চীন দেশ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসভার মহান কবি। চীনা জনগণের মধ্যে তিনি প্রিয়তম কবি ও মহান বন্ধু। চীনা পাঠকরা তাঁর সাহিত্য ভালোবাসেন। রবীন্দ্র রচনাবলির প্রায় সবই চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ২০০১ সালে প্রথম তাঁর সম্পূর্ণ লেখা নিয়ে রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে সেখানকার শিক্ষা প্রকাশনালয় থেকে। ২০০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে হুয়া-ওয়েন প্রকাশনালয় থেকে। সৌভাগ্যবশত এ প্রকাশনার কাজে অনুবাদ ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলাম আমি। সমগ্র উপন্যাস ও গল্পের অনুবাদ হয়েছিল মূল বাংলা থেকে, অন্য কোনো ভাষা যেমন_ইংরেজি ও হিন্দি থেকে নয়। আনন্দের কথা, একই বছরে আমার লেখা রবীন্দ্রজীবনী বহু ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে চীনে। ২০০৮ সালে বেইজিং বিদেশি ভাষা শিক্ষাদান ও গবেষণা প্রকাশনালয় রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করেছে। মোট ছয় খণ্ড। এই শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো নির্বাচন ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকায় আমি আনন্দিত। ৯৫ বছরের সুবিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক জি শিয়েলিন এই বইগুলোর নাম লিখেছেন।
এখন আমি রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণ নিয়ে বলব। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা (পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন, বিখ্যাত কলা-শিল্পী নন্দলাল বসু, কবির সেক্রেটারি এলমহার্স্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কালিদাস নাগ, আমেরিকান মেয়ে গ্রিন) ১৯২৪ সালের ৮ এপ্রিল চীনে যান হংকং হয়ে। তখন সান ইয়াত সেন গুয়াং-চৌ শহরে অসুস্থ হয়ে বাস করছিলেন। তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়নি, তিনি কবিকে চিঠি লিখে গুয়াংচৌতে আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথের পূর্বর্নিধারিত পরিকল্পনা ছিল সাংহাই ও বেইজিং যাওয়ার। ১৯২৪ সালের ১২ এপ্রিল কবি ও তাঁর সঙ্গীরা সাংহাই পেঁৗছান। তাঁদের স্বাগত জানান সাংহাই শহরের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। সুদূর বেইজিং থেকে কবিকে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন অধ্যাপক সিউ সিমো। তিনি ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও আধুনিক চেতনার যুবক ছিলেন। ১৪-১৬ তারিখ কবি ছিলেন হাংচৌতে, কবি ও তাঁর সঙ্গীরা সিহু হৃদের সৌন্দর্য ও বিখ্যাত লংজিং চায়ের স্বাদ উপভোগ করেন। তিনি ঝেজিয়াং প্রদেশের শিক্ষাভবনে ভাষণ দেন। এ ঘটনা ব্যাপক সাড়া ফেলে। ১৭ এপ্রিল কবি এলেন সাংহাইতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বাণিজ্য প্রকাশনালয়ের অতিথি ভবনে তাঁকে ১৮ তারিখ স্বাগত জানান। কবির বক্তৃতা বুদ্ধিজীবী মহলে খুব সাড়া জাগায়।
২২ তারিখ সানতুং প্রদেশে এলেন ও পরদিন বক্তৃতা দেন প্রাদেশিক সভা হলে। এরপর গেলেন চিনান শহর থেকে বেইজিং। অগণিত ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক, অধ্যাপক ও গুণীজন কবিকে বরণ করলেন। চারদিকে পুষ্পবৃষ্টি ও বাজির শব্দে মুখরিত হলো শহর। রবীন্দ্রনাথের প্রথম পাবলিক সংবর্ধনা হলো রাজকীয় উদ্যানে। অজস্র গুণীজনের সমাবেশে দীর্ঘ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ দেন লিয়াং ছি চাও। তিনি বলেন_'আমরা সাত-আট শ বছর পরস্পরকে ভালোবাসিয়া ও শ্রদ্ধা করিয়া স্নেহশীল ভাইয়ের মতো বাস করিয়াছিলাম; আমরা পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করিয়াছিলাম। আমরা চীনারা আমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভারতীয়দের নেতৃত্বে পরিচালনার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভব করিয়াছিলাম।'
