মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা তাদের উত্তরসূরী, তাই গর্বিত। তবে আমার তো মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেই। তাহলে আমি কি মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরী নই। গুটিকয়েক সনদদারী ছাড়া আমাদের পরিচয় কী? যুদ্ধাপরাধীরা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবাই অংশ নিয়েছিল কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা সনদ নেননি বা কেউ আবার পাননি। সনদ নেই বলে তারা কোন দলে মুক্তিযোদ্ধা নাকি যুদ্ধাপরাধী? এটা কি জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে না?
জনশ্রুতি আছে সনদ নাকি কিছু অর্থের বিনিময়ে নেয়া যায়। কিন্তু আমার তো সে অর্থও নেই। অর্থ না থাকলে কী হয়েছে, কোন রাজনৈতিক দলের ইবাদত করলে, সে প্রভু ক্ষমতায় থাকলে এ সনদের জন্য চিন্তা করতে হয় না। যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই সনদ পেত, তাহলে ক্ষমতাসীন দলগুলোর পরিবর্তনের সাথে সাথে এ সনদের সংখ্যার পরিবর্তন ঘটত না। এ সনদের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবসা ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ সনদের স্বচ্ছতা নিয়ে জরিপ করুন বা অনুসন্ধান করুন এটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
কিন্তু কেউ না কেউ তো খাটি সনদটির ধারক। তারা কেন কোটা পাবে না? কোটা চালুর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৩২ সালে ব্রিটেনে প্রথম কোটা চালু হয়েছিল বঞ্চিত বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর জন্য। কোটার বৈশিষ্ট্য বা সংজ্ঞায়নেও এটি পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর জন্য। তাহলে তো প্রশ্ন জাগবেই মুক্তিযোদ্ধারা কি পিছিয়ে পড়াদের কেউ? এটা কী তাদের জন্য সম্মানের? সম্মান যদি জানাতে হয়, তাদের পুরুষ্কৃত করুন, মাসিক ভাতা বৃদ্ধি করুন, আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বড় অংকের এককালীন ভাতার ব্যবস্থা করুন কেউ একটি কথাও বলবে না । বারবার বলছি, কোটা দিয়ে সম্মান হয় না; পিছিয়ে পড়াদের টেনে তুলে আনার প্রক্রিয়া এটি। তাই জাতির গর্ব মুক্তিযোদ্ধাদের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করবেন না।
কোটার মাধ্যমে অমেধাবীরা সুযোগ পায় এটা পিএসসির বক্তব্য বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়। কোটার পদ শেষ পর্যন্ত পূরন হয় না, কেন হয় না? আপনারা যে ন্যুনতম মার্কস নির্ধারণ করে দেন তাও কি তারা পায় না? না, পায় না বলেই ৩৪ তম বিসিএস প্রশ্নপত্রটি এত সহজ করলেন, একটি প্রশ্নও ইংরেজী থেকে করলেন না। করবেনই বা কেন, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংঠনগুলো তো পড়াশুনার সময় পায় না, আপনাদের দলের ভরাডুবিতে ব্যস্ত থাকে। তাই তাদের একটি মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে পুলসেরাত পার করে দেন। দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের এ দেশে আপনাদের সেক্টর মানে রাজনৈতিক দল চ্যাম্পিয়নের চ্যাম্পিয়ন কারণ চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, তাই পুলিশ –প্রশাসন বা সরকারি সেক্টরগুলোতে এত দূর্নীতি। ছাত্রজীবনে যে প্রভুর আজ্ঞাবহ দাস ছিল তার আনুকুল্যেই আবার সুফলটা কড়ায়- গন্ডায় আদায় করে নিতে একটুও ভুল করেন না কোটাধারী ছদ্মবেশীরা। তাই কোন রাজনৈতিক দলই কোটার বিরুদ্ধে জোর গলায় কিছু বলে না। কারণ নিজেরা তো দূর্নীতিবাজ, সিভিল সার্ভিসে অনুরূপটা চাই – এ লক্ষ্য বাস্তবায়নেই কোটা।
আমি নারী কোটা বিরোধী নই, যদিও আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতা সবাই নারী। বেগম রোকেয়া তাঁর বাড়িতে পড়াশুনা করেছেন, সে সময়ে নারীরা বাড়ির বাইরে যেতে পারত না আর এখন মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। তবে কেন কোটা দিয়ে তাদের এখনও পিছিয়ে পড়াদের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছে আমার বোধগম্য নয়।
নারীদের জন্য যতদিন কোটা থাকবে, ততদিন বিশ্বে এ বার্তা থাকবে, আমরা নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারিনি। তাহলে কখন, কিভাবে বুঝব যে নারীদের পূর্ণ ক্ষমতায়ন হয়েছে।
একটি যাত্রীবাহী বাসে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন থাকে আবার প্রতিবন্ধীদের জন্যও সংরক্ষিত আসন থাকে। এটা কী বার্তা দেয়, তা কিন্তু ব্যাখার প্রয়োজন হয় না। তাই এগুলো বন্ধ করা উচিত। আমাদের সমাজে নারীরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা পঙ্গু নয়, কোটার মাধ্যমে তাদের পঙ্গু করবেন না।
কোটা পদ্ধতি সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। তবে চাকরিতে সমান সুযোগের কথা বললেও আরো বলা আছে, পিছিয়ে পড়াদের জন্য বিশেষ বন্দোবস্তের কথা বলা আছে। মুক্তিযোদ্ধারা, নারীরা কি তাহলে পিছিয়ে আছে? আর মেধাবীদের চাকরিতে সমান সুযোগ না দেওয়ায় এটা মানবাধিকারো ক্ষুন্ন করে। তাই কোটা কতটা সংবিধান বিরোধী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।