৪
ইংরেজি 'ডিসেপসন' শব্দের অর্থ ধোঁকা, প্রতারনা অথবা ছলনা। বাইজান্টাইন রোমানদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুখের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ ইয়ারমুখ প্রান্তরে পশ্চিম দিকে মুখ করে পজিশন নিয়েছিলেন। এইটারে বলে 'পজিশনাল এডভান্টেজ' বা অবস্থানগত সুবিধা। এর ফলে সকাল থেকে দুপুর অবধি প্রতিপক্ষ বাইজান্টাইনদের চোখে সুর্য পড়ত, ফলে দূর থেকে তারা মুসলিম আর্মির সঠিক সংখ্যা ঠাহর করতে পারতনা। উপরন্তু খলিফা ওমর নির্দেশ দিলেন যেন প্রতিদিন সকালের দিকে মুসলিম সেনারা ছোট ছোট দলে কিন্তু ঢাক ঢোল পিটিয়ে খালিদের আর্মিতে যোগ দেয়। ফলে বাইজান্টাইনরা ভাবতে লাগল যে প্রতিদিনই মুসলিম শিবিরে না জানি কতশত নতুন সেনা যোগ দিচ্ছে। ব্যাপারটা সামান্য হলেও এর ইম্প্যাক্ট অনেক বড়, কেননা বাইজান্টাইন ভাবনা বাইজান্টাইনদেরই ক্রমশ ফ্রাস্ট্রেটেড করে তুলছিল। এই জাতীয় ট্রিক কেই বলে ডিসেপসন। আর সানজু বলেন, "সব যুদ্ধই ডিসেপসন নির্ভর।"
তাই যখন আপনি শত্রুকে হরিয়ে দিতে প্রস্তুত, ভান করুন যেন যুদ্ধ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তেমনি এমন কিছু করুন যেন শত্রু তটস্থ থাকে এই ভেবে যে আপনি বোধহয় আশেপাশেই ঘাপটি মেরে পড়ে আছেন, অথচ বাস্তবে আপনি তখনো বেশ দুরেই আছেন; আর যখন শত্রুর ওপর হামলে পরবেন তার আগমুহুর্ত পর্যন্ত যেন শত্রু টের না পায় যে আপনি এতটা কাছে চলে এসেছেন। অথবা শত্রুকে প্রলুব্ধ করুন আপনার ফাঁদে পা দিতে, তারপর ধ্বংস করুন।
শত্রু যখন আক্রমনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, আপনিও প্রস্তুত হন। শত্রুর শক্তি অথবা বিশেষ সামর্থ্যকে চিনহিত করুন এবং পারতপক্ষে তার স্ট্রেন্থ কে এড়িয়ে চলুন। তার জেনারেলদের রাগিয়ে দিন আর বিভ্রান্ত রাখুন। ইরিটেডেড আর কনফিউজড মানুষ ভুল করে বেশি।
কিছু রাজা-বাদশা-প্রসিডেন্ট আছেন যারা গায়ে পরে আশেপাশের শান্তিপ্রিয় দেশের সাথে লাগার ধান্দায় থাকেন। ইস্টার্ন হু এর রাজা ছিলেন তেমনই একজন। তো তিনি একদিন প্রতিবেশি দেশ শিংনু এর রাজা মোতুং এর কাছে এক হাযার অশ্ব দাবি করে বসল। দাবি শুনে মোতুং এর সভাসদেরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালো। কিন্তু রাজা মোতুং বললেন ঘোড়ার চে প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বেশি জরুরী। তাই পাঠানো হল একহাজার ঘোড়া।
কিছুদিন পর ইস্টার্ন হু এর রাজা ফের আব্দার করল। এইবার তার একজন রাজকুমারী চাই। সভাসদেরা রাগে ফেটে পড়ল, যুদ্ধ ছাড়া কোন ছাড় নাই এইবার। কিন্তু রাজা মোতুং বললেন এক রাজকুমারীর চে প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বেশি জরুরী। তাই ঘটা করে এক রাজকুমারীর বিয়ে দেয়া হল।
কিছুদিন পর ফের আরেক বায়না। এইবার একহাজার লি জমি দিতে হবে। রাজা মতুং সভাসদদের মতামত চাইলেন। সভাসদদের কেউ বলল 'কক্ষনো না' আবার কেউ বলল 'কিছু জমির চে প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বেশি জরুরী।' আর যায় কই, রাজা মোতুং রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, "মাটি হল রাস্ট্রের ভিত্তি, এক কনা মাটিছাড়ার কথাও যে ভেবেছে, তাদের সব কয়টার কল্লা কাটো। আর এক্ষুনি প্রস্তুত হও ইস্টার্ন হু আক্রমনের জন্য। আমি রওনা দেবার পর যারেই আমার পেছনে পাওয়া যাবে, তাদেরো কল্লা যাবে।" ইস্টার্ন হু এই রিএকশনের জন্য রেডি ছিলনা। ফলে রাজা মতুং সহজেই তাদের পরাস্ত করেছিল। আর সানজু বললেন, "মোক্ষম সময়ের আগ পর্যন্ত দুর্বল সাজার ভান কর আর প্রতিপক্ষকে উস্কে দিতে থাক!"
৫
শত্রুকে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখতে হয়, সে যখন দু দন্ড শান্তি খোজে, তখনই তাকে জ্বালাতে হবে। যখন সে এক থাকার চেস্টা করবে, আপনি তখন ফন্দি খুজবেন কিভাবে তারে ডিভাইড করা যায়। এক্ষেত্রে শত্রুর নিজেদের ভেতর কোন্দল লাগায়া দেন, তার মিত্র দের সাথে প্যাচ লাগান, মোটকথা তারে দৌড়ের উপর রাখেন।
গালফ ওয়ারে সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের পর কুয়েতের মাটিতে খুব শক্তিশালী ডিফেন্স নিয়েছিল। শোয়ার্জকফের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীও সেই ডিফেন্স বরাবর সৌদি আরবের মাটিতে অবস্থান নিল। তারপর এমন একটা অবস্থা তৈরি করল যে সাদ্দাম বিশ্বাস করল যে এটাক যদি হয়, তাহলে তা হবে পার্সিয়ান গালফ দিয়ে। তাই সে অই এম্ফিবিয়াস এসল্ট থামাইতে আরো এফোর্ট দিল। কিন্তু ধুর্ত শোয়ার্জকফ কিন্তু সম্পুর্ন উলটা দিক দিয়ে, কুয়েত থেকেও অনেক পশ্চিমে ইরাকের ভেতর দিয়ে ঢুকে আক্রমন করে সাদ্দামকে চমকে দিয়েছিল। এই যুদ্ধে রিপাব্লিকান গার্ড সহ সাদ্দাম হোসেন ১০০ ঘন্টার ভেতর পরাস্ত হন। এই ব্যাপারে সানজু আগেই বলেছিলেন, "শত্রু প্রস্তুত হবার আগেই আক্রমন কর আর আক্রমন কর সেই দিক দিয়ে যেদিক দিয়ে শত্রু কস্মিকালেও আক্রান্ত হবে বলে ভাবেনি।"
এসবই একজন স্ট্রেটেজিস্টের যুদ্ধজয়ের চাবিকাঠি। যদিও যুদ্ধ একবার শুরু হয়ে গেলে বদলে যাওয়া পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন কর্মপন্থা ঠিক করতে হয়। তারপরও যুদ্ধ শুরুর আগেই পরিকল্পিত হিসেব নিকেশ আপনাকে বাতলে দেবে যুদ্ধ জেতার সম্ভাবনা কতখানি। সানজু বলেন, "যে যত বেশি হিসেব কষে পরিকল্পনা করে সে তত বেশি যুদ্ধ জেতে।"
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৪৭