somewhere in... blog

চট্টগ্রামী ভাষা (একটি তাত্ত্বিক আলোচনা)

১৭ ই অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চট্টগ্রামী ভাষা
কাফি কামাল
চট্টগ্রামী- আমার মাতৃভাষার নাম। ভূ-বৈচিত্র্য, নৃ-বৈচিত্র্য আর ভাষা বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে উদ্ভির্ণ। বহু জাতির সংশ্লেষ আর বহু ভাষার সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার বহুধা প্রভাবের নাগপাশে থেকেও স্বতন্ত্র। রাষ্ট্রকাঠামোহীনতার যন্ত্রনা, শাসনকেন্দ্রের অবহেলার প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে পূর্ণযৌবনা নদীর মত বহমান। তথাপি, কৌতুহলী অন্বেষা ও সাহসী পদক্ষেপের অভাবে স্বীকৃতিহীন। একটি স্বতন্ত্র ভাষার প্রায় সকল বৈশিষ্ঠ্য বিদ্যমান থাকার পরও উপ বা আঞ্চলিক ভাষার তকমায় বাংলার কারাগারে বন্দী। কবে কাটবে চট্টগ্রামী ভাষাভাষীর ঘোর, মুক্তি পাবে আমার মাতৃভাষা?
চট্টগ্রামীভাষাভাষীদের এখন ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠার সময়। কারণ চট্টগ্রামী যেমন ভূইফোঁড় ভাষা নয়। এ ভাষার শেকড় অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাও আকস্মিক নয়। যখন বাংলা ভাষাতত্ত্ব চর্চারই ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়নি তখনই গ্রীয়ার্সন, লক্ষন মজুমদার, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীরা চট্টগ্রামী নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবে রূপ পায়নি। এ রূপ না পাওয়ার কারণ ছিল বহুবিধ এবং প্রাসঙ্গিক। সে প্রসঙ্গ পাল্টে, কারণের শৃঙ্খল ভেঙে সামনে যাওয়ার দিন এখন। মনে হতে পারে- এ কাজ তো ভাষাবিদদের। প্রশ্ন আসতে পারে- কেন জেগে ওঠতে হবে? উত্তরে ড. মনিরুজ্জামানের একটি বক্তব্য ধার করে বলি- ‘এ কথা সত্য, ভাষার তথ্য যথাযথ উপস্থিত করার দায়িত্ব প্রধানত সেই ভাষাভাষির; পরে বিশেষজ্ঞের।’ তাই চট্টগ্রামভাষাভাষীরা কৌতুহলী হলে, দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে একদিন ভাষাতাত্ত্বিকরা নেমে পড়বেন অনুসন্ধানে, মেতে উঠবেন যুক্তিতর্কের বিচারে।
আসুন, একবার আমাদের সে সন্ধান ঐতিহ্যের স্মরণ করা যাক। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৯১৯ সালে প্রকাশিত তার ‘ইসলামাবাদ’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, ‘লিখিত ভাষার সহিত উহার (চট্টগ্রামের কথ্যভাষা) বৈষম্য খুবই বেশী- এত বেশী যে চেষ্টা করিলে আসামীদের (অসমীয়া) মত আমরাও অনায়াসে একটা পৃথক ভাষার সৃষ্টি করিতে পারিতাম। কিংবা বহু বিষয়ে সাদৃশ্য থাকিলেও চট্টগ্রামের ভাষা ঠিক পূর্ববঙ্গের ভাষা নহে। তবে নোয়াখালী ও ত্রিপুরার ভাষার সহিত ইহার কিছু সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ...এটি একটি পৃথক ভাষার সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে আছে; একটি উপভাষা হয়েও বহিঃপৃথিবীর সাথে এর সংস্রব ও সংযোগ এর ধ্বনি ও ব্যাকরণের বহু এলাকাকে উন্নীত ও প্রসারিত করেছে এবং ইহার মত সমৃদ্ধশালিনী ও সর্বাঙ্গসম্পূর্ণা ভাষা বাঙ্গালার অন্যত্র খুব কমই মিলিবে। ...চট্টগ্রামের ভাষা ঠিক ‘পূর্ববঙ্গে’র ভাষা নয়। অর্থাৎ ধ্বনি প্রকরণে ও ব্যাকরণে চট্টগ্রামের উপভাষা পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা সমূহের সমশ্রেণীর ভাষা নয়।’ এ দাবির পক্ষে সাহিত্য বিশারদ ব্রিটিশ পণ্ডিত গ্রীয়ার্সনকে স্মরণ করে বলেছেন, ‘বহু ভাষাবিৎপণ্ডিত মি. গ্রীয়ার্সনও যে ভাষার নিখুঁত উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করিতে পারেন নাই, সে ভাষার নিখুঁত উচ্চারণ লিখিয়া প্রকাশ করা যে অত্যন্ত দুরূহ বিবেচিত হইবে, তাহাতে আর বৈচিত্র্য কিছুই নাই।’ তাহলে গ্রীয়ার্সন কি বলেছিলেন? গ্রীয়ার্সন তার ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাংলা থেকে অসমীয়া ভাষার দূরত্ব যতখানি, চট্টগ্রামী বুলির স্বাতন্ত্র্য তদপেক্ষা দূরত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম।’ গ্রীয়ার্সন তার আলোচনায় চট্টগ্রামী উপভাষাকে ‘দক্ষিণ-পূর্ববাংলা’ উপভাষার অন্তর্গত করে ‘চাটগাইয়া’ নামকরণটিকে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন।
