারে, তার অনাকাংখিত আচরণের জন্যই এই বিরক্তিকর কাজটি করতে হচ্ছে এবং ঐ আচরণ ত্যাগ করতে হবে।
অনেক স্কুলে বাচ্চাদের উপর Time out পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ক্লাসের কোনায় তাকে থাকতে বলা হল। কিন্তু সেখানে অনেক খেলনা আর তা দিয়ে সে খেলছে। ফলে ব্যাপারটা তার কাছে বিরক্তিকর না হয়ে আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে। অথবা ক্লাসের এক কোনায় হয়ত দাঁড়িয়ে থাকার মত বিরক্তিকর কাজ তাকে করতে বলা হল। শিক্ষক নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেই দেখা যায় অন্য শিক্ষার্থীরা একের পর এক অভিযোগ করছে,
‘’ম্যাডাআআআআম, দেখেন ও আমাদের ভ্যাংগাচ্ছে!‘’
‘’ ’ম্যাডাআআআআম, দেখেন ও হাসছে!’’
‘’ ’ম্যাডাআআআআম, দেখেন ও নাচছে!’’
অর্থাৎ, Time out পদ্ধতিটির যথাযথ প্রয়োগ হল না। এখানেও শিক্ষার্থী আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। ফলাফল তার আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে না।
আবার শিক্ষার্থীকে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হলেও তার কাছে ব্যাপারটা আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে। স্যারের রুমের সামনে অনেক মানুষ আসছে, যাচ্ছে, এসব দেখে তার ভাল লাগছে। কাজটি তার কাছে বিরক্তিকর বা একঘেঁয়ে মনে হচ্ছে না। তাই এই পদ্ধতি প্রয়োগ এত সহজও নয়। আবার একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে লাভবান হওয়া যায় না। ৩ থেকে ৬ বছরের শিশুদের জন্য এই পদ্ধতি পরিস্থিতি অনুযায়ী, অপরাধের ধরন অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অনেকেরই মনে হতে পারে, Time out শিশুর জন্য ক্ষতিকর হবে কি না। আমরা যখন ১ মিনিট নিরবতা পালন করি, তখন সেই সামান্য সময়টাকেই কত দীর্ঘ মনে হয়। আর এখানে ৩ বছরের শিশুকে ৩ মিনিট একটা বিরক্তিকর কাজ দেওয়া হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, শারিরীক বা মানসিক শাস্তির মত কঠিন শাস্তি না দিয়ে এই রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করা অনেক ভাল। সব চেয়ে বড় কথা Time out কোন শাস্তি নয়। এটি শিশুকে শৃংখলা শেখাবার অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে একটি উপায় মাত্র।
৪.
‘’মাইরের উপর ঔষধ নাই’’ এই থিওরীতে বিশ্বাসী মানুষ আমাদের খুব ধারে কাছেই অবস্থান করছে। তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাই খুব সামান্য কারণে শিশু বা শিক্ষার্থীদের শারিরীক শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে। মাইর যদি সত্যিই ঔষধ হয়ে থাকে তবে এটা হওয়া উচিত সর্বশেষ ঔষধ। আর এই ঔষধ ব্যবহার না করেই যতটা সম্ভব লক্ষ্য অর্জন করা উচিত। অথচ আমাদের দেশের শিশুদেরকে এই মাইরের মত হাই পাওয়ারের ঔষধ গিলিয়ে দেওয়া হয় প্রথমেই। ফলে শৃংখলা শেখানোর জন্য Time out পদ্ধতির বিরুদ্ধে শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা (resistance power) তৈরি হয়ে যায় অনেক আগেই।
২৯ জুলাই, ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৮:০০