চাপা ১: বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে রপ্তানী বাড়ে, আমদানী কমে এবং এর মাধ্যমে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা হয়।
খন্ডন: প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক বিনিয়োগ কোন একটি দূর্বল অর্থনীতির দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তোলে। কিভাবে ? আমদানী করা যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল, নকশা, প্রকৌশল-জ্ঞান ইত্যাদির খরচ উত্পাদী পণ্যের রপ্তানীর ফলে প্রাপ্ত আয়ের চেয়ে বেশি দেখানো হয়। ফলে একদিকে আমদানি খরচ বাবদ বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা সরাসরি বিদেশে পাচার করা হয় অন্যদিকে লোকসান দেখানোর মাধ্যমে বাঁচা যায় ট্যাক্সের হাত থেকেও।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উত্পাদিত পণ্যটিকে অন্যকোন দেশে অবস্থিত তাদেরই কোন শাখা/সহযোগি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে। আর এই আন্তঃকোম্পানি লেনদেনের মাধ্যমে রপ্তানী পণ্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম দেখানো হয়, ফলে সংশ্লিষ্ট দেশটি বৈদেশিক মুদ্রা এবং ট্যাক্স বাবদ বিপুল আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এই পদ্ধতিটি করপোরেট দুনিয়ায় 'ত্রিভুজ বাণিজ্য' হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। কম মূল্যেও এই রপ্তানিটি করা হয় এমন এলাকায় যেখানে ট্যাক্সের হার কম বা একেবারে নেই, যেমন সিঙ্গাপুর বা বারমুডা। তারপর সেই ট্যাক্সস্বর্গ থেকে পণ্যটিকে প্রকৃত বাজারমূল্যে তার চুড়ান্ত গন্তব্যে রপ্তানি করা হয়।
আন্তঃকোম্পানি লেনদেনের ক্ষেত্রে ত্রিভুজ বাণিজ্য করা হয় পণ্য উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির বেলায়ও। তবে এ ক্ষেত্রে পণ্যের অব-মূল্যায়নের পরিবর্তে করা অতি-মূল্যায়ন। উদ্দেশ্য কিন্তু একই- ট্যাক্স ফাঁকি। এভাবে বিনিয়োগ যত বাড়তে থাকে তার সাথে বাড়তে থাকে পাচার হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। ২০০৫ সালের মে মাসে ভেনিজুয়ালার সরকার নব্বই দশকের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বৈদেশিক কোম্পানিগুলোর ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ট্যাক্স-ফাঁকির এক হিসাব প্রকাশ করে। রাশিয়ার পুরো তেল এবং গ্যাস সেকটরটিকেই হজম করে ফেলেছে বিদেশী বিনিয়োগকারী এবং তাদের স্থানীয় দালাল চক্র। এরকম দুটি চক্রের হোতা প্লাটোন লেবেডেফ ও মিখাইল খদরকভস্কি কে ২৯ বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স ফাঁকির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
চাপা ২: বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি দেশের রপ্তানী খাতকে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে এবং স্থানীয় বাজারেরও বিকাশ ঘটায়।
খন্ডন: প্রকৃতচিত্র হলো বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমূল্যে লোভনীয় খনিজ সম্পদ কেনে এবং অতি অল্প মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে বা কোন মূল্য সংযোজন ছাড়াই বিদেশে রপ্তানী করে। এভাবে কোন মূল্যসংযোজন ছাড়াই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশে পাচার করার মধ্যেই রপ্তানী খাতে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার সকল মহিমা নিহিত!
