দিন দিন প্রযুক্তি সহজতর করেছে জীবনের প্রতিটি কাজ। বিনোদন থেকে শুরু করে দাপ্রিক কোনো কাজই আর প্রযুক্তির বাইরে নয়। একই ভাবে বেশ কিছুদিন আগেই আমাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে এই আধুনিক মাধ্যমটি। ফলে দিন দিন বাড়ছে ই-বাণিজ্যের প্রসার। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা স্বত্বেও বাংলাদেশে ইতিমধ্যে কিছু ই-বাণিজ্য ওয়েবসাইট গড়ে উঠেছে। ই-বাণিজ্যকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ একদিকে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি করা সম্ভব তেমনি একই সাথে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও যুক্ত হয়েছে অমিত সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির সুযোগ।
তবে বিষয়টি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা নেই আমাদের অনেকেরই। সাধারণ মানুষদের মধ্য ই-কমার্স সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় আইসিটি ম্যাগাজিন কমপিউটার জগৎ ই-বাণিজ্য মেলা ২০১৩ এর আয়োজন করতে যাচ্ছে (৭-৯ফেব্রুয়ারী)। এই মেলাতে দেশের বিভিন্ন ই-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য ও সেবা সমূহ সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরবে। মেলা অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত সুফিয়া কামাল জাতীয় গ্রন্থাগারে।
সামহোয়্যার ইন...ব্লগের পাঠকদের জন্যে ই-কমার্সের বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতে কমপিউটার জগতের পক্ষ থেকে এই লেখাটির অবতারণা। আশা করি লেখাটি আমাদের অনেকেরেই কাজে লাগবে।
আমরা জানি, সামহোয়্যার ইন...ব্লগে দেশ বিদেশের এমন অনেক ব্লগার রয়েছেন যাদের কম্পিউটার আইসিটি বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আমাদের থেকে বেশি। তারা যদি ই-কমার্স নিয়ে এই বিষয়ে ব্লগে আলোচনায় অংশ নিয়ে সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন তবে তা সাধারণ পাঠকদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা ই-কমার্স ও ই-বাণিজ্য শব্দ দুটিকে সমার্থক হিসেবে গণ্য করেছি।
ই-কমার্সের সংজ্ঞা
ই-কমার্স একটি সংক্ষিপ্ত শব্দ। পুরো শব্দটি হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক কমার্স। মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া’য় ই-কামার্স এর সঙ্গায় বলা হয়েছে-
“Electronic commerce, commonly known as e-commerce, is the buying and selling of product or service over electronic systems such as the Internet and other computer networks.
(Source: http://en.wikipedia.org/wiki/E-commerce)
আমাদের পরিচিত ই-কমার্স-ইলেক্ট্রনিক কমার্স এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ইন্টারনেট এবং অন্যান্য কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কোন পণ্য বা সেবার ক্রয় অথবা বিক্রয় কাজকেই ই-কমার্স বলে।
উইকিপিডিয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, ইলেক্ট্রনিক ফাণ্ড ট্রান্সফার, সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারনেট মার্কেটিং, অনলাইন ট্রানজ্যাকশন প্রসেসিং, ইলেক্ট্রনিক ডাটা ইন্টারচেঞ্জ, ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস এবং অটোমেটেড ডাটা কালেকশন সহ বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তি ই-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত এবং আধুনিক যুগের ই-বাণিজ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, বিভিন্ন মোবাইল ডিভাইস এবং টেলিফোনের উপরে বিভিন্ন ভাবে নির্ভরশীল।
Brian C. Satterlee তাঁর E-Commerce: A Knowledge Base বইতে ই-বাণিজ্যের নিম্নোক্ত সংজ্ঞাটি প্রদান করেছেন-
“E-Commerce is defined as any transaction over the Internet involving the transfer of goods, services or information or any intermediary function that helps enable those transaction.”
