১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত দিনগুলো পূর্ববাংলার জনগণকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল যে তার সরাসরি প্রভাব পড়েছিল ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট অর্জন করেছিল বিপুল বিজয়। তাদের ২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রধান দফাতেই বলা হয়েছিল , বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
১৬ দফায় বলা হয়েছিল, যুক্তফ্রন্টে প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলাভাষার গবেষণাগারে পরিনত করা হইবে।
এই দফায় বাংলা ভাষার গবেষণাগার বলা হলেও লোকমুখে এর নাম প্রচলিত হয়ে যায় বাংলা একাডেমী নামে।
কিন্তু নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও কার্যত উল্টে যায় সবকিছু। সরকার গঠনের মাত্র দুমাসের মধ্যে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারার বিধান অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে খারিজ করে প্রবর্তণ করেন গর্ভনরের শাসন ।
১৯৫৫ সালের ৩ জুন ২৯ (ক) ধারায় গভর্নরের শাসন প্রত্যাহৃত হয়। কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকার গঠন করেন পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের দ্বিতীয় মন্ত্রীসভা।
২১ দফা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে রূপদানের জন্য ১৯৫৫ সালের ২৬ নভেম্বর গৃহীত হয় সরকারী সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমির উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার। শুরু হয় বাঙালির প্রাণের প্রতিষ্ঠানটির পথচলা।
১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির সাথে সাথেই বাঙালি অগ্রসর হয় স্বাধীকার অর্জনের অভিযাত্রায়। ১৯৭১ সালে পরাধীনতার নিগড় ভেঙে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।
সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত বাংলা ভাষার এই দেশে বাংলা একাডেমি বিশেষ মাত্রা পায় স্বাভাবিকভাবেই। বাঙালির জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে জড়ো হওয়াটা পরিণত হয় বাঙালি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে। এই অঙ্গের সাথে জীবনের যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয় আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা।
ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ ১৯৭২ উদযাপন উপলক্ষ্যে এই গ্রন্থমেলার আয়োজন করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। গ্রন্থমেলাটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সরকারিভাবে আয়োজিত এই গ্রন্থমেলার ব্যাপ্তি ছিল ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বেসরকারিভাবে বই বিক্রির সূত্রপাত ঘটে একেবারে অনাড়ম্বরভাবে ১৯৭২ সালেই ।
জাতীয় জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন উপলক্ষ্যে প্রচুর জনসমাগমকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারার শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে বাংলা একাডেমির মাঠে বই বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় প্রকাশিত বিভিন্ন বইসহ মুক্তধারার কয়েকটি সদ্য প্রকাশিত বই দিয়েই রোপিত হয় বেসরকারী গ্রন্থমেলার বীজ।
১৯৭৩ সালে মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হ্রাসকৃত মূল্যে নিজস্ব বই বিক্রির ব্যবস্থা করে বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমির পাশাপাশি মুক্তধারা, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্সসহ আরো কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও গ্রহণ করে একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা।
১৯৭২ কিংবা ১৯৭৩ সালে বই বিক্রির জন্য কোন স্টল তৈরি হয় নি। ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সম্মেলন উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর এই আয়োজনের সাথে যোগ দেয় ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমির মঞ্চ তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরোনো ঢাকার খয়রাত ডেকোরেটরকে দিয়ে স্ব-উদ্যোগে কয়েকটি স্টল নির্মাণ করিয়ে নেয় তারা। একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নির্মিত সেই স্টলসমূহে নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। অনানুষ্ঠানিকভাবে মাঠের জায়গা ব্যবহার করতে দেবার সম্মতি ছাড়া স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির প্রত্যক্ষ কোন সহযোগ ছিল না।
১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি সীমিত আকারে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয় তারা। নির্দিষ্ট সেই জায়গায় স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে প্রকাশকেরা। এই ব্যবস্থা বজায় থাকে ১৯৭৮ সাল অবধি।
১৯৭৯ সালে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা, ইউপিএল-এর মহিউদ্দিন আহমেদ, আহমদ পাবলিশিং হাউজের হাজী মহিউদ্দিন আহমদ, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমীন নিজামী, নওরোজ কিতাবিস্তানের কাদির খান, খান ব্রাদার্সের ফিরোজ খানসহ আরো কয়েকজন প্রকাশক দেখা করেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক ফজলে রাব্বির সাথে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে বই বিক্রির আয়োজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলায় রূপান্তরিত করার জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালকের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জ্ঞাপন করে তারা।
প্রকাশকদের এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র একটি সভার আয়োজন করে। বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী আমন্ত্রিত হয়ে ঐ সভায় উপস্থিত হন। সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একুশে গ্রন্থমেলা নামে বই বিক্রির এই আনুষ্ঠানিক আয়োজনের অধিপতি ভূমিকা পালনকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। বাংলা একাডেমি ও প্রকাশকবৃন্দ থাকেন সহযোগির ভূমিকায়।
১৯৮০ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তার নিজস্ব কর্মকাণ্ডে ব্যস্ততার কারণে এই মেলার দায়িত্ব নিতে অপারগ হবার কারণে বাংলা একাডেমি নিজ উদ্যোগে আয়োজন করে একুশে গ্রন্থমেলা। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় গ্রন্থমেলার কার্যক্রম।
১৯৮১ সালে একুশের বইমেলার মেয়াদ ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। ১৯৮২ সালে বইমেলা শুরু হয় ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। মেলার মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে ২১ দিন হয়। ১৯৮৩ সালে একুশে বইমেলার আয়োজন সম্পন্ন হলেও চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বন্ধ থাকে মেলা। ১৯৮৪ সালে মেলার জন্য মাঠ সংস্কার করে বাংলা একাডেমি। নবউদ্যোগে, নবউদ্যমে, নবআঙ্গিকে পুনরুজ্জীবিত হয় গ্রন্থমেলা। পুনরুজ্জীবিত গ্রন্থমেলার নামও কিন্তু পাল্টে যায় এবার।
কী নাম হয় গ্রন্থমেলার?
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
তারপর থেকে এই নামেই আজ অবধি অনুষ্ঠিত হচ্ছে গ্রন্থমেলা, প্রতিবছর।
ছবি: সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৪০