যেহেতু জুলাইয়ে আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের শেষ ব্লক, তাই আমাদের ক্লাস টিচার প্রস্তাব করলেন আমরা একটা ক্লাস পার্টি করলে কেমন হয়। শেষ ব্লক বলে সবাই মোটামুটি শায় দিল।কিন্তু প্রশ্ন হল কোথায় যাব ? শুরুতে জার্মানির ভেতরে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান হলেও ক্লাসের সবার প্রস্তাব আর একটু দূরে গেলে কেমন হয়। অন্তত্ব ২-৩ দিনের একটা ট্যুর হলে মন্দ হয় না। ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট বয় সিমন্স এর প্রস্তাব তাহলে এক কাজ করি আমরা তাহলে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ যাই। খরচের হিসাব করলে জার্মানির কোন বড় শহরে ২ দিনের ট্যুরের টাকা দিয়ে প্রাগে ৩ দিন অনায়াসে কাটিয়ে আসা যাবে। এই প্রস্তাবে সবাই সায় দিলেও যে সমস্যা সামনে আসল তা হল প্রায় ৬০০ কিলোমিটার ফ্লাইটে গেলে খরচ পড়বে বেশি। যেহেতু ক্লাসের সবারই মোটামুটি গাড়ি আছে তাই এটা তেমন প্রব্লেম হবে না। এবার আসল সমস্যা সামনে চলে আসল। সেটা হল যেহেতু আমাদের ক্লাস বা ব্লক টাইম ও আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে । মানে আমরা যখন ক্লাস করি সেই সময়ে আমরা কোন কাজ না করলেও আমাদের কোম্পানি আমাদের সেলারি দেয় । তাই আমাদের প্রত্যেকের কোম্পানি থেকে পারমিশন নিতে হবে। ২-৩ দিন ক্লাস না করে আমরা ট্যুরে যাব । আর সেকেন্ড প্রব্লেম হল , যার এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি মানে যাদের বয়স ১৮ হয়নি তাদের গার্ডিয়ানের কাছ থেকে পারমিশন । শর্ত হলে ক্লাসের ৯০% এর কোম্পানি থেকে পারমিশন আসলেই আমরা যেতে পারব। এর ও সমাধান আমাদের ক্লাস টিচার বের করলেন। সবার কোম্পানিকে পারমিশন চেয়ে একটা মেইল করে দিলেন। অবশেষে পারমিশন মিলে গেল। এবার সামনের প্রস্তুতির পালা। সব মিলিয়ে আমরা ক্লাস টিচার সহ ১৬ জন। ৯ সিটের একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করা হল যেটা কিনা আমাদের ক্লাস টিচার ড্রাইভ করবেন । আর ক্লাসের ২ জনের পার্সোনার গাড়িতে বাকিরা, মোটামুটি ৩ টা কারে আমদের যাত্রা শুরু হবে ১৫ জুলাই সকালের সাড়ে ১০ টায় ,কি আর বলব যেদিন ট্যুরে যাব সেদিনও সকাল ৭,৪৫ থেকে ১০.১৫ পর্যন্ত ক্লাস করতে হয়েছে। অন্যটিচারাতো আর ট্যুরে যাবে নাই তাই তাদের ক্লাস করতে হবে। আর ট্যুরের বাকি ২ দিনের জন্য প্রিন্সিপালের পারমিশন নিয়ে নিয়েছে আমাদের ক্লাস টিচার।
যাই হোক অবশেষে সকাল সাড়ে ১০টায় যাত্রা হল শুরু। স্পেশাল পার্মিশন প্রাপ্তরা মানে ১৮ বছরের নিচের পোলাপাইসহ ক্লাস টিচারে সাথে গেল ৭ জন, আর আমরা বাকী ৮ জন্য বাকী ২ টা প্রাইভেট কারে যাত্রা হল শুরু। ক্লাস টিচারের মাইক্রো সামনে আর আমদের বাকি ২ টা প্রাইভেট কার পিছে পিছে। প্ল্যান হল , আমদের প্রথম যাত্রা বিরতী হবে প্রায় প্রথম ২০০ কিলোমিটার যাবার পর। যেহেতু সবার ট্যাঙ্কিই ভরা সো তার পরেও যদি কারো ইমাজেন্সি লাগে বা ব্রেক নিতে হয় তা হলে আমরা ডিস্কাস করে নেব।
