শিক্ষার্থীদের মত গার্জিয়ানও নানা ধরনের হতে পারে। মোটা দাগে তাঁদেরকে কয়েকটিভাগে আমি ভাগ করেছি। যেমনঃ
# ক্যাটাগরি ১: মাথা গরম গার্জিয়ানঃ সন্তান কতটুকু শিখল তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই এ ধরনের গার্জিয়ানদের। ১ নম্বর কম কেন পেল তাই নিয়ে মহা হুলস্থূল সৃষ্টি করতে পারেন এ ধরনের গার্জিয়ানেরা। যেন শিক্ষকেরা শত্রুতা করে নম্বর কম দিয়েছে তাঁর সন্তানকে। ভুলটা দেখিয়ে দেবার পরেও অনেক সময় মেনে নিতে চান না। প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ জানিয়ে আসেন। অনেক শিক্ষক অহেতুক ঝামেলা এড়াবার জন্য নম্বরটা দিয়ে দেন। সামান্য কয়েকটা মাত্র নম্বর!
# ক্যাটাগরি ২: এ ধরনের গার্জিয়ানেরাও সন্তান কতটুকু শিখল বা জানল তা নিয়ে ভাবেন না। ভাল ফলাফলই মুখ্য। উত্তর ভুল জেনেও নম্বর বাড়িয়ে দেবার জন্য বিনীত অনুরোধ করে থাকেন। তা নইলে তার সন্তানের রেজাল্টটা যে এবার অল্পের জন্য খারাপ হয়ে যাবে! শিক্ষকদেরকে এ ধরনের গার্জিয়ানদের জন্য অনেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। বিশেষ করে যদি অন্য শিক্ষকদের এ ব্যাপারে পরোক্ষ সমর্থন থেকে থাকে। পরবর্তীতে এসব অভিভাবকদের সন্তানেরাও শিক্ষকদের কাছে ভুল উত্তরে নম্বর বাড়িয়ে দেবার অন্যায় আবদার করে বসে।
# ক্যাটাগরি ৩: এ ধরনের অভিভাবকেরা নিজে থেকে আসেন না। শিক্ষার্থীর কোন অপরাধ বা সমস্যার কারণে খবর দিয়ে এ ধরনের অভিভাবকদের ডাকা হয়ে থাকে। কাউকে কাউকে বারবার জানানোর পরে হঠাৎ একদিন অসময়ে এসে হাজির হন। কেউ কেউ কখনোই আসেন না।
# ক্যাটাগরি ৪: নিজে থেকে আসেন, সন্তানের কোন সমস্যার কথা শিক্ষকের সাথে শেয়ার করে পরামর্শ নিতে।
# ক্যাটাগরি ৫: এদেরকে আমি বলি অতি সচেতন অভিভাবক। সন্তানের যে কোন ব্যাপারেই তাঁরা অতি মাত্রায় চিন্তিত থাকেন। যে সন্তানকে নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই, তাকে নিয়েও সারাক্ষণ চলছে দুঃশ্চিন্তা! কী করবেন, কী করবেন না, তাই নিয়ে দ্বিধান্বিত। এ ধরনের অভিভাবকদের হাত থেকে সহজে ছাড়া পাওয়া জো নেই। মূল্যবান অনেকটা সময় এরা খেয়ে ফেলে।শিক্ষার্থীগুলোর মাথাও অনেকটা নষ্ট করে দেন তারা।
#ক্যাটাগরি ৬: এটা একটু বিশেষ ধরনের অভিভাবক। এদের নাম দেওয়া যায় ছদ্ম অভিভাবক। অভিভাবক না হয়েও তারা আসেন। খুব একটা বেশি দেখা যায় না এদের। মাঝে মাঝে দু-একজন হঠাৎ। আমি একজন পেয়েছিলাম এই ধরনের অভিভাবক। সে ছিল আমার এক ছাত্রীর প্রণয়াকাংখী। রেজাল্টের দিনেই কোত্থেকে হাজির হয়ে যেত রিপোর্ট কার্ড নিতে। আর লিগাল গার্জিয়ান না হবার কারণে ওই ছেলেকে আমি কার্ড কখনোই দিতে পারতাম না। এমন কি ছাত্রীর বাবাকে ঐ অচেনা অভিভাবকের কথা বলে সাবধান করে দিতে চাইলেও তাঁর মধ্যে কোন আশংকার চিহ্ন আমি দেখতে পেতাম না। ঐ বাবাটি ছিলেন আমার দেখা একজন ক্যালাস গার্জিয়ান।
#ক্যাটাগরি ৭ঃ ক্যালাস গার্জিয়ান। এর কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারণত এ কয় ধরনের অভিভাবকেরাই শিক্ষকদের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে আসেন। আজকে না জানি কোন ক্যাটাগরির অভিভাবক এসেছে আমার কাছে! খুব কাঁচুমাচু মুখে ভদ্রলোক এলেন আমার কাছে।
--কী ব্যাপারে?