(Source:http://books.google.com.bd/books?id=6VXxz0f6DBcC&printsec=frontcover&dq=e-commerce&hl=en&sa=X&ei=X7q1ULSKL8XXrQezs4DgDQ&redir_esc=y)
অর্থাৎ ইন্টারনেটে সম্পন্নকৃত কোন পণ্য বা সেবার লেনদেন, অথবা মধ্যবর্তী কোন কাজ যা সম্পাদনে লেনদেন সফল হয় তাই ই-বাণিজ্য।
ই-কমার্স’র প্রকারভেদ
লেনদেনকারী পক্ষের (ক্রেতা, বিক্রেতা এবং অন্যান্য)ওপর ভিত্তি করে ই-বাণিজ্যকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। এবার আমরা সে বিষয়ে আলাপ করছি।
বিজনেস-টু-কঞ্জিউমার (বি-টু-সি)/ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ভোক্তা
এই ধরণের ই-বাণিজ্যে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান একজন ক্রেতার কাছে পণ্য/সেবা বিক্রি করে থাকে। যেমনঃ অ্যামাজন.কম থেকে কোন ক্রেতা পণ্য কিনছেন। বাংলাদেশেও অনেক বি-টু-সি ওয়েব সাইট আছে। এগুলোর মধ্যে রকমারী.কম (http://rokomari.com/) একটি উল্লেখযোগ্য ওয়েবসাইট।
বিজনেস-টু-বিজনেস (বি-টু-বি) ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
এই ধরণের লেনদেনে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এটি দেশের মধ্যে অথবা দেশের বাইরেও হতে পারে। আমাদের দেশে রপ্তানী খাতে বিজনেস-টু-বিজনেস ই-বাণিজ্য হয়ে থাকে। রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান এবং ক্রেতা ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং পাইকারী এবং খুচরা বিক্রেতার মধ্যে ইন্টারনেটে লেনদেন বিজনেস-টু-বিজনেস ই-কমার্সের মধ্যে পড়ে।
কনজ্যুমার -টু- কনজ্যুমার (সি-টু-সি)/ ভোক্তা-ভোক্তা
এর অর্থ হচ্ছে একজন ভোক্তা থেকে আরেকজন ভোক্তার কাছে বিক্রি করা। ধরা যাক, আপনার টেলিভিশনটি পুরানো হয়ে গিয়েছে এবং আপনার বর্তমান টিভি সেটটি বিক্রী করে নতুন টিভি সেট কিনতে চান। এরকম কিছু ওয়েবসাইট আছে যেখানে আপনি আপনার টেলিভিশন বিক্রী করার জন্য বিজ্ঞাপন দিতে পারেন এবং নিলামে বিক্রী করে দিতে পারেন। ওয়েবসাইটটি এখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করবে এবং লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এর বিনিময়ে উক্ত ওয়েবসাইটকে একটি কমিশন বা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিতে হবে। ই-বে (Ebay) বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সি-টু-সি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সি-টু-সি ওয়েবসাইট হচ্ছে- ক্লিকবিডি(http://www.clickbd.com) এবং বিক্রয়.কম (http://bikroy.com/)।
কনজ্যুমার -টু-বিজনেস (সি-টু-বি)/ ভোক্তা-ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান
এ ধরণের লেনদেন ভোক্তা যে পণ্য কিনতে চান তা কিনতে পারেবন বা কোন প্রজেক্ট কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করাতে পারেন। ফ্রি-ল্যান্স আউটসোর্সিং একটি প্রকৃষ্ট উদাহারণ।
ই-কমার্সের বিভিন্ন প্রকারভেদ সম্পর্কে আরও জানতে এই ওয়েবপেজটি ভিজিট করুনঃ
Click This Link
ইতিহাস
ই-বাণিজ্যের যাত্রা শুরু হয় ৬০ এর দশকে। তবে প্রথমদিকে ই-বাণিজ্যের চিত্র ছিল একটু ভিন্ন। তখন বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদানপ্রদান করত। এই আদান প্রদানের জন্য তারা ইলেক্ট্রনিক ডাটা ইন্টারচেঞ্জ (ইডিআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করত। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী আর্পানেট (ARPAnet) তৈরি করে যা থেকে আজকের ইন্টারনেট সৃষ্টি হয়। ১৯৭৯ সালে বিখ্যাত ইংরেজ আবিস্কারক এবং উদ্যোক্তা, মাইকেল অল্ডরিচ, ‘টেলিশপিং’ উদ্ভাবন করেন যা থেকে অনলাইন শপিং এর উদ্ভব। ৮০’র দশকে ফ্রান্সে মিনিটেল নামে একটি সার্ভিস চালু হয়। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব চালু হবার আগে এটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন সার্ভিস। ওই একই সময়ে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ট্রাভেল কোম্পানী থমসন হলিডে তাদের ওয়েবসাইট প্রথম বি-টু-বি অনলাইন শপিং চালু করে। তবে ই-কমার্সের সত্যিকারের ব্যাপ্তি ঘটে ৯০ এর দশকে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউণ্ডেশন (এনএসএফ) বাণিজ্যিকভাবে ইন্টারনেট চালু করার উপরে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার পরে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে ই-কমার্সেরও প্রসার ঘটে।