শুধু কি গ্রীয়ার্সন? বাংলাভাষী বহু পণ্ডিত চট্টগ্রামীর স্বাতন্ত্র্য স্বীকার, মৌন স্বীকার করেছেন। গদ্যকার প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’ তার এ বক্তব্যই প্রমান করে চট্টগ্রামী ভাষা বাংলা নয়। কারণ নিহত হওয়া মানে অন্যপারে চলে যাওয়া। বাংলার কাছাকাছি হলেও বাস্তবে চট্টগ্রামী অন্যপারেরই ভাষা। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে হলেও তো আসলে লুপ্ত আরাকানের উত্তর-পশ্চিমাংশের ভাষা। বোদ্ধা এবং সহৃদয় বাংলাভাষী মাত্রই এ সত্য স্বীকার করবেন। সম্প্রতি জার্মান গবেষক ড. হান ও ফিনল্যাণ্ডের ফোকলোর গবেষক ড. ভেলাইটি চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ সময় চট্টগ্রামের সাহিত্যিক মহলের বিভিন্ন ঘরোয়া আলাপে তারা বলেছেন, ‘চট্টগ্রামী সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভাষা, এটি বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়।’ কবি বুদ্ধদেব বসু’র মুখের বোল ফুটেছে পিতার কর্মত্রে নোয়াখালীতে। সেখানেই তাঁর বেড়ে উঠা। অবাক বিষ্ময়ে তিনি নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে অনুধাবন করেছেন। এ অঞ্চলের ভাষার মাধুর্য নিয়ে তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘আর কোথাও শুনিনি ঐ ডাক, ঐ ভাষা, ঐ উচ্চারণের ভঙ্গি। বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের ভাষা বৈশিষ্ট্য বিস্ময়কর। চাটগাঁর যেটা খাঁটি ভাষা, তাকে তো বাংলাই বলা যায় না।’
কিংবদন্তী আছে, একবার কলকাতার এক ভদ্রলোক চট্টগ্রাম এসে চট্টগ্রামী ভাষায় দুইজন স্থানীয় মানুষের আলাপ শুনে এর অর্থ জেনে নেন। পরে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাঃ এযে দেখচি চমৎকার ভাষা! ইংরেজিতে শর্ট-হ্যাণ্ড (ঝযড়ৎঃ ঐধহফ) আছে। কিন্তু শর্ট-মাউথ (ংযড়ৎঃ সড়ঁঃয) নেই। চাঁটগেয়ে বাঙ্গালিরা এ ব্যাপারে ইংরেজদের ওপরও টেক্কা দিয়েছেন দেখছি। তারা শর্ট-মাউথ বের করে ফেলেছে দেখছি।’ আরেকটি কিংবদন্তী হচ্ছে- ‘সিলেটি অসমিয়ার খালাতো ভাই, আর চট্টগ্রামী আরাকানী আপন ভাই।’ এ কিংবদন্তীর পেছনে যে যুক্তি আছে তা হচ্ছে- বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলো মোটামুটি বাংলার কাছাকাছি। কেবল চট্টগ্রামী আর সিলেটি ছাড়া। বাংলার সঙ্গে চট্টগ্রামীর ব্যবধান আরেকটি জায়গায় সুস্পষ্ট। বাংলা হচ্ছে- বর্ণনাত্মক ভাষা আর চট্টগ্রামী হচ্ছে ডায়ালেকটিক। শিক্ষিত লোকমাত্রই জানেন, এক সময় বলা হতো- বাংলাভাষার জন্ম সংস্কৃতির বিকৃত রূপ থেকে। দাবি করা হতো- বাংলা সংস্কৃতির দুহিতা। পরে আবিস্কার হলো বাংলার উৎস সংস্কৃত নয়, প্রাকৃতের অপভ্রংশ। এখন চট্টগ্রামীকে বাংলার উপ বা আঞ্চলিকভাষা দাবি করা হলেও একদিন এ দাবি মিথ্যা প্রমান হবে। স্বীকৃতিহীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে আমার মাতৃভাষা চট্টগ্রামী।
চট্টগ্রামী কেন স্বতন্ত্র ভাষা? বাংলাভাষার পূর্বাপর অবস্থার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ভাষার নানা আঞ্চলিক বিকাশ বা বৈচিত্র্য ধারনের মধ্যে ইতিহাসের সংরক্ষিত সূত্রগুলি লক্ষ্য করে ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভৌগোলিক সীমা বিভাজন দ্বারা বাংলার একটি শ্রেণীকরণ করেন। তার শ্রেণীকরণের (রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, কামরূপী, বঙ্গালী) মধ্যে চট্টগ্রামী (চট্টগ্রাম অঞ্চল) নেই। সুকুমার সেনও এ শ্রেণীভাগ মেনেছেন। দুই বিখ্যাত ভাষাবিদদের বিবেচনা থেকে পরিস্কার হয়; চট্টগ্রামী কোনভাবেই বাংলার উপ বা আঞ্চলিক ভাষা নয়। ভাষাবিদ ড. মনিরুজ্জামান তার ‘উপভাষা চর্চার ভূমিকা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘চট্টগ্রামীর অক্ষর-ঝোঁক, হ-উহ্যতা এবং আন্তঃস্বরীয় ব্যঞ্জন ধ্বনির লোপ বা দ্বিত্বতা ও তৎসহ শব্দগঠনে সংকোচন সংক্ষেপন প্রবণতাই বাংলাদেশের অপরাপর উপভাষা থেকে একে পৃথক করেছে। ...