--এই রিপোর্ট কার্ডটা কি আপনার কাছে জমা দিতে হবে?
--ওহ! এটা জমা দেবার জন্য আপনার এত কষ্ট করে আসার কোন দরকার ছিল না। ছেলেকে দিয়ে পাঠালেই তো পারতেন!
রিপোর্ট কার্ডটা জমা নিয়ে নিই আমি। দেখি ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন। অল্প কথায় আমি ভদ্রলোককে বিদায় করে দিতে চাই।
--আর কিছু বলার আছে আপনার?
-- আপা, আমার ছেলের রোল এত। আপনি কি ওকে চেনেন?
--আসলে আমি তো ওদের ক্লাসের ক্লাস টিচার না। ওদের টিচার না থাকার কারণে কার্ডটা আমি তৈরি করেছি শুধু। ওদের ক্লাসেও আমার ক্লাস নেই। তাই চিনতে পারছি না। কেন বলুন তো?
--আপা, আমার ছেলের কিছু সমস্যা আছে। ছোটবেলায় পড়ে যেয়ে মাথায় অনেক আঘাত পায়। আগে ছাত্র ভাল ছিল। এখন একটু সমস্যা হয়।
রিপোর্ট কার্ডটা খুলে ওর রেজাল্টটা বোঝার চেষ্টা করি। এই শাখার শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শাখার শিক্ষার্থীদের তুলনায় একটু কম মেধাবী (কম মেধাবী কথাটা যদিও ঠিক নয়) ।গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো সবগুলো এই শাখায় এসে জড়ো হয়েছে। এবার আমি রেজাল্ট করতে গিয়ে দেখি বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই একাধিক বিষয়ে খুবই খারাপভাবে ফেইল করে বসে আছে। অনেকেই সব বিষয়ে ফেইল করেছে। হাতে গোনা দুই কি একজন সব বিষয়ে পাশ করেছে। কিন্তু খুব ভাল নম্বর নিয়ে নয়। এই ছেলেটি সেই দু-একজনের মধ্যে একজন।
--আপনার ছেলে তো সব বিষয়ে পাশ করেছে। আমি তো চিন্তার কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
-- আপা, আমার বড় ছেলেটা ক্যাডেট কলেজে পড়ে ওকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। খুব মেধাবী। এই ছোট ছেলেটাও খুব মেধাবী ছিল। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনার পরে অনেক ধীর গতির হয়ে গেছে। পরীক্ষাতে সব প্রশ্নের উত্তর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিখে শেষ করতে পারে না। বোঝেও কম।
--কিন্তু আপনার ছেলের রেজাল্ট তো ওদের ক্লাসের সবার থেকে ভাল। সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেমেয়েরাও সব বিষয়ে পাশ করতে পারেনি। ক্লাসের দু-একজন যারা সব বিষয়ে ভাল ভাবে পাশ করেছে আপনার ছেলে তাদের মধ্যে একজন।
দেখি বয়ষ্ক একজন ভদ্রলোক হঠাৎ শিশুর মত কাঁদতে শুরু করেছেন। এ কান্না কষ্টের না আনন্দের ঠিক বোঝা যায় না। আমি তাঁকে কোন ক্যাটাগরির অভিভাবকদের তালিকায় ফেলতে পারি না। আমার সামনে একজন স্বপ্নাহত দুঃখী বাবা অসহায়ের মত কাঁদছেন। এই বার আমি তাঁকে বসতে বলি।
--কবে হলো এই এক্সিডেন্ট?