বাংলাদেশে ই-বাণিজ্যের শুরু
বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই চালু হয়ে গেছে ই-কমার্স। ৯০ দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে ই-কমার্স নিয়ে চিন্তাভাবনা ও প্রচেষ্টা শুরু হলেও অনলাইনে লেনদেনের কোন কার্যকরী পদ্ধতি না থাকায় সে প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখেনি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু করে। এর ফলে বাংলাদেশে ই-কমার্সের সূচনা হবার পথে প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটে। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রদত্ত তথ্যমতে (http://www.bangladesh- bank.org/pub/special/14062012.pdf) বাংলাদেশ ব্যাংক চার ধরণের অনলাইন লেনদেন করার অনুমোদন দিয়েছে-
অনলাইনে ইউটিলিটি বিল প্রদান।
একই ব্যাঙ্কের মধ্যে এক গ্রাহকের হিসাব থেকে অন্য গ্রাহকের হিসাবে অনলাইনে অর্থ স্থানান্তর।
ক্রেতার ব্যাংক হিসাব থেকে বিক্রেতার ব্যাঙ্কের হিসাবে অনলাইনে অর্থ প্রেরণ।
স্থানীয় মুদ্রায় ইন্টারনেটে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন।
বর্তমানে প্রায় ৩৭টি ব্যাংক পুরোপুরি অনলাইন ব্যাঙ্কিং সেবা প্রদান করছে আর ৪টি ব্যাংক আংশিক অনলাইন সেবা প্রদান করছে। এছাড়াও আরও ছয়টি ব্যাংক খুব শীঘ্রই অনলাইন সেবা প্রদান করা শুরু করবে। বর্তমানে ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড (ডিবিবিএল) এবং ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশে ই-কমার্স মার্চেন্ট একাউন্ট সুবিধা প্রদান করে আসছে। অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য ব্যাংক গুলোও এই সুবিধা প্রদান করবে।
আউটসোর্সিং বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে দেশে সর্বোচ্চ ৫০০ ডলার পর্যন্ত আনার অনুমতি প্রদান করেছে। এতে করে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং খাতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন লেনদেন প্রতিষ্ঠান পে-প্যাল বাংলাদেশীদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তখন অনেকেই ইন্টারনেটে কাজ করে খুব সহজেই দেশে টাকা আনতে পারবেন।
ই-কমার্স: কিছু পরিসংখ্যান
উন্নত দেশে ই-কমার্স এখন বিশাল লাভজনক একটি ইন্ডাস্ট্রি। যুক্তরাষ্ট্রের ই-কমার্স বাজার বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়। অ্যামাজন, ই-বে এর মত বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান সবই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে (Click This Link) বলা হয় যে, ২০১২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আমেরিকাতে ই-কমার্সে ৫৪.৮ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন সম্পাদিত হয় যা প্রথম প্রান্তিকের লেনদেনের তুলনায় ৩.৩% বেশি ।
বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান কমস্কোর (http://www.comscore.com) প্রতি প্রান্তিকে আমেরিকার ই-কমার্সের উপরে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। ২০১১ সালের চতুর্থ প্রান্তিকের রিপোর্টে তারা বলে যে অনলাইনে মোট কেনাকাটার পরিমাণ ছিল ৪৯.৭ বিলিয়ন ডলার যা ২০১০ এর চতুর্থ প্রান্তিকের তুলনায় ১৪% বেশি এবং অনলাইনে কেনা কাটার পরিমান গত কয়েক বছর ধরে টানা বেড়ে চলছে। ২০১১ সালে আমেরিকাতে রিটেইল ই-কমার্সের লেনদেন বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৬১.৫ বিলিয়ন ডলারে যা ২০১০ সালের তুলনায় ১৩% বেশি। (Click This Link)
২০১২ সালের প্রথম প্রান্তিকের রিপোর্টে বলা হয় অনলাইনে কেনাকাটার পরিমাণ ছিল ৪৪.৩ মিলিয়ন ডলার যা গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ১৭% বেশি। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পণ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ডিজিটাল কন্টেন্ট এবং সাবস্ক্রিপশন, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, সোনাদানা, ঘড়ি, ইভেন্ট টিকেট ইত্যাদি এবং এই প্রতিটি পণ্যের বিক্রী গত বছরের তুলনায় ১৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। কমস্কোর আরও উল্লেখ করেছে যে, আমেরিকাতে ট্যাবলেট পিসি ব্যবহারকারীদের মোট ৩৮ শতাংশ অনলাইনে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য ক্রয় করেছে যার মধ্যে অন্যতম ছিল কাপড়চোপড় কেনা।