আর স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিভিন্ন সেবাখাত যেমন: টেলিকমিউনিকেশন ইত্যাদি পুঁজিঘন খাতের ব্যাপক বিকাশের মাধ্যমে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা স্রেফ সামান্য ট্যাক্সের বিনিময়ে বিনিয়োগকারি বহুজাতিক কোম্পানিটি তুলে নিয়ে যায়। আর পানি, বিদ্যুত, যাতায়াত ও পরিবহন ইত্যাদি খাতে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার ফলে স্থানীয় বাজারের সংকোচন ঘটে যার ফলাফল স্বরূপ একদিকে যেমন লোকবল ছাটাই করা হয় অন্যদিকে তেমনি এই সেবাগুলো ক্রমশঃ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরেও চলে যায়। বলিভিয়ায় নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল খাতের বেসরকারিকরণ এইসব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলাফল স্বরূপ বিনিয়োগকারি বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুটে নিলেও স্থানীয় অর্থনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া হয় ভয়ংকর। গ্যাস ও পেট্রলিয়াম-জাত পণ্যেও প্লান্টগুলোতে হাজার হাজার শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হয়। অন্যদিকে স্থানীয় নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের আওতার বাইরে চলে যায় এসব পণ্য।
চাপা ৩: বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়, শ্রমিকের মজুরী বাড়ে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়।
খন্ডনঃ যে কোন বিনিয়োগের ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি অনেকগুলো সূচকের উপর নির্ভরশীল: বিনিয়োগের ধরণটি কি শ্রমঘন না পুঁজিঘন, সংশ্লিষ্ট খাতটিতে বিদেশী বিনিয়োগের ফলে দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো এর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকবে কি না, যদি না টেকে তবে সে ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হারানো শ্রমিকের তুলনামূলক সংখ্যা ইত্যাদি।
সাধারণভাবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিকের উচ্চ মজুরীর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তৈরী হওয়া পুঁজিঘন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ও চালনার জন্য তুলনায় অনেক কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ফলে বিনিয়োগের সার্বিক প্রতিক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায় ঋণাত্মক।
আর মজুরিরি উচ্চহারের ব্যাপারে বলা যায় তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত একটি দেশের অনুন্নত একটি কাঠামো থাকা সত্বেও সেসব দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার গুটিকয়েক কারণের মাঝে একটি হলো সস্তা-শ্রম। যে বিনিয়োগকারী সস্তা শ্রমের জন্য সাত-সমুদ্দর পাড়ি দিয়ে অন্য একটি দেশে আসে সেই বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের সুফল হিসেবে মজুরীর উচ্চারকে উপস্থাপন করা স্রেফ হাস্যকর। এ প্রসঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে টাটার প্রস্তাবিত মোটর গাড়ি কারখানায় যে বিশেস পদ্ধতিতে গাড়ি তৈরী করা হবে সেই 'ম্যানটেক' পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পেন্টাগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালে সালে 'ম্যানটেক' নামক প্রকল্পে উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে বাড়তি মুনাফার উদ্দেশ্য কী, তা টাটাদের সিঙ্গুর মোটরগাড়ি প্রকল্পের পটভূমিতে একটু দেখে নেয়া যেতে পারে।
টাটার প্রস্তাবিত মোটর গাড়ি কারখানার মূল কারখানাটি হবে স্রেফ একটি যন্ত্রাংশ জোড়া দেয়ার কারখানা। কোন যন্ত্রাংশই টাটা কর্তৃপক্ষ উত্পাদন করবে না। সেগুলো উত্পাদন করবে বিভিন্ন ছোট ছোট ভেন্ডর কোম্পানী। প্রচলিত শিল্প আইন অনুসারে সব যন্ত্রাংশ যদি টাটার মূল কারখানায় তৈরী হয় তবে এর সঙ্গে জড়িত সব শ্রমিককেই (যার সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১১ হাজার হওয়ার কথা) মোটর গাড়ি শিল্পের প্রচলিত মজুরি দিতে হতো এবং অন্য সংগঠিত ক্ষেত্রের মত তাদেরও কিছু কিছু অধিকারও সুরক্ষিত থাকতো। ম্যানটেক ব্যবস্থায় সেদেশের সরকারের বক্তব্য ঠিক হলে ৮০০ জন হবেন মোটর গাড়ি শিল্পের শ্রমিক, বাকি প্রায় ১০০০০ জন হবেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক যাদের মজুরি, কাজের সময়, চাকুরির নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকবে না। লেদ মেশিনে যে শ্রমিক কাজ করবেন, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী তাঁর দৈনিক মজুরি হবে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। মটর গাড়ি শিল্পের মজুরি ব্যবস্থা অনুযায়ী দু থেকে আড়াই গুন পাওয়ার কথা। শুধু ভারতের টাটা কেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিদেশী বিনিয়োগকারী বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলোও ঠিক এই পদ্ধতিতে শ্রম শোষণ করে বিপুল মুনাফা কামিয়ে নিচ্ছে।
