প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলছে ট্রেন। অবশ্য এই গতি যেন থমকে থাকা গতি। ভেতরে ভ্রমণ ক্লান্ত মানুষ গুলো যার যার রোল প্লে করা নিয়ে ব্যাস্ত। পারফরমেন্স কারো ভালো কারো খারাপ এই যা। যাত্রীদের প্লে রোল যিনি লিখেছেন তিনি শুধু অবজার্ভ করেন কে কি করছে। কারো স্ক্রীপ্টের বাইরে একটা ডায়ালগ বলার পার্মিশন নেই। কিন্তু স্ক্রিপ্টের বাইরে অনেক কথা জমে থাকে। তবে তাদের শব্দ হয়ে বেরুবার অনুমতি নেই। সেই কথাগুলো পাক খায় ভেতরে ভেতরে। হয়তো মরেও যায়। শব্দের দেহ তো তাদের ধারণ করতে পারে না। দেহবিহীন তো জীবন হয় না! তাদের তাই আশ্রয়ও নেই।
- আজকের রাতটা এত মন খারাপ করা কেন?
- তাই নাকি? আমার তো ভালই লাগছে! তবে সিগারেট প্যাকেটে আর মাত্র একটা আছে এই যা! মশা আছে কিছু তবে ব্যাপার না।
- উফ! পরিবেশেটা নষ্ট করে দিতে এই একটা ধুম্রকাঠিই যথেষ্ট!
- সিগ্রেটেরর সাথে মেয়েদের শত্রুতা কি বুঝি না!
- আমিও বুঝি না সুযোগ পেলেই কেন সিগারেটের কথা বলেন আপনারা!
- হা হা হা.......... আরে এই কোথায় যাচ্ছো?
- জানি না।
- আমি আসছি তোমার সাথে।
- দরকার আছে কি?
- ওমা কি বলো দরকার থাকবে না কেন! আলবৎ আছে!
- আসেন তাহলে।
- কোথায় যাবে?
- একবার বললাম না জানি না। অস্থির আর অসহায় লাগছে খুব!
- চলো নেমে পড়ি!
- কিভাবে স্টেশন তো আসে নাই!
- তাতে কি লাফ দিয়ে নামা যাবে! বা চলো চেইন টানি!
- আমি কখনও টানি নাই চেইন।
- আমি টানি তাহলে!
- আচ্ছা।
- নেমে পড়ো শীঘ্রই! ট্রেন থেমেছে! নামো জলদি!
- নেমে পড়ছি তো! আপনি ভিতর থেকে চিৎকার করছেন কেন নামুন!
- নেমে গেছি। আচ্ছা তোমার কাছে কি এইটা?
- এটা আমার আলো। সবসময় সাথে রাখি। আমি অন্ধকার খুব ভয় পাই তো তাই! তবে এটাকে এখন জ্বালানো যাবে না।
- আচ্ছা। দেখেছো আকাশে মেঘ আছে। তৃতীয়ার একটুকরা একটাচাঁদ ছিলো। ওটাকে মেঘেরা ঢেকে ফেলেছে। তাই অন্ধাকার হয়ে গেছে। তবে আমি অন্ধকার পছন্দ করি। তুমি অন্ধকার ভয় পাও কেন?
- জানি না।
- হা হা হা......কি বাতাস দেখেছো?
- বাতাস কি দেখা যায় নাকি!
- তুমি না দেখো বাতাস সাহেব কিন্তু তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছেন! আমি জেলাস ফিল করছি!
- হা হা হা......আপনিও বাতাস হয়ে যান তাহলে!
- বাতাস হলে তো তুমি দেখতে পাবে না আমাকে!
- এমনিতেও তো দেখতে পাচ্ছি না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেঘগুলো সরে গেলে দেখা যেতো!
- হায় হায় বলো কি! অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলে তুমি তো হারিয়ে যাবে! দেখা যাবে তুমি গেছো একদিকে আমি গেছি আরেকদিকে! তখন এন্ডিংটা হবে এমন “অতঃপর তাহারা পরষ্পরকে খুঁজিয়া বাহির করার কর্মে ইস্তফা দিয়া একাকী অন্ধকার যাত্রায় মনসংযোগ করিলো” এটা কি ভালো হবে তুমিই বলো!