(Click This Link)
২০১২ এর প্রথম ছয় মাসে আমেরিকার ই-কমার্স বাজারের অবস্থা।
(Source: ComScore)
চীনেও ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ই-মার্কেটার (eMarketer) নামে আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান "China Ecommerce:A Developing Market Begins to Boom" (Click This Link))/Article/Chinas-Ecommerce-Market-Joins-Majors/1009466)শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে বলা হয় যে, চীনের ভোক্তারাও এখন আস্তে আস্তে অনলাইনে কেনাকাটা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং এ বছরে চীনের মূল ভ-খণ্ডে অনলাইন ক্রেতার সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২২ কোটিতে যা আমেরিকার মোট অনলাইন ক্রেতার থেকেও বেশি (১৫ কোটি) এবং ২০১৬ সালে ৪২ কোটিরও বেশি চীনা লোক (১৪ বছর এবং তার থেকে বেশি বয়সের) বছরে অন্তত একবার অনলাইনে কোন জিনিস ক্রয় করবে।
(Source: eMarketer)
(Source: eMarketer)
চীনের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ই-কমার্স ওয়েবসাইটের নাম হচ্ছে- Tmall.com (http://www.tmall.com), 360Buy.com (http://www.360buy.com), এবং Suning.com (http://www.suning.com)।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অনলাইনে কেনাকাটা খুবই জনপ্রিয় হয় উঠছে। এখন টিভিতে বিভিন্ন ভারতীয় ই-কমার্স কোম্পানীর বিজ্ঞাপন দেখা যায়। যেমন- ফ্লিপকার্ট (http://www.flipkart.com/), মিন্ত্রা (http://www.myntra.com/) ইত্যাদি। Boston.com এর তথ্য (Click This Link)মতে, ২০২৪-২০২৫ এর মধ্যে ভারতের অনলাইন বাজারে লেনদেনের পরিমান ১২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৬০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কমস্কোর ভারতের ই-কমার্সের উপরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। “State of e-Commerce in India” শিরোনামের এই রিপোর্টে (http://www.assocham.org/arb/general/Comscore_ ASSOCHAM-report-state-of-ecommerce-in-india.pdf) বলা হয়েছে যে জুলাই ২০১২ পর্যন্ত ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা
হচ্ছে ১২.৪ কোটি অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের একজন ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। অনলাইন ভ্রমণ ওয়েবসাইটে ভারতে খুবই জনপ্রিয়। প্রচুর ভারতীয় লোকজন দেশে এবং বিদেশে যাবার জন্য বিভিন্ন অনলাইন ট্রাভেল এজেন্টের ওয়েবসাইট ভিজিট করে। ভারতে রেলওয়ের ওয়েবসাইট খুবই জনপ্রিয়। প্রতি মাসে ১ কোটির ও বেশি লোক ভারতের রেলওয়ে ওয়েবসাইট ভিজিট করে থাকেন।
ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন ভ্রমণ ওয়েবসাইট।
(Source: ComScore)
অনলাইনে আয়ের দিক থেকে শীর্ষে আছে MakeMyTrip (২০৬ মিলিয়ন ডলার) Yatra.com (১৬৬ মিলিয়ন ডলার) এবং ভারত রেলওয়ে (১৭ মিলিয়ন ডলার)।
এবার আসি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। এই লেখার বাকী অংশে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বিভিন্ন দিক নিয়ে কিছু আলোচনা করা হলো।
সমস্যা
এ কথা সত্যি যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দর্শনের আলোকে বিগত দুই-তিন বছরে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এ খাতের অধিকতর উন্নয়নকল্পে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছরে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা এখনও অতি নগণ্য। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কয়েকটি বড় শহর ছাড়া বাকী ছোট ছোট শহর এবং গ্রাম এলাকায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট এখনও সহজপ্রাপ্য নয়। পাশাপাশি হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য বড় এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন লেনদেনকে এখনও ততটা গুরুত্বের সাথে নেয়নি এবং এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। দেশে ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বেশ কম কারন দেশে অবস্থান করে বিদেশী ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট/ ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের সুযোগ এখনও তৈরি হয়নি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শাখা সমূহের অনলাইন আন্ত:ব্যাংক সংযোগ স্থাপনের কাজ বেশ জোরেশোরে চললেও সরকারী ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বাংলা ভাষায় ওয়েবসাইটের স্বল্পতা এবং ই-কমার্স বাস্তবায়নে দক্ষ জনশক্তির অভাবের বিষয়টিকেও গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সাধারন মানুষের মধ্য থেকে অনলাইন লেনদেন সম্পর্কিত সকল ভয়ভীতি দুরকল্পে সাইবার আইন আরো সুসংগঠিত করা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