জার্মানিতে অনেকগুলো হাইওয়ে আছে যেগুলোতে কোন স্পিড লিমিট নেই। আর হাইওয়েগুল সাধারনত ৩ লেনের সবচেয়ে কম স্পিডের গাড়িগুলো একদম ডান দিয়ে আর সবচেয়ে বেশি স্পিডের গাড়িগুলো একদম ডানের লেন ধরে চলে । যেহেতু আমরা ক্লাস টিচারের মাইক্রোকে ফলো করে যাচ্চি কারন তিনি আগেও কয়েকবার গিয়েছেন আর তার রাস্তাচেনা তাই আমাদের তার পেছন পেছন যেতে হচ্চে আর সে মাঝখানে লেন ধরে চলছে যেখানে স্পিড মোটামুটি ১০০-১২০ কিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মাঝের লেন ধরে বড় বড় সব কাভার্ট ভ্যান ও চলে তাই কিছুক্ষন পর পর লেন চেন্জ করতে হয় , আর আমাদের সামনের ২ টা গাড়ি মানে ক্লাস টিচার ও অন্য ফ্রেন্ডের গাড়ি মাঝের লেন দিয়ে যাচ্ছে আর কিছুক্ষনপ র পর সামনে কাভার্ড ভ্যান পড়লে হাইস্পিডের লেনে গিয়ে ওভারটেক করতে হচ্ছে । আর এটা কিছুক্ষন পর পরই করতে হচ্ছে। এর চেয়ে ভাল হাইস্পিডের লেনে থাকা। কিন্তু এটা আমাদের ক্লাস টিচার করছেন না, তাই তার দেখাদেখি আমাদের আরেক ফেন্ড ও কিছুক্ষন পর পর একই কাজ করছে আর আমরা যেহেতু সবার পেছেনে আর তাদেরকে ওভারটেক করে হাইস্পিড লেন ধরে গেলে আমরা সামনে চলে যাব, রাস্তাও চিনব না তাই আমাদের ও তারা যা করছে তা করতে হচ্ছে আর আমাদের ড্রাইভার মানে ক্লাসফ্রেন্ড মোটামুটি তার জানা সব কয়টা গালিই ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে এই রকম লেন চেঞ্জ করার জন্য।
যাইহোক মাঝ পথে ২ টা যাত্রা বিরতী করতে হল। প্রথমটা ইমার্জেন্সি টয়লেট আর ২ টাও আমাদের ফ্রেন্ডের গাড়ির ট্যাঙ্কি খালি হবার জন্য নেবার জন্য। আমরা ৩য় যাত্রা বিরতি নিলাম হাইওয়ের শেষ পেট্রল পাম্পে এখান থেকে মোটামুটি সবাই তাদের ট্যাঙ্কি ভরে নিল । আর প্রাগের রাস্তায় আমাদের গাড়ির জন্য স্পেশাল পার্মিশন নিতে হবে সেই পারমিশনের স্টিকারও এই পাম্পেই পাওয়া যায়। ইতিমধ্য দুপুর ২.৩০ প্রায়। তাই এখান থেকে মোটামুটি দুপুরের হাল্কা খাবার শেষে আবার শুরু হল যাত্রা। এখনও প্রায় ২০০ কিলোমিটারের পথ। ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভার চেঞ্জ। এবার এসেছে মহিলা ড্রাইভার মানে আমাদেরী আরেক ক্লাস ফ্রেন্ড। তার সামানের রোদ্রউজ্জল দুপুর আর হাইওয়েতে ১৪০-১৫০ স্পিড উঠাচ্ছে আমাদের লেডি ড্রাইভার। ফুল স্পিড আর হাই ভলিয়ম মিউজিক।
রাস্তার পাশের বিস্তৃত মাঠ আর দুরের গাছের সারি সে এক চমৎকার দৃশ্য
