প্রথমে একটু পরিচিত হওয়া যাক যার হাত দিয়ে এই টেনিদার সৃষ্টি। টেনিদার স্রষ্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর আসল নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘নারায়ণ’ তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম। তিনি ১৯১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের বরিশালের বাসুদেবপুরের নলচিরায় জন্মগ্রহন করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষটি ডিস্টিংশনসহ ১৯৩৮ সালে বি. এ এবং ১৯৪১ সালে কৃতিত্বের সাথে এম.এ পাশ করেন।
টেনিদা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর এক অমর সৃষ্টি। সত্যজিৎ রায়ের যেমন ‘প্রফেসর শংকু’, ‘ফেলুদা’ বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের যেমন ‘ঘনাদা’ তেমনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টেনিদা’ এক অনন্য স্বকীয় চরিত্র। ছোটদের জন্যে তাঁর সমস্ত রচনা কিশোর সাহিত্য নামক বইতেও পাওয়া যায় কিন্তু টেনিদা এদের মাঝে উজ্জ্বলতম। মূলত কিশোরসাহিত্য হলেও যে কোন বয়সের মানুষ যে কোন সময়ে টেনিদা পড়ে নির্মল আনন্দ পাবে তা হলফ করেই বলা যায়। । কথিত আছে, এই টেনিদা ছিলেন আসলে লেখকের বাড়িওয়ালা যার সাথে একটি খুব সহজ এবং ভাল সম্পর্ক ছিল লেখকের। আর তিনি এই বাড়িওয়ালার নাম দিয়েই কাল্পনিক এক চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন যা পরবর্তীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কিশোর-কিশোরীদের নির্মল আনন্দ বিলিয়েছে। তিনি এমন এক অসাধারণ মেধার অধিকারী যিনি শুধু এমন একটি চরিত্রই সৃষ্টি করেননি তার সাথে আরও কিছু সহযোগী চরিত্রের মাধ্যমে তৈরি করেছেন অনেকগুলো চমকপ্রদ উপন্যাস এবং গল্প । সত্যিই অতুলনীয়!
টেনিদা সমগ্র আসলে টেনিদা সংক্রান্ত সকল গল্প-উপন্যাসের সংকলন। বইয়ের প্রধান টেনি শর্মা যার আসল নাম ভজহরি মুখার্জি। টেনিদা মূলত তিন কিশোরের লীডার। গল্প এবং উপন্যাসগুলোর বর্ণনাদাতার নাম প্যালার মতে টেনিদার নাক হল মৈনাক পর্বতের মত,বুকের ছাতি পুরো ৩৬ ইঞ্চি এবং গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন। তবে সাত বারের চেষ্টায়ও মেট্রিক পাশ করতে পারেনি। একটু চালবাজ, প্রচুর খেতে পারে এবং সে খাওয়া অবশ্যই হয় বেশিরভাগ প্যালা অথবা ক্যবলার পকেট কেটে! যত চালবাজই হোক বিপদ সামনে আসলে সবার আগে সেই সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়।
প্যালারাম যে নিজেও এই উপন্যাস,গল্পের একজন চরিত্র। পড়াশোনায় তাঁর অবস্থান টেনিদার ঠিক পরেই! তার ভাষায় সে সারাবছর পালাজ্বরে ভোগে এবং শিঙ্গি মাছের ঝোল খায়।
বাকি দুজনের নাম হাবুল সেন আর ক্যাবলা। হাবুল সেন ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলে আর ক্যাবলা বাকি তিনজনের চাইতে সবচেয়ে মেধাবী আর বুদ্ধিমান।
এই চারমূর্তি পটলডাঙ্গায় থাকে আর চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আড্ডা মারে। এই চাটুজ্যেদের রোয়াকই মূলত এর চারমূর্তির মিলনস্থল, আনঅফিসিয়াল অফিস !
পাঁচটি উপন্যাসের বেশিরভাগই রহস্য-রোমাঞ্চ নির্ভর। এর সাথে রয়েছে টেনিদা সহ সবার চিরাচরিত হাস্যরস। গল্গগুলোও তাই। এই হাস্যরসই মূলত টেনিদা কে অন্য সব চরিত্র থেকে কেবল আলাদাই করেনি, করে তুলেছে কিংবদন্তিতুল্য। টেনিদার মুখের কথা অনেকটা প্রবচনের পর্যায়ে চলে গেছে। যেমনঃ ‘এক চড়ে তোর কান কানপুরে পাঠিয়ে দেব! (সময় এবং এলাকা ভেদে এই কান কত জায়গায় যে ঘুরেছে তার ইয়ত্তা নেই)’, ‘ব্যাপারটা মনে হচ্ছে পুঁদিচ্চেরি (মানে ব্যাপারটা সাংঘাতিক)’ এমনতর আরও কিছু।
সাথে হাবুল সেনের ঢাকাইয়া ভাষা এ উপন্যাস এবং গল্পগুলোকে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। এর সাথে ক্যাবলার উপস্থিত বুদ্ধি, মেধার জুড়ি মেলা ভার। প্যালার প্রাণবন্ত ধারাভাষ্য পড়ে না হেসে থাকা পৃথিবীর দুরুহতম কাজের একটি হবার কথা !
এই চারমূর্তি কে নিয়ে রচিত হয়েছে ৫টি উপন্যাস, ৩২ টি গল্প এবং ১টি নাটিকা যা এ সংকলনে স্থান পেয়েছে। বলাই বাহুল্য এ বইটি নির্মল আনন্দের একটি আধার। রচনাগুলো সবগুলোই রোমাঞ্চ এবং হাস্যরসে ভরপুর। যে কোন কাজ বা অকাজ সফলভাবে করার পর টেনিদার সোল্লাসে সেই চিৎকার, “ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস” আর বাকি তিনজনের গলা মেলানো “ইয়াক-ইয়াক” যারা না পড়বে তারা শুধু যে কেবল নির্মল হাস্যরস থেকেই বঞ্চিত হবে তা নয়, বঞ্চিত হবে বাংলা কিশোর সাহিত্যের এক মাস্টারপিস থেকেও। হাস্যরস উপভোগের কূল ছাড়ানো মাত্রার এই বইটি তাই সকলেরই বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের পড়া উচিত। সারাদিন কেবল মোবাইলের স্ক্রিনে না তাকিয়ে, ফেইসবুকে চ্যাট না করে বা টিভিতে আবজাব না দেখে এই বইটি পড়ে ফেললে সেটি কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও অনেক উপকার হবে। বই পড়ার চেয়ে ভাল কাজ দ্বিতীয় আর কী হতে পারে ? কিছুই না। তাই বলি, জীবনটা আফসোস করার জন্যে বড্ড বেশি ছোট। তাই পড়ে ফেলা যাক টেনিদা সমগ্র। “ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক-ইয়াক”।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:১১