করণীয়
প্রথমত, দেশের সর্বত্র উচ্চ গতির ইন্টারনেট সহজলভ্য করা। দ্বিতীয়ত ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশী ওয়েবসাইট থেকে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের বিষয়টি অনুমোদন দেয়া উচিত। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন যেমন বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই এর উচিত তাদের সদস্য সংগঠনগুলোকে ই-কমার্সের সুবিধাগুলো সম্পর্কে অবগত করে তাদেরকে অনলাইন লেনদেন চালু করতে উদ্বুদ্ধ করা। অনলাইন লেনদেনের ব্যাপারে সাধারন ক্রেতাদের ভয়ভীতি দূর করতে মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সরকারের উচিত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিপূর্ণ অটোমেশন এবং অনলাইন সেবা প্রদান চালু করা উচিত। অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়ার সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে প্রয়োজনীয় সকল আইন প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি। ব্যাংকের বিশেষ করে সরকারী ব্যাংকের শাখা অফিসগুলোর মধ্যে অনলাইন আন্তঃ ব্যাংকিং সংযোগ স্থাপনের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অনলাইন সেবা চালু করেছে, তবে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকটির অন্যান্য কাজেও যেমন ক্লিয়ারিং হাউজ/ নিকাশ ঘরের কাজে ইন্টারনেটের সম্পৃক্ততা জরুরি। অনলাইন মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাদের ওয়েবসাইটে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করা। ই-কমার্স সেক্টরের দক্ষ জনশক্তির কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগে ই-কমার্স সম্পর্কিত কোর্স চালু করা যেতে পারে।
ই-কমার্স: সার্বজনীন ব্যবহার
আপাতদৃষ্টিতে ই-কমার্স বলতে শুধুমাত্র ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে কোন পণ্য বা সেবা ক্রয় করা বোঝালেও, সত্যিকার অর্থে ই-কমার্স বাস্তবায়ন করার অর্থ হচ্ছে দেশব্যাপী এর সার্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত করা। সর্বস্তরের মানুষের কাছে ই-কমার্স সেবা পৌছে দেয়া সম্ভব হলেই কেবল বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে ই-কমার্স বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়েছে তা দাবী করা যাবে। অনলাইন লেনদেনের বিষয়টি শুধুমাত্র বড় বড় শহরের মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। গ্রামের সাধারণ মানুষ হয়তো ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করতে পারবে না, তবে একই অবকাঠামো ব্যবহার করে আরো সহজতর প্রযুক্তি নিয়ে তাদের কাছে যাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ই-কমার্স সেবাসমূহ শুধুমাত্র গুটিকয়েক পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে (যেমনঃ গ্যাসের বিল বা বাড়ি ভাড়া প্রদানে, সরকারকে ট্যাক্স প্রদানে) ই-কমার্সকে সম্পৃক্ত করা উচিত।
ই-বাণিজ্যমেলা ২০১৩
বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত আইসিটি ম্যাগাজিন, ‘মাসিক কমপিউটার জগৎ’ বিগত ২২ বছর যাবত ঢাকা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। এরই মধ্যে পত্রিকাটি পাঠক নন্দিত হওয়ার পাশাপাশি ‘বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত’ হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রচলিত সাংবাদিকতার অর্গল ভেঙ্গে এ খাতের অগ্রগমনে সহায়ক নানা ধরনের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক মেলা, সাংবাদিক সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজন করে আসছি। তারই অংশ হিসেবে আগামী ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রয়ারি, ২০১৩ সালে ঢাকায় আমরা একটি ই-বাণিজ্য মেলা ২০১৩ (ই-কমার্স মেলা ২০১৩ ) আয়োজন করতে যাচ্ছি। এই মেলা সারাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ই-কমার্স মেলা সম্পর্কে সচেতনতা যেমনি বাড়বে, তেমনি মানুষ জানতে পারবে এর সম্ভাবনা সম্পর্কে।