কিছুক্ষন পর রাস্তার সাইবোর্ডগুলোর ভাষা পরিবর্তন হয়ে গেল দেখে বুঝলাম আমরা চেক প্রজাতন্ত্রে ঢুকে পড়েছি আর মোবাইলে ওয়েলকামটু চেক প্রজাতন্ত্র আর রুমিনের প্যাকেজের ম্যাসেজ পেয়ে আরো ও শিওর হয়ে গেলাম। ইউরোপের সীমান্তগুলো আসলেই এমন কোন চেকপোস্ট নাই, কোন পুলিশ , ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নাই। হাইওয়ে ধরে গেলে রাস্তার পাশের ওয়েলকাল টু সাইনবোর্ড আর সাইনবোর্ডের ভাষা না দেখলে আসলে বোঝার উপায় নেই যে আপনি কোন দেশের রাস্তায় আছে।
রাস্তার পাশের দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে , বাড়ি ঘরের সংখ্যা বাড়ছে আর গাড়ির সংখ্যা বাড়তে আর গাড়ির স্পীড লিমিট সীমাবদ্ধ হয়ে ৭০থেকে ৫০ হয়ে শেষমেষ ৩০ এ আসার পর আমরা অপরুপ সোন্দর্যের নগরী প্রাগে প্রবেশ করলাম ।এ যেন আসলেই স্বপ্নের নগরী প্রতিটা বাড়িত প্রতিটা দেয়ালে রয়েছে অপরুপ সৌন্দর্যেন ছোয়া। কোনটা রেখে কোনটার ছবি উঠাব। আর এদিকে আমাদের ড্রাইভারের অবস্তা কাহিল ,রাস্তা ভরা গাড়ি আর যেহেতু আমাদেরকে সামনের ২ টা গাড়িকে ফলো করতে হচ্ছে তাই কিছুক্ষন পর পর লেন আর ইন্ডিকেটর লাইটকে ফলো করতে হচ্ছে তার। তাই সামনে বসা আমাদের আরেক ক্লাসফ্রেন্ড এক্ষেত্রে হেল্পারের ভুমিকা পালন করছে আর আমরা পেছনের সিটে বসে জানাল দিয়ে অপলক নয়নে প্রগের সৌন্দর্য দেখছি। বেচারা রাস্তার আর ইন্ডিকেটর লাইটের দিকে মনযোগ দিতে হচ্ছে তাই সে তার ফোনের ভিডিও মুড দিয়ে তার নেভিগেটরের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে আর ক্যামেরাকে রাস্তার পাশের বিল্ডিনের দিকে তাক করে দিয়েছে, যাতে পরে দেখে নিতে পারে।
যেহেতু আমাদের থাকার জন্য ২ ফ্ল্যাটের এপার্টমেন্ট ভাড়া করা হয়েছে, একটি ছেলেদের জন্য ,অন্যটি মেয়েদের জন্য। তাই আমাদের প্রথম গন্তব্য এপার্টমেন্ট। আমাদের এপার্টমেন্টটা ঠিক Wenceslas Square এর পাশে হওয়ায় বিপত্তি যেটা হল পার্কিং পাওয়া যাচ্ছিল না। ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে পার্কিং খরচ তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি। আর আগে থেকে নাকি বুকিং করে রাখতে হয়। তাই আমরা একই রাস্তা ধরে মোটামুটি ৩ বার ঘুরে আসলাম পার্কিং বের করার জন্য , বাসা পেয়েছি কিন্তু গাড়ি রাখার জায়গা নেই। কি আর করার ৩ টা গলি পাড় হয়ে একটা শপিং মলের সামনে গাড়ি রেখে আপাতত লাগেজ আর জিনিস পত্র এপার্টমেন্টে রেখে ইন্টারনেট থেকে পার্কিং খুজে বুক করে সেখানে গাড়ি রেখে আসতে হবে, সেটা না হয় কিছুক্ষন পরে করা যাবে । আপাতত এটাই সমাধান।
যাই হোক অবশেষে এপার্টমেন্টে ঢুকলাম। মোটামুটি ৬ ঘন্টার জার্নি শেষে সবাই মোটামুটি একটু টায়ার্ড ।
আপাতত ফ্রেশ হবার জন্য ঘন্টাখানেক সময় পাওয়া গেল। ইতি মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাই আপাতত রাতের প্রাগ দেখা। আগামী পর্বে না হয় রাতের প্রাগ দেখব।এ পর্বে একটু বেশি বকবকানী হয়ে গেছে তাই আগামি পর্বে শুধু রাতের প্রাগের সৌন্দর্য উপভোগ করব মানে ছবি হবে বেশি কথা হবে কম। সে পর্যন্ত ভাল থাকবেন সবাই ।