২৭ এপ্রিল কবি ও তাঁর সঙ্গীরা বেইজিং বাদশাহী প্রাসাদে উপস্থিত হন। এই প্রাসাদ প্রাচীর দ্বারা পূর্ণবেষ্টিত; সিংহাসনচ্যুত সম্রাট পুয়ী গুরুদেব ও তাঁর বন্ধুদের প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা প্রাসাদের নানারূপ সামগ্রী দেখেছিলেন। দুপুরবেলা তাঁরা পুয়ী কর্তৃক আয়োজিত ভোজসভায় অংশ নেন। ২৮ এপ্রিল ধরিত্রী-মন্দির প্রাঙ্গণে কবি বেইজিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তিনি দীর্ঘ এক দার্শনিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, 'য়ুরোপ এশিয়াকে অভিভূত করিয়াছে। য়ুরোপের প্রতি আমরা অন্যায় করিয়াছি, আমরা তাহাদের সহিত সমকক্ষভাবে মিলিতে পারি নাই। ইহার ফলে মিলন হইলো শক্তিমান ও শক্তিহীনের মধ্যে... একপক্ষ হইতে অপমান, অপর পক্ষ হইতে দাস্যভাব।'
৭ মে রবীন্দ্রনাথের চৌষট্টিতম জন্মদিন, মে মাসের ৮ তারিখের রাতে জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানানোর সভা হয়েছিল। লিয়াং ছি চাও কবিকে চীনা নাম 'জ্যু ঝোন্ দান্' দিয়েছিলেন। জ্যু শব্দটি 'তিয়ান্ জ্যু' থেকে নেওয়া। 'তিয়ান্ জ্যু' পুরনো চীনা ভাষায় ভারতের নাম। চীনা শব্দ 'দান্'-এর অর্থ সূর্য ওঠা। এই শব্দটি রবীন্দ্রনাথের 'রবি'র সঙ্গে সাযুজ্য। কবি চীনা পোশাক পরেছিলেন। রাতে রবীন্দ্রনাথের নাটক 'চিত্রা' প্রদর্শিত হয়। এই জন্মদিনটি কবি দীর্ঘকাল মনে রেখেছেন। ১৯৪১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতায় চীন দেশে তাঁর জন্মদিন পালন প্রসঙ্গে লিখেছেন :
ধরিনু চীনের নাম/জন্মবাসের ঘটে/নানা তীর্থে পুণ্যতীর্থবারি/ করিয়াছি আহরণ, এ কথা রহিল মোর মনে।/একদা গিয়েছি চীন দেশে,/অচেনা যাহারা/ললাটে দিয়েছে চিহ্ন 'তুমি আমাদের চেনা' ব'লে।
...ধরিনু চীনের নাম, পরিনু চীনের বেশবাস।/এ কথা বুঝিনু মনে,/যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।/আনে সে প্রাণের অপূর্বতা।/বিদেশী ফুলের বনে অজানা কুসুম ফুটে থাকে_/বিদেশী তাহার নাম, বিদেশে তাহার জন্মভূমি,/আত্মার আনন্দক্ষেত্রে তার আত্মীয়তা/অবারিত পায় অভ্যর্থনা।
মে মাসের ১৯ তারিখ বেইজিং অপেরার বিখ্যাত শিল্পী মেই লান্ ফাং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বন্ধুদের সৌজন্যে বেইজিং অপেরা 'লুও নদীর দেবী' মঞ্চস্থ করে। ২০ তারিখে লিআং ছি চাও, মেই লান্ ফাং, ইয়াও মাংফু প্রমুখ রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বন্ধুদের ভোজোৎসবে নিমন্ত্রণ করেন। এ সময় কবি বলেছিলেন, অপেরা খুব ভালো। লিআং ছি চাও কবির কাছে তাঁর লেখালেখির বিষয়ে জানতে চান। কবিগুরু বলেন, চীন দেশ যাত্রা নিয়ে তিনি লিখবেন। তিনি মেই লান্ ফাংয়ের একটা পাখায় লেখেন :
অজানা ভাষা দিয়ে/পড়েছো ঢাকা তুমি, চিনিতে নারি প্রিয়ে!/কুহেলী আছে ঘিরি,/মেঘের মতো তাই দেখিতে হয় গিরি।
৩০ মে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সঙ্গীরা সাংহাই থেকে জাপান যান। কবিগুরু চীন দেশের সাতটি শহর ভ্রমণ করেছিলন। অবস্থান করেছিলেন ৫০ দিন।
চীনা আধুনিক সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব প্রসঙ্গে বলা যাক। চীনা আধুনিক সাহিত্যের বিকাশে রবীন্দ্রনাথের খুব প্রভাব পড়েছিল, বিশেষত তাঁর কবিতা নতুন চীন দেশের কবিতার বিকাশের জন্য বড় প্রভাবক হয়ে ওঠে। তখন চীনা যুবক-যুবতী লেখক-কবি যা রচনা করতেন, তা দেখে আমরা বুঝতে পারি, তাঁদের রচনায় রবীন্দ্রনাথের বিরাট প্রভাব পড়েছিল। প্রখ্যাত লেখক গ্যুমোড়ো নিজ্য বলেছিলেন, যখন তাঁর চিন্তাধারা কাতর হয়েছিল, তখন তাঁর চিন্তার ওপর রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রভাব পড়েছিল। রচনা সৃষ্টির দিক দেখেই প্রথম তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রভাব গ্রহণ করেছিলেন। গ্যুমোড়োর লম্বা কাব্য 'দেবী' রচনায় রবীন্দ্রনাথের কাব্যের প্রভাব দেখা দিয়েছিল। তাঁর একটি ছোট কবিতা থেকে উদ্ধৃত করছি :
আমার একটি ছুরি আছে,/সে জানালায় থেকে আমার দিকে দেখে হাসে।
সে আমাকে হেসে বলে : মোড়ো, দুঃখিত হও না!/তুমি আমার সঙ্গে চুমু খেতে শীঘ্রই আস,/আমি তোমার সব দুঃখ ধ্বংস করব।/জানালার বাইরে সাগরের নীল জল
আমাকে অবিরতভাবে ডাকছে।/সে আমাকে চৌঁচিয় বলে, মোড়ো, তুমি দুঃখিত হও না!
