
প্রত্যেক মানুষের মাঝেই দু'টি দিক আছে। তার বুদ্ধি, বিবেক বা চিন্তাশক্তি এবং তার কিছু ইমোশন বা ফিলিংস। এই দু'টি দিক ব্যবহার করেই আমরা যে কোন জিনিস বিবেচনা করি। তবে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তির চেয়ে বেশি ইমোশনই প্রাধান্য পায়। আর মনের এই অনুভূতিগুলো যখন কৈশোর,তারুণ্য এবং যৌবনে প্রবল হয়; ঠিক তখনি আমরা পাই লিভ টুগেদারের ধারণা, বিবাহ পূর্বক দায়বদ্ধতাযুক্ত সম্পর্কের পরিবর্তে দায়বদ্ধতাহীন প্রেম বা ভালবাসা টাইপ সম্পর্ক তৈরির অনুমোদন।

গান, ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট, নাটক, সিনেমায় অতিরিক্ত গ্ল্যামার দিয়ে এটাই বারবার ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে খেয়াল করি, এই প্রত্যেকটি সম্পর্কই শুধুমাত্র মানুষের জৈবিক আকাঙ্খা এবং এবং ফ্রিডম এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। একটা মানুষের কিছু দৈহিক এবং মানসিক চাহিদা থাকে। কিন্তু সমাজ এই চাহিদাকে পূরণের জন্য থিওরেটিকালি বিয়েকে একমাত্র মাধ্যম বললেও, সমাজের মানুষের চিন্তা ভাবনায় তার উন্মেষ ঘটানোর কোন চেষ্টা চালাচ্ছে না। বরং তার উল্টোটাকেই নীরবে সায় দিয়ে চলেছে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরাই এই ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে, 'আমার ইচ্ছা হলে আমি সম্পর্ক করব, ইচ্ছা হলে ভেঙ্গে দিব'। মানুষকে বিশ্বাস দেয়া হয় লিমিট নির্ধারণ তার-ই হাতে। কোনটা ঠিক, কতখানি বেঠিক এটা নিজের চাইতে বেশি বুঝার আর কেউ নেই। তাই যা গতকাল ছিল নোংরা, নষ্টামি আর বেহুদাপনা; আজ তাই-ই প্রেমের মুখোশ পরে হাজির হয়।

কয়েক বছর আগেও মানুষ 'প্রেম করি' বলতে ভয় পেত। লুকিয়ে রাখত। কিন্তু আজকে অনেকগুলি প্রেম করা হল গৌরবের বিষয়। না করলেই তারা ব্যাকডেটেড, ফিলিংসলেস, অ্যাবনরমাল। তাই এখন মানুষ বরং এটা বলতেই লজ্জা পায় যে আমার বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড নাই। আর আমার বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড আছে বলতে পারা মানেই যেন আমি বিশাল কিছু 'অ্যাচিভ' করে ফেললাম। একজন ছেলে বা মেয়ের 'স্ট্যাটাস' এর মাপকাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সম্পর্ক তৈরি করতে পারার মতা।

মানুষের আত্মসম্মান বোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, ভাল লাগার জন্য আরেকজনের দেয়া মিথ্যা বানোয়াট কিছু মন্তব্যের উপর ভরসা করে থাকতে হয়। সমাজ শুধু বিবাহনামক বন্ধন কে বৈধতা দিলেও, প্রেম ভালবাসাকে কিন্তু অবৈধ করে দেয়নি। বরং তার দিকেই চৎড়াড়শব করছে। ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিচ্ছে সেটা ভুল নয়। তাই ছেলেমেয়েরাও সমাজের সম্মোহনী শক্তির কাছে হার মেনে প্রেম আর ভালবাসায় জড়িয়ে 'ফান' খুঁজে পাচ্ছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, লোভ আর স্বার্থপরতার কাছে আত্মসম্মানকে বিলিয়ে ভাবছে তারা উন্নত। তবে প্রেম ভালবাসা আর লিভ টুগেদারের সময় একজন নারীর সতীত্ব ও একজন পুরুষের ব্যক্তিত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকে তার হিসাব সমাজ রাখে না। তখন জন্ম নেয়া একজন শিশুর বাবা-মার দায়িত্ব কে পালন করবে সে কথার উত্তরও সমাজ দেয় না। ওদের সামাজিক অবস্থান কি হবে, ভবিষ্যৎ কি তা নিয়েও সমাজ নির্বিকার। এক রকম ঝাপসা ধারণা নিয়েই নতুন প্রজন্ম এই ভয়ানক অন্ধকারের দিকে ঝাঁপ দেয়।
তারপর যখন এক সময় তাদের কামনা-বাসনার পেট কিছুটা ভরে ওঠে, তখন নিজেকে আবিষ্কার করে নর্দমার চাইতেও নোংরাতম স্থানে। আর সেখান থেকে ফিরে আসার কোন পথ খুঁজে পায় না। দায়বদ্ধতা থেকে বেঁচে থাকার এই ভ্রান্ত পথ বেছে নিতে গিয়ে কতজনের মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সবচেয়ে বড় কথা একজন মানুষ শুধু পশুর মত তার দৈহিক আর যৌন চাহিদা মেটানোকেই জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিক মনে করতে শুর" করে। কিন্তু মানুষ আর পশুর মধ্যে তাহলে পার্থক্যটা কোথায় থাকল?