বাংলা ভাষার উপভাষাগুলির মধ্যে সিলেট, নোয়াখালী ও চাঁটগার উপভাষা কিছু স্বাতন্ত্রের অধিকারী। সিলেটি ভাষা ‘টানের’ দিক থেকে, নোয়াখালি দ্রুততার দিক থেকে ও চট্টগ্রামের ভাষা স্বরধ্বনি বহুলতা ও শব্দ সংকোচন বা সংক্ষেপিকণের দিক থেকে আবার ভিন্ন।’ সাহিত্যবিশারদের মতে, চট্টগ্রামী একটি মিশ্রভাষা। তবে গ্রীয়ার্সন, মুনীর চৌধুরী এবং আরও অনেকে এই দূরপ্রান্তীয় অঞ্চলের ভাষাকে ‘দক্ষিণ-পূর্ব উপভাষা’ অঞ্চলের বিভাষা রূপেই দেখেছেন। তথাপি ক্বচিৎ আবার সাধারণ পরিচয়ের জন্য অনেকে ‘পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার’ সাথেই দূরবর্তী সম্পর্কে সম্পর্কিত করে দেখেছেন। মনসুর মুসা এ দূরবর্তী সর্ম্পককে সমর্থন করে বলেছেন- ‘বাংলাভাষার সবচেয়ে দূরবর্তী উপভাষাটিই চট্টগ্রামী।’ আর এ দূরবর্তী সম্পর্কের তৈরির পেছনে কাজ করছে রাষ্ট্র কাঠামো। যদি বৃহত্তর চট্টগ্রাম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে না হতো তবে ভাষাতাত্ত্বিকরা নিশ্চয় এ দূরবর্তী সম্পর্কটি পাততে যেতেন না। এ ব্যাপারে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘চট্টগ্রামীকে পৃথক উপশ্রেণীভুক্ত করার যুক্তি এই উপভাষার মধ্যেই নিহিত: ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা থেকে তার পার্থক্যটি স্পষ্ট। চট্টগ্রামীর দূর্ভাগ্যের বিষয়টি এখানে যে, বাংলাভাষী পণ্ডিতরা যেভাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার সাধনা করেছে তা চট্টগ্রামীভাষীরা করেনি। আর বাংলা ও চট্টগ্রামীভাষী পণ্ডিতদের যথাযথ আগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কোনটিই পায়নি চট্টগ্রামী।
কিভাবে স্বতন্ত্র হয়েছে? প্রশ্ন আসতেই পারে। তাহলে ব্যাকরণগত কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যাক। বাংলা ভাষায় বিরল কিন্তু চট্টগ্রামীতে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর কিছু উদাহারণ হচ্ছে- উচ্চারণ বৈচিত্র্য, শব্দার্থ বৈচিত্র্য, শব্দায়ব সংপে পদ্ধতি ও শব্দ যোজন রীতি। উচ্চারণ বৈচিত্র; যেমন: সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ‘এ-কার’ লোপ পেয়ে শেষের বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়। শব্দের শুরুতে শ, ষ, স থাকলে অনেক সময় ‘হ’ বর্ণে রূপান্তরিত এবং একই শব্দ উচ্চারণের দীর্ঘ-হ্রস্বের কারণে অর্থ পাল্টে যায়। শব্দার্থ বৈচিত্র; বাংলা মান ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ চট্টগ্রামীতে এসে ভিন্ন অর্থ তৈরি, কোন বিশিষ্ট দীর্ঘভাবকে সুন্দরভাবে এক বা অল্পকথায় প্রকাশ করার অপরিসীম মতা এবং প্রতিশব্দের আধিক্য ইত্যাদি। শব্দায়ব সংক্ষেপ; ঐতিহাসিক নানা কারণে চট্টগ্রামবাসীর উচ্চারণ-ত্রস্ততায় অর্জিত গুনে বাংলা ভাষার দীর্ঘ বাংলা শব্দের সংপ্তি অবয়ব বা শব্দায়ব সংপে পদ্ধতি। চট্টগ্রামীতে শব্দের মধ্যস্থিত ‘ব’ লোপ পায় (রবিবার-রইবার) ও ‘ম’ আনুনাসিক চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এবং শব্দান্তের বা মধ্যে ‘ক’ গ হয়। শব্দযোজন রীতি; বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপভাষার মত পরম্মুখ না হয়ে চট্টগ্রামীতে অনেক শব্দ মিলে এক শব্দ হয়ে যায়। এছাড়া উর্দু ও হিন্দির মত ঋণাত্বক পদ ক্রিয়ার পরে না বসে আগে বসাটিও একটি স্বতন্ত্র ভাষার লক্ষন। ভাষাবিদদের মতে, আইরিশ ইংরেজি ও মূল দ্বীপের ইংরেজির ব্যাকরনী ভেদ যেমন দু®প্রাপ্য নয়, তেমনি বাংলা উপভাষাতেও চট্টগ্রামী বাংলায় বাক্যগঠন রীতি অপর প্রান্তীয় ভাষা রংপুরী বাক্যগঠন রীতির সাথে মিলে (আঁই ন যাই/না জাঁও মুইদি)। এই পদক্রম রীতির ঐতিহাসিক সংরক্ষণ অন্য উপভাষায় দূর্লভ। উচ্চারণ সহজীকরণ তথা সংক্ষেপণ এখানকার লোকদের একটা স্বভাব। কিছু কিছু পণ্ডিত এটাকে উচ্চারণের কোমলীকরণ বলেও মত দিয়েছেন। এছাড়া পদমধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায়ই লোপ বা বিকৃত (কোমল) হয়। পূর্ণবিকৃতিও কম নয়। ধ্বনিতত্ত্বে ঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ ‘ঘ’, ‘ধ’, ‘ভ’ প্রভৃতি এবং আদি ‘হ’ রতি আছে। রূপতত্ত্ব একবচনে ‘র’, অধিকরণের এক বচনে ‘ত’ বিভক্তি (বাড়িতে-বাড়িত্)। নিষেধার্থক অব্যয় ‘ন’ ক্রিয়ার আগে (গেল না- ন গেল) বসে। চট্টগ্রামীতে ক ও খ, প ও দ উচ্চারণে একটু বৈচিত্র আছে। ক খ-এর মতো এবং প ফ-এর মতো উচ্চারিত হয় কিন্তু তেমন জোর পড়ে না। অনেক সময় ‘র’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করা হয়।
ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারে ড. মনিরুজ্জামান তার ‘উপভাষা চর্চার ভূমিকা’ গ্রন্থে বলেন, ‘ইংরেজিতে ও ফড় হড়ঃ মড়; এর ঝখঅঘএ- ও হড়ঃ মড়; চাটগোঁয়ে- ‘আঁই ন যাই’। রূপতত্ত্বের দিক থেকে বাক্যগঠনের এই ভঙ্গিটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রদেশের উপভাষায় ‘আমি’ বড় জোর ‘আমি-এ’ অর্থাৎ অন্তঃস্বরের ভঙ্গি একটা থাকে, আবার থাকেও না। ...কিন্তু দ্রুত বলার সময় নাকের অতি সুপ্ত একটা ব্যঞ্জনা স্পর্শলাভ করে এই ধ্বনিগুলি চাপা হয়ে বেরিয়ে আসে। অভিশ্রুতি ‘যাবো’, অপিনিহিতি- যাইবো, বিকল্পে- যাইমু; চট্টগ্রামে যাইয়ুম। - এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব এ ভাষায় অধিক। একটানা টেনে বলা এখানকার নিয়ম। ফলে প্রথম ধ্বনিগুচ্ছ ও শেষ ধ্বনিগুচ্ছ ধরেই প্রায় এদের বাক্য সম্পূর্ণ হয়। মধ্যের সকল ধ্বনি বা শব্দ উচ্চারিতও হয় না। ...এই উপভাষায় অন্তঃস্থ বর্ণগুলি যত স্পষ্ট উচ্চারিত হয়, অন্য উপভাষায় তা তত হয় না। এখানে এষরফরহম ংড়ঁহফ ও ঝবসর াড়বিষ- এর বিচিত্র ব্যভহারও লক্ষ্যনীয়। স্পর্শ বর্ণগুলিকে- (ক, খ, গ, ঘ; চ, ছ, জ, ঝ; ট, ঠ, ড, ঢ; ত, থ, দ, ধ; প, ফ, ব, ভ) বেমালুম স্বরধ্বনিতে পরিণত করে। মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের মত (যেমন প্রাকৃতের- পাউঅইঃ); স্বরধ্বনি প্রবণতাই এর কারণ। ‘বইয়ো’ বা ‘বইঅ’ (ব’স) ধ্বনিটির উচ্চারণ কালে এই তিনটি কথারই প্রমাণ পাওয়া যায়। আনুনাসিক ব্যঞ্জনাও এ ভাষার একটা নিয়মিত ফলশ্রুতি। ‘মামু’ শব্দের সবগুলি স্বর আবার কেব ‘ম’ এই ডাকে এসে দাঁড়ায়, তখন বেকল তাতে আশ্চর্যই হতে হয়।’
বাংলাভাষীরা প্রায়শই বর্ণমালার অভাবকে দিয়েই ঘায়েল করতে চায় চট্টগ্রামীকে। ক্ষয়িঞ্চু জমিদারের মত চট্টগ্রামীকে দাবি করেন বাংলার আঞ্চলিকভাষা। কিন্তু চট্টগ্রামী ভাষার অবোধ্যতা ও উচ্চারণ নিয়ে পরিহাস করার হীন মানসিকতা লুকোতে পারেন না। কি অদ্ভুত স্ববিরোধীতা! আসলে ভাষার বিকাশে অনেক সময় একটি তৃতীয়ভাষা দূর থেকেও কাছের এবং একটি আপন ভাষা কাছে থেকেও পর হয়ে থাকতে পারে। যেমনটি হয়েছে- চট্টগ্রামীর ক্ষেত্রে। ভাষাগোষ্ঠীগত সম্পর্কের পরও প্রতিটির স্বাতন্ত্র্যের পক্ষে ভাষাবিদরা নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, পৃথিবীর কোন ভাষাই স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। সব ভাষাতেই কিছু না কিছু বিদেশী বা ভিন্ন ভাষার শব্দ থাকে। ভাষা সচেতন বাঙালি মাত্রই জানেন, হাজং উপজাতির ভাষার সঙ্গে বাংলা ও অহমিয়া ভাষার মিল আছে। অন্যদের মধ্যে- খাসিয়া ভাষা বৃহত্তর অষ্ট্রিক পরিবারের মন-মের শাখার এবং খ্যাং ভাষা ভোট-বর্মী শাখার কুকি-চীন দলের অন্তর্ভুক্ত। আবার ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ েেত্র লুসেইদের সঙ্গে পাংখোয়াদের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। লুসেই ও ম্রো ভাষা তিবেতো-বর্মণদল এবং চাক ভাষা তিবেতো-বর্মণ দলের সাক বা লুই দলভুক্ত। রাখাইন ও মারমা ভাষা বর্মীদল, পাংখুয়া ভাষা দণি-চীন এবং বোম ও খুমি ভাষা কুকি-চীন এবং ত্রিপুরাদের কক্বরক্ ভাষা বোডো দলের অন্তর্ভুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো মধ্যে খিয়াং জনগোষ্ঠীর ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই। মুরং এবং খুমিদেরও ছিল না। গত শতাব্দীর শেষদিকে এসে মেনলে ম্রো নামের এক তরুণ মুরং বর্ণমালা তৈরি করেন। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী খুমিদের বর্ণমালা তৈরি করা হয়েছে রোমান বর্ণে। আবার বম, লুসাই ও পাংখোয়াদের বর্ণমালা মূলত একই। এ ধরনের দ্বৈত ভাষা রূপ রয়েছে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের চাকমা প্রাইমার, মারমা ও চাকদের চা আক্খ্রায়। মণিপুরীদের ভাষা বাংলা হরফেও লেখা হয়। কিন্তু এসব ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা বলতে কারও আপত্তি দেখা যায় না। ভারতে ২ হাজারেরও বেশী ভাষা আছে। কেরালা, মালায়ালম ও তেলেগু ভাষা শুনলে মনে হয় কৌটার মধ্যে নুড়ি পাথর রেখে ঝাঁকানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে কি ভারতীয়রা সেগুলোকে হিন্দী বলে দাবি করে? হিন্দী এবং উর্দু প্রায় কাছাকাছি একটি ভাষা। সমঝদার ছাড়া এ ভাষা আলাদা করা সহজ নয়। কিন্তু এরা তো পরস্পর পরস্পরকে নিজের বলে দাবি করে না। ধরলাম বাংলা থেকেই চট্টগ্রামীর জন্ম। তাতে কি? উর্দু তো লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা। বাংলাও তো অন্য ভাষা থেকেই এসেছে। বাংলা যদি প্রাকৃতভাষার অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা হতে পারে তবে বহুভাষার সংমিশ্রণ থেকে উৎপন্ন চট্টগ্রামী কেন স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পাবে না?
ভাষা সচেতন বাঙালি মাত্রই জানেন, বাংলা এবং অসমিয়া বর্ণমালায় অনেক মিল আছে। দুইভাষায় শব্দ, এমনকি অনেকক্ষেত্রে পুরো বাক্যেরও মিল রয়েছে। আবার বাংলাভাষার সাথে চাকমা ভাষার পার্থক্য কোথাও অসমীয়ার মত, কোথাও চট্টগ্রামীর মত। চট্টগ্রামী ও চাকমা ভাষায় আন্তঃস্বরীয় অঘোষ ধ্বনি লুপ্ত হয়। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত কথ্য ভাষার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ষ্পষ্টত: প্রমাণিত হয়, তা বাংলা চট্টগ্রামী ভাষারই অপভ্রংশ। চট্টগ্রামীর অপভ্রংশের মতো উচ্চারণ রীতি ব্যবহার করলেও চাকমা ভাষার বর্ণমালা বর্মী আদলে তৈরি। ব্রিটিশ আমলে কর্মরত চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার জিন বিসম ১৮৭৯ সালের ৫ই অক্টোবর রাজস্ব বোর্ডের কাছে লেখা এক পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘চাকমাগণ অর্ধ বাঙ্গালী। বস্তুত ইহাদের পোশাক পরিচ্ছদ এবং ইহাদের ভাষাও বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ মাত্র। এতদ্ভিন্ন চাকমাদের উপাধি ভিন্ন নামগুলোও এমন বাঙালী ভাবাপন্ন যে, তাহাদিগকে বাঙালী হইতে পৃথক করা একরূপ অসম্ভব।’ আসলে জিন বিসম এখানে বাঙালি বলতে চট্টগ্রামীদেরই বুঝিয়েছেন। কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়–য়া তার ‘নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও বাংলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘চাকমাদের ভাষা হিন্দ-আর্য শাখার অন্তর্ভূক্ত। তাদের ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার নিকটবর্তী। তাদের হরফের সঙ্গে কম্বোডিয়ার মনমের হরফ এবং বর্মী হরফের সাদৃশ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন চাকমারা আসামে বসবাসের সময় শানদের কাছ থেকে এই হরফ পেয়ে থাকবেন। চাকমা সাহিত্য উন্নত বাংলা হরফেও এই সাহিত্য রচিত হয়।’ ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেন, চাকমা আদপে একটি ভোট-বর্মীদলের ভাষা হয়েও ইন্দো-ইউরোপিয়দলের ভাষায় অপসারিত হয়েছে। এতে আন্দাজ করা যায়, চাকমাদের আগেই চট্টগ্রামী সে পথে হেঁটেছে। যার কারণে আজকের চট্টগ্রামীকে বাংলার আঞ্চলিক বা উপভাষা বলার বহু যুক্তি সামনে এসে দাঁড়ায়। চট্টগ্রামীতে ক্ষেমারজাত শব্দ- গম, লাঙ এর পাশাপাশি দ্রাবিড় শব্দ পোয়া মিলে নতুন অর্থ তৈরি (গম পোয়া- ভাল ছেলে) করেছে। উপরের দুইটি বক্তব্যে ও যুক্তিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, চট্টগ্রামী ইন্দো-ইউরোপিয় এবং মঙ্গোলীয় দুই মহাভাষা গোষ্ঠীর এক সেতুবন্ধন। কথা হচ্ছে- ভাষাতাত্ত্বিক এত মিল-মহব্বত ও যুক্তির পরও অসমিয়া এবং চাকমা আলাদা ভাষার স্বীকৃতি পেলে চট্টগ্রামী কেন অবহেলার পাত্র হবে। কি দোষ চট্টগ্রামীর! তাই স্বভাবতই বাংলাভাষীদের প্রতি চট্টগ্রামীভাষাভাষীর প্রশ্ন; বাংলা-অসমিয়ার যত মিল তার চেয়ে বেশী অমিল থাকার পরও কেন চট্টগ্রামী স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পাবে না?