--ক্লাস ফাইভে যখন পড়ে তখন, একদিন পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়।
--আপনার ছেলে এত সমস্যার মধ্যে থেকেও ভাল রেজাল্ট করছে। ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। ও অনেক ভাল করবে। আর ওকে পড়ালেখা নিয়ে কোন চাপ দেবেন না। নিজে থেকে যতটুকু পড়ে, ততটুকুই পড়তে দেবেন।
--না, আমরা ওকে কোন চাপ দেই না। ওর নিজেরই পড়ালেখা করার ব্যাপারে খুব আগ্রহ। কিত্নু পরীক্ষাতে সময়ের সাথে ও কুলিয়ে উঠতে পারে না।
--দরকার নেই। ও ধীরে সুস্থেই পরীক্ষা দিক। ওর তো ফার্স্ট সেকেন্ড হবার কোন দরকার নেই। ও যেটুকু করছে সেটাই অনেক। অনেক সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেমেয়েরাও এটুকু করতে পারে না।
ভদ্রলোক তখনও কাঁদছেন, কিন্তু একটা স্বপ্ন তার চোখের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি সেটা। ছেলেকে নিয়ে সূক্ষ্ণ একটা গর্বও অনুভব করছেন।
--আপা, আমার ছেলেটাকে একটু দেখবেন।
--ওদের সাথে তো আমার ক্লাস নেই। আচ্ছা, আমি যতটুকু পারি দেখব।
(কিছু কিছু অভিভাবক আছেন, তারা শিক্ষকদের এত মহান ভেবে বসেন! )
--আপনি কি জানেন, এ ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষায় ১৫ মিনিট বেশি সময় দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?
--না।
--আপনি যদি আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারেন তবে হয়ত জে এস সি পরীক্ষায় এ সুবিধা পেতে পারেন।
আমি আমার যতটুকু বলার সংক্ষেপে বলে কথা শেষ করতে চাচ্ছিলাম। খাতাগুলো দেখতে হবে। কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই উঠছিলেন না। অশ্রুভেজা চোখে আরো কয়েকবার তারঁ বড় ছেলের কথা, ছোট ছেলের কথা, ছেলের সমস্যার কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে লাগলেন। আমাকেও মনোযোগ দিয়ে সেই কথাগুলো আরো কয়েকবার শুনতে হলো। ভদ্রলোক একটা বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। যতদিন না তাঁর এই সমস্যার সমাধান হবে, ততদিন তিনি যাকে পাবেন তার কাছে এই কথাগুলো ক্রমাগত বলে যাবেন। ভদ্রলোক যতবার তাঁর সমস্যার কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন, আমিও ততবার তাঁকে সেই একই কথা বারবার বুঝিয়ে বলি। কাজ হয় কিনা জানি না। আমি যখনই সুস্থ শিক্ষার্থীদের সাথে তাঁর সন্তানের তুলনা করি, তখনই দেখি, ভেতর থেকে একটা চাপা কান্না আগ্নেয়গিরির মত ফেটে বেড়িয়ে যেতে চাইছে।
ভদ্রলোকের উঠার কোন নাম গন্ধ আমি দেখতে পাই না। আবারো সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি হল কিছুক্ষণ। হয়ত কান্না সামলাতে পারছেন না বা কান্নাভেজা চোখে বাইরে যেতে লজ্জা পাচ্ছেন, তাই বসে আছেন। একসময় নিজেই বুঝতে পারলেন আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। তারপরে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। চলে যাবার সময় তাঁকে কিছুটা নির্ভার মনে হল, যেটা তাঁর আসার সময় ছিল না। ভাল লাগলো ব্যাপারটা আমার কাছে।
৮ জুন, ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:১১