- না হবে না মোটেই! আচ্ছা আপনি কোন দিকে? ডান দিকে না বাম দিকে?
- কেন হাত ধরবা? হা হা হা হা.... তবে হাত না ধরলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কিন্তু!
- উফফ! রাগ লাগছে!
- আহারে রাগ! ধরেই ফেলো! লজ্জার কি আছে! আচ্ছা আমিই ধরছি! আরে তোমার হাত ছেলেদের মতো এত শক্ত কেনো!
- উফ! চলেন সামনে যাই! আমি তো আপনার প্রেমিকা না যে হাত নরম শক্ত নিযে গবেষনা করতে হবে!
- হাটতে থাকো সামনে রুক্ষ মাঠ ছাড়া কিছু নেই।
- হুম!
- এখানে রবীন্দ্র সাহেবকে দেখেছো?
- না তো! রবীন্দ্র সাহেব কোথ্থেকে আসবে!
- তাহলে নিয়ে এসো জলদি দেরী করো না। কি চমৎকার বাতাস! এই মুহুর্তগুলোর জন্যেই রবীন্দ্র বাবু কত সুর রচনা করে গিয়েছেন! তাকে এখানে না আনলে অন্যায় হবে কিন্তু!
- তাহলো তো আনতেই হয়! আনছি!
ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে
বহে কিবা মৃদু বায়
তটিনী হিল্লোল তুলে
কল্লোলে চলিয়া যায়
পিকো কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
কুহু কুহু কুহু গায়!
কি জানি কিসেরো লাগি
প্রাণ করে হায় হায়!
- হাততালি দিতে পারছি না। এই গানটা যেনো আমাদের জন্যেই লেখা তাই না?
- ভাবতে তো তাই ভালো লাগে! আচ্ছা চাঁদটা মনে হয় উকি ঝুকি মারছে! অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে চারপাশ।
- আহা এই কথা বলার সাথে সাথে বাতাস বাবু রাগ করলেন দেখেছো? তিনি ঝিমিয়ে পড়েছেন। আরেকখানা রবীন্দ্র গেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনো তো!
- থাকুক বাতাস না থাকুক চাঁদ থাকলেই চলবে! কি সুন্দর বাঁধানো দীঘি ওখানে না বসলে অন্যায় হবে!
- আচ্ছা চলো!
দীঘির টলটলে পানিতে চাঁদটার প্রতিফলন হচ্ছে। আর এতে মনে হচ্ছে চাঁদটার আয়তন যেন বেড়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে যেন বড়ো হচ্ছে ওটা। তারা ঘাটে বসে আছে। মেয়েটির কোলে ঘুমন্ত আলো। পরষ্পরের চেহারা দেখতে পাচ্ছে না তারা। দেখলে মেয়েটি লজ্জা পেতো। তার গাল ভিজে গেছে কেন জানি! অকারণে ভিজে নি। কারণ সে জানে পাশে কেউ নেই।
বেহায়া অশ্রু মুছে মেয়েটি আজ রাতের জন্যে ঘুমাতে গেলো। অন্ধকার যাত্রার এখানেই সমাপ্তি টেনে। জানালা খুলে নিশিতে পাওয়া একটা পাখির ডাক শুনতে লাগলো মুগ্ধ হয়ে। এই পৃথিবী নামক ট্রেনে তো মুগ্ধ হবার উপকরণের অভাব নেই! আর এর যাত্রীরা অকারণেই মুগ্ধ হয়। মাঝে মাঝে স্ক্রীপ্টের বাইরের কিছু কথা যারা কখনও শব্দ নামক দেহের আশ্রয় পায় না সেই আশ্রয়হীন কিছু সংলাপ ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে চায়। তারা কি আসলেই বেরুতে পারে? কিছু সুক্ষ্ণ বিমুর্ত অনুভুতি গুলোতে আশ্রয় নেয় সেই কথামালা গুলো। যা খুবি ক্ষণস্থায়ী!