বাংলাভাষীরা অনেকেই বলেন, চট্টগ্রামীভাষার বেশীর ভাগ শব্দ সংস্কৃত ও বাংলা। এগুলো বাদ দিলে কি ওই ভাষার কিছু থাকবে। প্রথমেই শব্দ মিশেলের কারণটি ব্যাখ্যা করা যাক। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এক সময় প্রচুর বাংলা শব্দ আতœস্থ করেছে চট্টগ্রামী। এখন চট্টগ্রামের জনগন সারাদেশে নানা কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত। ফলে তাদের মাধ্যমে নানা শব্দ ঢুকছে চট্টগ্রামীতে। তবে সংস্কৃত ও বাংলাশব্দগুলো তাড়িয়ে দিলে চট্টগ্রামী থাকবে না এমন ভয়ে আতংকিত হওয়ার কোন কারণ দেখি না। বাংলা শব্দ ভান্ডারকে বাদ দিলে চট্টগ্রামীর অঙ্গহানী হবে সত্য বিলুপ্ত হবার নূন্যতম সম্ভাবনাও দেখি না। ভাষা গবেষকরা মনে করেন, যে কোন ভাষার সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের নিচে নেমে গেলে সে ভাষার মৃত্যু অনিবার্য। সেদিক থেকে চট্টগ্রামী আপতদৃষ্টিতে বিপদাপন্ন নয়। যা একটি শক্তিশালী স্বতন্ত্র ভাষার বৈশিষ্ট্য বটে। এখনও প্রায় দুই কোটি মানুষ সার্বক্ষনিক এ ভাষা চর্চা করে। উল্টো বলা যায়, বাংলা ভাষী এখনকার ডি-জুস প্রজন্মের অনেকেই পরে, করে, ধরে, ঘরে, শব্দগুলোকে উচ্চারণ করছেন পড়ে, কড়ে, ধড়ে, ঘড়ে ইত্যাদি। এতে বাংলা দ্রুত বিপদাপন্ন হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামী সে বিপদ ইতিমধ্যে কাটিয়ে ওঠেছে।
চট্টগ্রামী একটি আন্তঃপ্রতিরোধকভাষাও বটে। কারণ নিজস্ব প্রতিরক্ষার একটি গুন রয়েছে এ ভাষার। একজন বাংলাভাষী সহজে চট্টগ্রামী শুনতে, বুঝতে ও আতœস্থ করতে পারে না। প্রথমে তাকে স্পষ্ট শুনতে বেশ কয়েকবছর ব্যয় করতে হয়। তারপর বুঝতে লাগে এবং বলতে লাগে আরও কয়েকবছর। তাও বিশুদ্ধ চট্টগ্রামী উচ্চারণে সম্ভব হয় না। ফলে বর্হিভাষীকে সহজে সনাক্ত করতে যায়। এ বৈশিষ্ট্যের কথা স্বীকার করে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘চট্টগ্রামী ভাষায় ঊঁঢ়যড়হরপ পড়সনরহধঃরড়হ, উড়ঁনষরহম ংড়ঁহফ ওহঃৎঁংরাব ংড়ঁহফ (প্রবেশি দ্রুতধ্বনি) বড় মোহকারী। ...স্থানের নামে, সময়ের উল্লেখে, প্রিয়বস্তুর নির্দেশে এমনকি রেগে গেলে সাধারণ কথাতেও এই ‘বিলোপ-পন্থা’ দ্রুত কাজ করে। ফলে বাগধারায় ‘ধ্বনি’ বিচিত্র রূপে ক্রিয়া করে কিন্তু শেষ ‘ধ্বনিগুন’ ক্রমে ভাবানুসঙ্গতায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ শব্দের ধ্বনি বিশেষ ধ্বনিগুনের অধিকারী- সিলেটির মত যে কোন বাক্যের প্রথম ও শেষ শব্দের টান রাখার নিয়ম এখানে অচল, কিংবা নোয়াখালির মত কতকগুলি অব্যয় ধ্বনি সংযোগও এখানে বৃথা। কৃতঋণ শব্দের মত কিছু প্রাচীন শব্দ (এমনকি পোশাকী শব্দ) এ ভাষায় বহুল ব্যবহৃত, কিন্তু বাগধারার বিপুল স্রোতে তার স্থান এ ভাষার খেয়াল মত হয়ে থাকে। বহু সংস্কৃত ও হিন্দী শব্দ এ ভাষা ঘোট পাকিয়ে ও নানা ছদ্মরূপে এ ভাষায় অবস্থান করছে। অথচ অন্যান্য উপভাষায় মূল শব্দের আদি উচ্চারণ ঠিক থাকে, পরবর্তী উচ্চারণেই শুধু বিকৃতি ঘটে থাকে। চট্টগ্রামের ভাষা সম্ভবত এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাইরে থেকে কোন বাঙালীর পক্ষেই এই ভাষা বোঝা বা আয়ত্ত করা খুব সহজ নয়।’
এছাড়া যেখানে নিজেরই একাধিক উপভাষা ভাষা আছে সেখানে অন্যভাষার উপ বা আঞ্চলিক ভাষা হতে যাবে কেন চট্টগ্রামী। বৃহত্তর অর্থে ভাগ করলে চট্টগ্রামী- রোয়াই ও চাডি¹ানাই দুইভাবে বিভক্ত। সুè বিবেচনায়- কর্ণফুলীর উত্তরতীর থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পূর্ব ঢাল, চন্দ্রনাথের পশ্চিম ঢাল থেকে ফেনীনদী, কর্নফুলীর দণি তীর থেকে মাতামুহুরী নদী এবং মাতামুহুরী থেকে নাফনদী পর্যন্ত চারটি উপভাষা রয়েছে। চট্টগ্রামীতে সাহিত্য সৃষ্টি যে অসম্ভব নয় তার প্রমান এ ভাষার সমৃদ্ধ গীতসম্ভার। এ গীত তো বাংলাভাষাভাষীদের কাছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ছড়া, কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও মজবুত হচ্ছে চট্টগ্রামীর অবস্থান। ২০১১’র মহান একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামীভাষার প্রথম গল্পগ্রন্থ- ‘মেইট্টাল’। অবশ্যই অনেকে প্রশ্ন তোলেন- বাংলা বর্ণমালায় কেন চট্টগ্রামী চর্চা? তাদের জ্ঞাতার্থে বলি- বর্তমানে বাংলা বর্ণমালায় মণিপুরী, গারো, হাজং, মারমাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষী তরুণ সাহিত্যিকরা সেসব ভাষায় নিয়মিত লিখছেন। আবার অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করছেন। তাহলে চট্টগ্রামী কেন হবে না?
চট্টগ্রামীর সুনিশ্চিত উৎস এখনও অনাবিস্কৃত। সাহিত্যিক আবদুর রশিদ সিদ্দিকী ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত তার ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ বইয়ে বলেন, ‘উর্দূই চট্টগ্রামী ভাষার বাহন, আরবি ইহার অঙ্গপ্রত্যক্ষ, পার্শি ইহার অঙ্গরাগ এবং বাঙ্গলা ইহার নয়নাঞ্জন।’ আরবি-ফার্সি শিক্ষায় শিক্ষিত আবদুর রশিদ সিদ্দিকী সঙ্গত কারণেই চট্টগ্রামীতে অন্যভাষার হদিস করতে পারেননি। তবে ড. মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘অনুমান করা যায় যে, সিলেট ও নোয়াখালি ভাষা অপেক্ষা চট্টগ্রামের ভাষায় সংঘাত এসেছে প্রচুর। সংঘাত বলতে আমরা একটি নদী-বন্দর কেন্দ্রে ও তার পশ্চাৎ ভূমিতে ভাষা-সংযোগ (খধহমঁধমব পড়হঃধপঃ)ঘটিত পরিবর্তন ও ঋণায়ন তথা অংংরসরষধঃরড়হ, ফরংংরসরষধঃরড়হ, পড়হঃধসরহধঃরড়হ ও ধ্বনি-অভিঘাত প্রাপ্তির অন্যান্য কারণও ঘটনাকেও বুঝবো। ধ্বনি-উচ্চারণগত প্রক্রিয়ায় বাধা না দিয়ে ধ্বনিগঠনে একটা ‘বিলোপ-পন্থা’ও সম্ভবত একটা নু-ঢ়ৎড়ফঁপঃ হিসাবে এখান থেকেই জন্ম লাভ করে থাকবে। ...চট্টগ্রামের ভাষা সাধারণ বাঙালির জন্য একটি দূরবর্তী (অন্ত্য-প্রান্তিক) ভাষা। অন্যান্য উপভাষাভাষী যে কেউ একজন অপরিচিতের সামনে নিজের উপভাষার কথা বলতে সংকোচ বোধ করবেন। চট্টগ্রামের লোকদের সে ‘কমপ্লেক্স’ নেই। উপভাষাকে যে জন্য স্ল্যাং বলা হয়, এরা যেন তা কাটিয়ে উঠেছেন। ভাষা অনেকটা অমৎববসবহঃ-এর মত, ভাষার অঞ্চলগত ভাগ এজন্য প্রায় অপরিহার্য। আঞ্চলিক ভাষারই যদি লেখ্যরূপ গড়ে ওঠে (যেমন জাপান) তবে তার সমৃদ্ধি সকলকে ছাপিয়ে যায়। চট্টগ্রামের ভাষা সবাইকে ছাপিয়ে উঠতে পারে নি, তবে স্বতন্ত্র হতে পেরেছে। ধ্বনি উচ্চারণের নিয়ম, শব্দসৃষ্টি ও কৃতঋণ শব্দের ব্যবহার এবং বাক্য গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে এদের অনুসরন সাধারণ বাঙালির পক্ষে আজ দুঃসাধ্য। চট্টগ্রামের ভাষা মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সুবিধা পেয়েছে ঢের অথচ আপন নিয়মকে প্রকাশ করতে গিয়ে হাতের উপাদানগুলিকেই ব্যবহার করেছে বেশি।’ চট্টগ্রামীর স্বাতন্ত্রিক অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘শিষ্ট ভাষার বিকল্পে সৃষ্ট এই ‘নব ভাষা’ ক্রমে ক্রমে তার ভঙ্গিকে পরীক্ষামুলক অবস্থা থেকে অনেকদূরে নিয়ে এসেছে। চীন-কোরিয়া থেকে সরে যেতে জাপানী ভাষা অথবা জার্মান থেকে সরে যেতে ইংরাজি ভাষারও বোধহয় এমনি সুবিধা ছিল। চট্টগ্রামের ভাষার তুলনায় আমাদের অন্যান্য উপভাষায় অর্জিত রূপের প্রতিষ্ঠার সাধনা অল্প।’ সবচেয়ে স্পষ্ট মতামত দিয়েছেন ভাষাবিদ শিশির ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রামী উপভাষা ও মান বাংলার মধ্যে ব্যাকরণগত এবং শব্দকোষগত মিল থাকলেও উভয় উপভাষার উৎপত্তি চর্যাপদের যুগ বা পরবর্তি কোন যুগে প্রচলিত আলাদা দু’টি উপভাষা থেকে। পুরাকালের সেই দু’টি উপভাষার মধ্যে শব্দকোষগত ও ব্যাকরণগত মিলের কারণেই আজকের মান বাংলা আর চট্টগ্রামীর মিল।’ নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, ভাষাগত পার্থক্য জাতি সত্ত্বাতে বৈচিত্র আনে। বক্তব্যটিকে উল্টে দিয়ে যদি বলি, জাতি সত্ত্বার বৈচিত্র ভাষায় পার্থক্য গড়ে। তবে কি ভুল হবে? বাংলার সঙ্গে চট্টগ্রামের জীবনাচরণগত পার্থক্য বা বৈচিত্র যেহেতু পরিস্কার, সেহেতু ভাষাগত পার্থক্যও সুনিশ্চিত। চট্টগ্রামীর স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার যেমন বাংলাভাষাভাষীদের গোয়ার্তুমী; তেমনি উপ বা আঞ্চলিকতার তকমা নিয়ে নিরবতা পালন হবে চট্টগ্রামীভাষাভাষীর কুপমুণ্ডুকতা। আসুন কূপ থেকে বেরিয়ে, ভাষার সমূদ্রে দেই দীঘল সাঁতার।
লেখক: তরুণ কবি ও সাংবাদিক।
kafi_bd80@yahoo.com


৪৭০ বার পঠিত
১৮টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুনির মুখে ইতিহাস শিক্ষা ও অধঃপতিত মানস

লিখেছেন sabbir2cool, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৯:৩৪


বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর শরিফুল হক ডালিমকে প্রকাশ্যে এনেছেন আলোচিত ফেসবুক-সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। গত রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে ইলিয়াস ‘বিশেষ লাইভে যুক্ত আছেন বীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবার আসিবো ফিরে.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১০:৩৪

আবার আসিবো ফিরে.....

যেখানে গেলে অনেকদূর অব্দি মাঠ দেখা যায়, কচি রোদের তাপে পুড়িয়ে নেওয়া যায় পিঠ। রাতের আলো আঁধারিতে সমস্ত কোলাহল সরিয়ে রেখে খোলা যায়গায় দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করলেই পোকাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাজ উদ্দিন-সৈয়দ নজরুলরা যুদ্ধকালেই দেশ লিখে দিয়েছিলো ভারতকে

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:১৭

Sharif Osman Bin Hadi (ফেইজবুক পোষ্ট থেকে)

এই সেই ৭ দফা চুক্তি, যার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গোলাম বানানো হয়েছিলো।
তাজ উদ্দিন-সৈয়দ নজরুলরা যুদ্ধকালেই দেশ লিখে দিয়েছিলো ভারতকে। নুরুল কাদিরের লেখা 'দুশো... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনা কি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন?

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫০


আমার মনে এখন প্রায়ই যে প্রশ্নটা আসে সেটা হচ্ছে শেখ হাসিনা কি আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদটা গ্রহন করবেন কিংবা করতে পারবেন?

আপনি মানেন কিংবা না মানেন আওয়ামীলীগ আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা এখন আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাস পড়তে চাইনা‼️(জোছনা ও জননী/হুমায়ুন আহমেদ)

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:৪৫


মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেইশ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেমিস্ট্রিতে অনার্স থিয়োরি পরীক্ষা দিয়েছি, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা। সুন্দর সময় কাটছে। আর মাত্র এক বৎসর—... ...বাকিটুকু পড়ুন

×