একজন নারীর মূল্য কি এতোই কম? শরীরের একটু আনন্দের জন্য যার-তার সাথে সম্পর্ক তৈরিতে কি করে নিশ্চয়তা পাওয়া যায় যে এটা স্থায়ী সমাধান? যেই বয়ফ্রেন্ড এর হাত ধরে ঘুরতে এত মজা লাগে তাকে স্বামী হিসেবে কেন গ্রহণ করা যায় না? এরকম সম্পর্ক কি আসলেই প্রেমের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে কিনা সেটাও একটা বিশাল প্রশ্ন। আজ যে মানুষটি সার্ভিস দিচ্ছে, কাল তার একখানা ভুলের জন্যই সম্পর্ক ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তখন কি আমরা তার জন্য ভাবি নাকি নিজের জন্য? পুরো সম্পর্কটাই আসলে দাঁড়িয়ে আছে এক ধরনের স্বার্থপরতার উপর ভিত্তি করে, দায়িত্ববোধের ছিঁটেফোটাও সেখানে নেই। এখানে আমরা সবাই 'ড্যাম কেয়ার'। নিজের জন্য ভাবতেই বেশি আগ্রহী। আমি সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেললে কে কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে আমার কিছু আসে-যায় না। শুধু 'আমার' ওকে ভাল লাগে, তাই 'আমি' ওর সাথে থাকতে চাই। সামনের মানুষটির চেয়ে তখন এই 'আমি' কেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ঠিক একইভাবে সামনের মানুষটিও কিন্তু নিজেকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। 'গিভ এন্ড টেইক' এর খেলা। যার ফলাফল শূন্য। কোন ধর্ম তাই এরকম সম্পর্কের কোন অবস্থান নেই, যেখানে মানুষের সম্মানের চেয়ে বেশি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়। যেখানে ভাল লাগাই সব, স্খায়িত্বের প্রসঙ্গ নেই। যেখানে চেতনা লোপ পায় আর শুধুমাত্র দেহের তৃষ্ণা, মনের আকাঙ্খা মেটাতে মানুষ পশুর মত ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরকম সম্পর্কের অনুমোদন দিয়ে আসলে মানুষের পশুবৃত্তিকেই জাগিয়ে তোলা হয়। যখন মানুষ ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করে, অন্যের স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। আমরা কি চাইব কেউ আমার শরীর কে ব্যবহার করে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিক? এই কি ভালবাসা? যে সম্পর্কে দুই পরে দৈহিক এবং মানসিক প্রয়োজনের স্থায়ী সমাধান দেয়া হয় না সেই সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। কোন সমাজ গড়তে এবং প্রগতির ক্ষেত্রে তা সহায়ক হতে পারে না।

বিয়ের মাধ্যমে একত্রে পথ চলার অঙ্গীকার করে। সেখানে প্রেম আছে। ভালবাসা আছে। আছে ফুটফুটে সন্তান। পরস্পরের প্রতি সম্মান, মায়া-মমতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে দু'জনে সুস্থ সুন্দর পারিবারিক জীবন ধারণ করার অঙ্গীকার। ধর্ম মানুষকে শুরুতেই জীবনের উদ্দেশ্য দান করে। মানুষের সুবিধার জন্য সম্পর্ক, সম্পর্কের জন্য মানুষ নয়। কিন্তু আমাদের সেকিউলার সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতা আমাদেরকে বলে আমি যা চাই তাই পেতে পারি। আমার ইচ্ছার কোন সীমা নাই। তারপর সেই ইচ্ছার পিছনে অন্ধভাবে ছুটতে যেয়ে নোংরা অনাকাঙ্খিত পরিণতি হোক, হোক সম্পর্ককালীন বা পরবর্তী জটিলতা- তার দায়িত্ব সমাজের নেই। সেকিউলার সমাজ আমাদেরকে লোভী হতে বাঁধা দেয় না। তাই চিন্তাধারা থাকে, 'আমি এটা বা ওটা চাই'। কিন্তু ধর্ম বলে সংযমের কথা। এখানে একজন ছেলে আর মেয়ে একে অপরের সুবিধার কথা ভাবে। তাই ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাতে নারী-পুরুষের পক্ষে সম্মান বজায় রেখে পাশাপাশি কাজ করে একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব, আর সেকিউলার ত্রুটিপূর্ণ সমাজে আশা করা যায় শুধুই গ্লানি, হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী।
সুত্রঃ
লিখেছেনঃ---ইলা মুৎসুর্দ্দী
দৈনিক পূর্বকোন (চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত) ১৪.১২.২০১১
ছবি নেট থেকে-