বিদেশী বিনিয়োগের ফলে সৃষ্ট কর্মসংস্থান বিষয়ে জাতিসংঘ একটি গবেষণা চালায়। রিপোর্টটির কিছু অংশ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে:
"বিদেশী ফার্ম সমযোগ্যতার শ্রমিককে স্থানীয় ফার্মেরও চেয়ে বেশী মজুরী দিতে পারে। এফডিআই যেহেতু দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করে সেহেতু এর ফলে দরিদ্র অদক্ষ শ্রমিকের কোন উপকার হয় না বরং দক্ষ/অদক্ষ শ্রমিকের শ্রম-পার্থক্য বেড়ে যায়............।"
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে:
"বৈদেশিক ফার্ম স্থানীয় ফার্মের চেয়ে বড় হয় এবং ফলে এটা ধরে নেয়া স্বাভাবিক যে নতুন নতুন ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ স্থানীয় বিনিয়োগের চেয়ে অধিক কর্মসংস্থান করবে। কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগ ছুটতে থাকে স্থানীয় শিল্পগুলোর একীভবন ও আত্মীকরণের পেছনে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়বেই একথা বলা যায় না। যদি বিদেশী কোম্পানীগুলো অধিকতর পুঁজিঘন হয় তবে শিল্পখাতে কর্মসংস্থান কমে যাবে(যদিও কিছু শ্রমিকের আয় বাড়তে পারে!)। যদি সেই কোম্পানী স্থানীয় কোম্পানীর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও কর্মসংস্থান কমে যাবে.............।"
চাপা ৪: বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে গ্রহীতা দেশটি প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত হতে পারে। বৈদেশিক বিনিয়োগ না হলে একটি অনুন্নত দেশের পক্ষে যা অসম্ভব।
খন্ডনঃ বাস্তবে "প্রযুক্তি স্থানান্তরের" মানে হলো পুঁজিঘন জটিল যন্ত্রপাতির স্রেফ ব্যবহারের কলাকৌশল রপ্তানী। আর কোন একটি প্রযুক্তি গুটিকয়েক শ্রমিক স্রেফ ব্যবহার করা শিখলেই সে দেশ প্রযুক্তিতে উন্নত হয় না। এর প্রয়োজন দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজস্ব গবেষণাকে শক্তিশালী করা। বহুজাতিক কোম্পানী কেবল তার মুনাফার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রপ্তানী করে, সেসব যন্ত্রপাতি চালনা ও মেরামতের জন্য বিদেশী পরামর্শ নিয়োগ করে কিন্তু কখনই তার গবেষণাগারটিকে স্থানীয় পর্যায়ে সম্প্রসারিত করে না। যে কারণে গ্রহীতা দেশটি সেই প্রযুক্তির জন্য বিভিন্নভাবে বিনিয়োগকারী কোম্পানী এবং তার দেশের উপর আরো বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে। ফলে, বিনিয়োগের ফলে প্রযুক্তি স্থানান্তর বলতে যা ঘটে তা হলো বিনিয়োগকারী কোম্পানীর সহযোগী যন্ত্র উত্পাদনকারী কোম্পানীর আরেকটি নতুন বাজার সৃষ্টি হয়।
আবার অনুন্নত অবকাঠামো থাকা সত্বেও যে কয়টি কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি অনুন্নত দেশে আসে তার একটি কারণ ইতিপূর্বে বলা হয়েছে- শ্রমের নিম্ন মূল্য। আরেকটি বড় কারণ হলো বিশ্বজুড়ে ক্রমশ গড়ে উঠা পরিবেশ সচেতনতা। বিনিয়োগকারী কোম্পানী যখন নিজ দেশে ক্রমাগত পরিবেশের হুমকি স্বরূপ প্রযুক্তিটি ব্যবহারে বাঁধা পেতে থাকে এবং ফলত: কারখানার বর্জশোধনে উত্পাদন ব্যয় ক্রমাগত বাড়তে থাকে তখন সেই কোম্পানীটি বৈদেশিক বিনিয়োগের মহান কর্মটি সম্পন্ন করে।
এসকল কারণে যতদিন যাচ্ছে ততই বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ., বহুজাতিক কোম্পানী ও তাদের স্থানীয় দালালদের করা চাপাবাজি জনগণের কাছে পরিস্কার হয়ে আসছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে জনগণ বৈদেশিক বিনিয়োগের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন, সস্তা-শ্রম শোষণ, আর জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি সাধনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে একের পর যে গণজাগরণ ঘটে চলেছে তার অন্যতম অনুঘটক হলো বিনিয়োগের নামে এই সম্পদ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভুত ক্ষোভ। যেহেতু জনগণ উপলব্ধি করছে যে এই বিনিয়োগের নামে সম্পদ লুন্ঠন অনুমোদনের সিদ্ধান্তটি একান্তই রাজনৈতিক এবং এর সাথে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্কটি যুক্ত, তাই সেই গণ আন্দোলন গুলো স্বাভাবিকভাবে চালিত হচ্ছে চুড়ান্ত অর্থে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল এবং তার মাধ্যমে একটি সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যার মূলনীতি মুনাফার বদলে হবে সাম্য ও ন্যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১১:৫২