তুমি আমার বুকে শীঘ্রই আস,/আমি তোমার সব দুঃখ ধ্বংস করব।
চীন দেশে আরেকজন মহান লেখিকা শিয় বিংসিং। যৌবনকালে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালোবাসতেন। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথ, আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনার সুন্দর কবিতাগুলো আমার জন্মদিনপ্রাপ্ত কাতর হৃদয়কে বিনষ্ট করেছিল। আপনি আপনার দার্শনিক চিন্তাধারা দিয়ে আমার নিরিবিলি হৃদয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন।' তিনি বলেছিলেন, 'আমি যখন কবিতাগুলো 'তারাগুলো' ও 'বসন্ত জল' লিখেছিলাম, সেই সময় আমি রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পেয়েছিলাম। আমি শুধু ছোট কবিতাগুলো লিখেছিলাম।' ধরা যাক, শিয় বিংসিংয়ের কবিতা 'তারাগুলো'-এর একটা :
দুর্বল ও ক্ষীণ তৃণ!/তুমি গর্বিত হও,/শুধু তুমি সব পৃথিবীর উপর সাজ করছ।
এখন আমরা রবীন্দ্রনাথের 'পরিচয়' কবিতায় দেখছি :
দয়া বলে, কে গো তুমি মুখে নাই কথা?
অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা।
দেখুন, দুটি কবিতার শৈলী প্রায় একই। ছোট কবিতা গভীর ভাবধারা প্রকাশ পেয়েছে।
উপরোক্ত দুই চীনা লেখক ছাড়াও ছুজিছিং, জেং জেন্ দুও, ওয়ান্ থেং জাও, ইয়ে শেং থাও, গ্যু শাও উই প্রমুখ এই ধরনের কবিতা লিখেছিলেন। তখনকার বড় বড় পত্রিকা 'ছেন্ বাও' (প্রভাত-পত্রিকা), 'শ্যিদেন্'(শিক্ষা-দীপ), 'জাওউ' (জাগরণ) সব সময় এই ধরনের কবিতাগুলো প্রকাশ করত। তাই এই ধরনের ছোট কবিতাগুলো চীনা আধুনিক সাহিত্যের একটা জনপ্রিয় রূপ।
কবিতা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছ চীনা উপন্যাস ও গল্প রচনার ওপর বিরাট প্রভাব রেখেছিল। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস গল্পগুচ্ছের মধ্যে একটি লাল সূত্র আছে : 'দুর্ভাগ্য জনগণের প্রতি মানবিক ভালোবাসা।' উপন্যাস নৌকাডুবির নায়ক রমেশ এই ধরনের ভালোবাসার রূপান্তর ও প্রতিনিধি। এই লাল সূত্র চীনা কথাসাহিত্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। শিয়ে বিংসিংয়ের উপন্যাস 'শরৎ বাতাস ও শরৎ বৃষ্টি' লোকজনকে দুঃখ নিয়ে আসে ইয়ে শেংথাওয়ের উপন্যাস 'আফেং', ওয়ান থোং জাওয়ের উপন্যাস 'ঈষৎ হাসি' ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের প্রভাব গ্রহণ করেছিল। মোটামুটিভাবে বলা যায়, চীনা আধুনিক সাহিত্যে বহু মাধ্যমের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহান বিশ্বকবি হিসেবে অসাধারণ রচনাগুলো লিখেছিলেন। তিনি সুহৃদয় মানুষ, সৎ লেখক। রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়ে চীনা পাঠকরা জানেন, বিশ্ব কবির দয়া ও উদারতা চিরদিন চীন দেশের লোকের মনে থেকে যায়। চীনা পাঠকদের রবীন্দ্রনাথের রচনা খুব ভালো লাগে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁদের গভীর ভালোবাসা।
লেখক : চীনা বেইজিং বিদেশি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত