মূল লেখাটি
তাঁর নাম পল রোবসন—পিট সীগার
সেটা ১৯৩০ সালের কথা : বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী উত্থানের প্রতিবাদে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ২০,০০০ লোক জমায়েত হয়েছে। উপরের সারিতে সমবেত তরুণদের মধ্যে আমিও ছিলাম। সেই বিকালে অনেক বক্তৃতা হলো, প্রধানত শ্বেতাঙ্গরাই বক্তৃতা করলেন। অনেকে কালো মানুষ মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ‘শুভ সন্ধ্যা, বন্ধুগণ’ সেই কণ্ঠ এত নীচু, গম্ভীর এবং অনুনাদী ছিল যে মনে হচ্ছিল তা যেন সমগ্র বিশ্বের মানবতাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। পুরো সমাবেশ একসাথে ফেটে পড়ল উষ্ণতা ও ভালবাসা নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতে। সেই মানুষটি আমাদেরকে- আমাদের সকলকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন র্যালি ও কনসার্টে রোবসন-কে কথা বলতে ও গাইতে শুনে, একই ব্যক্তির মধ্যে অসাধারণ শক্তি, গভীর মমতা ও অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণ দেখে আমি বার বার মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। একজন মানুষের মধ্যে এসব গুণের একসাথে বিরাজ করতে চমৎকারভাবে। আমার যৌবনের নায়ক ছিলেন রোবসন। আরো লক্ষ লক্ষ তরুণ শ্বেতাঙ্গও নিশ্চয় আমার মতই ভাবত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমি যখন সেনাবাহিনীতে ছিলাম তখন আমার স্ত্রী নিউইয়র্ক-এ রোবসন- এর জন্মদিনের বিশাল পার্টির বর্ণনা লিখে পাঠিয়েছিল আমাকে। স্তুতি ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার পরে তিনি গান গেয়েছিলেন এবং অনেকেই চাইছিল যে তিনি যেন সারা রাত গান করেন। অনেকেই তার ব্যস্ততার কথা এবং সপ্তাহে ছ’বার ওথেলো-তে অভিনয়ের কথা জানত। তাঁদের ভৎসর্নার সাথে গলা মিলিয়ে হাজার হাজার লোক বলে উঠল, ‘গলার যতœ নাও, পল।’ যুদ্ধ শেষে তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়। কনসার্ট শেষে আমি লাইনে অপেক্ষা করে তাঁর ড্রেসিং রুমের দরজায় টোকা দিলাম তাঁর সাথে আলাপের মধ্যে জানতে চাইলাম যে, তিনি আমাদের নতুন সংগঠন পিপলস সংস-এর পৃষ্ঠপোষক হবেন কিনা। ‘কেন না, অবশ্যই হব, বলে বিরাট হাসি দিলেন। তাঁর অন্যান্য ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সময় করে আমাদেরকে সহায়তা ও পরামর্শ দিতেন। ১৯৪৮ সালে হেনরি ওয়ালেস-এর নির্বাচনী প্রচারণার সময় বহুবার তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। সে সময় লক্ষ্য করেছি তাঁর মধ্যে শারীরিক শক্তি ও গভীর মমতাবোধের মিশ্রণ কিভাবে অসাধারণ সাহসিকতা ও সততা দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে কট্টর ডানপন্থীরা তাঁকে পীকস্কীলে হত্যা করতে চেয়েছিল। শিল্পী হিসাবে সে সময় আমি তুলনামূলকভাবে স্বল্প পরিচিতি হলেও অনুষ্ঠানেও প্রথমার্ধে কয়েকটি গান গাইতে আমন্ত্রিত হয়ে সম্মানিত বোধ করেছিলাম। কনসার্ট শেষে হাজার হাজার শ্রোতা তাদের গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। প্রবেশ পথে দাঁড়ান পুলিশ (গোপন কে.কে.কে.-র সাথে যোগসাজশকারী) সমস্ত গাড়িকে ডান দিকে মোড় নিতে বলেল। ডান দিকের সেই রাস্তায় কোমন সমান উঁচু পাথরের টিবি নিয়ে অপেক্ষারত গুণ্ডারা প্রত্যেকটা গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া শুরু করল। সেদিন না হলেও দশ হাজার গাড়ির কাঁচ ভেঙেছিল। বাড়ি ফিরে আমি ও আমার স্ত্রী বাচ্চাদের মাথা থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করেছিলাম। কাঁচ ভেঙে আসা দুটো পাথর পরে আমরা গাড়ির মধ্যে পেয়েছিলাম। সেই পাথর দুটো আমার বাড়ির ফায়ার প্লেসে সিমেন্ট দিয়ে আটকে থুয়েছি। আমি নিশ্চিত যে, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে আমেরিকার শাসকরা রোবসন-কে জেলে পাঠাবার দুঃসাহন দেখায়নি। কিন্তু পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকেই সব কনসার্ট হলেও দরজা তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি ‘মানী-গুণী’ ব্যক্তি ও সংগঠন নিজেদেরকে লুকাতে ব্যস্ত ছিল সে-সময়। সে অবস্থাকে মার্টিন লুথার কিং পরে খুব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘মন্দ লোকদের বর্বরতা নয় বরং ভাল মানুষদের চুপ করে থাকাটাই হচ্ছে চরম দুঃখের ‘গত বছর আমরা গান গাইতে রোবসন-কে এখানে আনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেন্দ্রীয় অফিস আমাদেরকে বলেছে যে তা করলে তারা আমাদের চ্যাপ্টারকে বাতিল করে দেবে’ যদি, যদি, যদি। আমরা যদি তাঁর জন্য আরো দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতাম, আমেরিকানরা যদি ঠাণ্ডাযুদ্ধের মিথ্যাগুলোকে আরো দ্রুত বুঝতে পারত, তাঁর স্বাস্থ্য যদি আরো কুড়ি বছর টিকে থাকত। সবই নিরর্থক এখন। আমরা শুধু জানি যে, ঠাণ্ডা যুদ্ধে আমেরিকার অপরাধগুলোর অন্যতম হচ্ছে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ করা, যাতে লক্ষ লক্ষ শ্রোতা তার গান ও রাজনৈতিক বিশ্বাস শুনতে না পায়। তবে, আমার কাছে পল রোবসন চিরদিন বেঁচে থাকবেন। তাঁর শক্তি আমাদেরকে আরো দৃঢ় করেছে, তাঁর শৈল্পিকসত্তা আমাদেরকে উৎসাহিত করেছে আরো ভাল শিল্পী হতে। অবসান ঘটাবেন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এই বইটি আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে, জেকব- এর সিঁড়ির আরো একটি ধাপ উত্তরণে বিংশ শতাব্দীর এক সংবেধনশীল মহামানব আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন- তাঁর নাম পল রোবসন। [বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান গণ ও লোকসঙ্গীত শিল্পী পিট সীগার-এর এই ভাষণটি পল রোবসন : দি গ্রেট ফোররানার বই থেকে অনুবাদ করেছেন ওমর তারেক চৌধুরী।] পল রোবসন- এর গাওয়া এবং নতুন তাৎপর্য দানের জন্য পরিবর্তনকৃত বিখ্যাত নিগ্রো স্পিরিচুয়্যাল ‘উই আর ক্লাইমিং জেকবস ল্যাডার’ গানের কথা বলেছেন পিট সীগার।- অনুবাদক
[সংস্কৃতি থেকে দ্রোহ ছোট কাগজে প্রকাশিত ]