এ কথা অনিস্বীকার্য, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন বাংলাদেশে এখন খুবই জনপ্রিয় এবং এদের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এরই ফলে বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে ই-কমার্স বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সফল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমরা মনে করি, ই-কমার্স দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা পালন করবে এবং একই সাথে বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। বর্তমান সরকারের সূচিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ই-কমার্স ইতিবাচক ভুমিকা পালন করবে।
মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে মূল পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। এ ছাড়া আইসিটি মন্ত্রণালয়ও এই মেলার ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করছে। মেলার প্লাটিনাম স্পন্সর হিসেবে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব মোবাইল অপারেটর টেলিটক এবং অনলাইন বিকিকিনির প্ল্যাটফর্ম সেলবাজার। গোল্ড পার্টনার হিসেবে ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে এসএসএল। এ ছাড়াও এই আয়োজনের পার্টনার হিসেবে আরও রয়েছে এমসিসি, ডেভসটিম, ঢাকা এফএম, সময় টিভি, বিডিওএসএন, আজকের ডিল, এখনি ডটকম, সামহোয়্যার ইন ব্লগ, বেসিস, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা অনলাইন, কমজগত টেকনোলজিস, অর্পণ কমিউনিকেশন, ওয়েবটিভিনেক্সট এবং সিজে সফট।
কেন এই মেলা
বাংলাদেশে অনেক কিছুর উপর মেলা থাকলেও ই-কমার্সের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর কোন মেলা এটাই প্রথম। আর আগামীর সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবেই এই আয়োজন। প্রযুক্তির নতুন এই ব্যবহার এবং এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সকলকে প্রণোদিত করার পাশাপাশি এক জায়গা থেকে সকলের অভিজ্ঞতা বিনিময় এর মূল উদ্দেশ্য। ই-বাণিজ্য করে যারা এই মুহূর্তে নিজেদের সময়কে বদলে দিচ্ছেন তাদের কাছ থেকে দেখা এবং ই-বাণিজ্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণাও পাবেন মেলায় আগতরা।
অপরদিকে অনেকক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কায় ভুগে থাকেন। এই শঙ্কা কাটিয়ে ঝুঁকিমুক্ত ই-বাণিজ্য প্রসারে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ই-বাণিজ্য মেলা ২০১৩ নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মেলার স্থান
মেলা অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত সুফিয়া কামাল জাতীয় গ্রন্থাগারে ফেব্রুয়ারী মাসের ৭ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত।
ওয়েবসাইট
ই-বাণিজ্য মেলা ২০১৩ সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য জানার জন্যে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে যার ঠিকানা হচ্ছে- http://www.e-commercefair.com/
সবশেষে আমরা ব্লগারদের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে বলতে চাই যে ই-কমার্স এমন একটি প্রযুক্তি যা সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনো ততটা সচেতন নন। সামহোয়্যার ইন ব্লগে লক্ষাধিক ব্লগার রয়েছেন এবং তারা যদি তাদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের এ নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে অবহিত করেন তাহলে কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোক এ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সম্পর্কে জেনে যাবেন। অতীতে আমরা দেখেছি সামহোয়্যার ইন ব্লগের মাধ্যমে এমন অনেক বিষয় সম্পর্কে মানুষকে জানানো হয়েছে ও সচেতন করা হয়েছে যেসব বিষয় নিয়ে মূলধারার মিডিয়া খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তাই লেখাটি যারা পড়ছেন তাঁদের সবার প্রতি অনুরোধ রইল ই-কমার্স বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেবার জন্য