তমার সাথে তিন বছরের ভার্চুয়াল যোগাযোগ "বাস্তবে দেখা না দেবার" কঠোর শর্তে বন্দী। শুধুই ভার্চুয়াল যোগাযোগ। কোন সম্পর্কের সংজ্ঞা নেই। আবেগের বশে বাস্তব হতে চাইলে সেখানে বলি হুমায়ুন আজাদের কথা, "কারো প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার উপায় হচ্ছে তার সাথে কখনো সাক্ষাৎ না করা!"
কিন্তু মন দখলের জন্য বাস্তববাদী, বাস্তব, অস্তিত্বমান হবার প্রয়োজন নেই। অদৃশ্য, অলৌকিকতার অনুভব দিয়েও সিজোফ্রেনিক হওয়া যায়। আমি তাই তমার বাস্তব জীবন প্রবাহের কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছি। কখনও আমি ভীষণ স্বার্থপর, আবার কখনও বা আবেগ, অনুভূতিহীন, নির্বিকার গাছ।
-"অনুভূতিহীন জীবের আবার স্বার্থ কী, তমা?"
নিজের স্ববিরোধিতায় অপ্রস্তুত শোনায় তাকে। কখনও বা সখেদে বলে, "আমি আপনাকে চিনিনা, দেখিনি, জানিনা, শুনিনি।" পুরোপুরি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবার ক্ষমতাও আমার আছে। কিন্তু তমা চায় আমি পরাবাস্তবেও থাকি, খোজ নিই। কিন্তু তার বাস্তব জীবন থামিয়ে দেবার অপরাধ আমারই, হোক সেটা পরাবাস্তব অংশীদারিত্ব।
পুরনো এক ছবিতে আমাকে প্রথম দেখেই বলেছিল, আপনার মুখে অমানুষিক নিষ্ঠুরতার ছাপ।
--"মানুষ কি মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ নিয়ে জন্মায়, তমা?"
উত্তর বুঝেই তার মায়া হয়। মায়া নিজেই একটা মানসিক ভ্রম, তাও পরাবাস্তব কারো জন্যে। আমি তাকে বার বার বিব্রত করি। ছাত্রী পড়ালেও তার রাগ হয়।সম্পর্কহীন, অধিকারহীন জীবের জন্য কিসের এত রাগ?
--"আমি এখনও অমানুষ হয়ে যাইনি, তমা!"
--"কীভাবে বুঝলেন?"
ধরো আমার পাঠশালায় গোটা দশেক ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে একজন ভয়ংকর সুন্দরী। আমি বুঝতে পারি, ধরতে পারি সৌন্দর্যের বিষয় গুলো। আমাকে সেখানেও প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে হয়, সুন্দরীর চোখের সাথে চোখ যেন এক না হয়। সবাই কম বেশি প্রশ্ন করলেও, সুন্দরী তেমন করেনা। এটা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক।
--"ছি ছি...এত অধঃপতন!"
--"আমি তো তোমাদের ঘৃর্ণাহ্ পুরুষের বাইরে কেউ না। পুরুষ, পরিমল সবই তো এক জাত, তাই না?"
আমার কি তাহলে অন্যদিকে তাকিয়ে সুন্দরীর প্রশ্নের জবাব দেয়া উচিৎ ছিল? সেটা কি ভাল দেখাতো? কিন্তু প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে চোখে চোখ পড়তেই সুন্দরী চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়, সেটার কী মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা?
হয়ত সুন্দরীরা সব পুরুষের দৃষ্টিতেই 'পরিমল' দেখে। কিংবা আমার অমানুষিক, ভীতিকর দর্শন এড়াতে চায়। মাস্টার হয়েও হাসতে পারিনা, পাছে আমার হাসির মাঝে কেউ লাম্পট্য পায়। সমাজ, সংসারের কুদৃষ্টি এড়াতে আমি পাথরের মত শক্ত হয়ে আমার দায়িত্ব করে যাই।
বুঝতে দেইনা আমার মাঝে একটা মানুষ আছে, যে অন্যায়ভাবে কারো গতিবিধি অনুসরণ করে, মোহাবিষ্ট হয়। খাতা, কলম দিতে গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে, স্পর্শমুক্ত থাকতে। তারপরেও দুর্ঘটনা হয়। আসলেই কি দুর্ঘটনা? ইচ্ছাকৃত হলে কি আমার ভাল লাগা উচিৎ? কিন্তু সে ভাল লাগাটাও যে কলঙ্কিত। আমার কি তাহলে অনুভব করার অধিকারটুকুও অবাঞ্ছিত?
তমা প্রায় চিৎকার করে ওঠে,
--"আপনি সুন্দর মুখ দেখে মানুষ বিচার করেন, এটা খুবই খারাপ!"
শাহরুখ খান এলে তোমরা এক সপ্তাহের জন্য মোহাবিষ্ট হওনা? সেটাই বা কী বিচার করে বলো? আমি তো মর্ত্যের মানুষ দেখেই না হয় মোহাচ্ছন্ন হলাম, কটা দিন। রেশ কেটে গেলেই আমি নতুন শহরে, নতুন দিনে, নতুন মানুষ। পুরুষের দৃষ্টি কতটা খারাপ হতে পারে, আমার চেয়ে কে'বা ভাল বুঝে? নারী-পুরুষের জৈব রসায়ন তো এক না, সেখানেও অন্যায় বৈষম্য করেছে প্রকৃতি।
তারপরেও আমি তো অনধিকার দৃষ্টি পাতের চর্চা করিনা, তমা। আমি চাইও না দৃষ্টি থেকে আমার কোন সম্পর্ক হোক, অনুভূতি হোক, সংসার হোক। যদি তাই হত, তবে এই পরাবাস্তব যোগাযোগের একটা ইতি হতো। তোমার মায়া-ভ্রম কেটে যেত, আমার অপরাধ মোচন হত। কিন্তু সেই অবিচার, অপরাধের দায় সারার জন্য বাস্তবের চোখ দিয়েই আমাকে কাউকে পছন্দ করতে হবে, দৃষ্টির মাঝে 'পরিমলে'র খাদ থাকলেও করতে হবে।
কিন্তু পুরুষের কলঙ্কিত দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভাল লাগার মত অপরাধ করার চাইতে নিভৃতচারে থাকা ভাল, পরাবাস্তবতাই ভাল। আমি তাই নিভৃতচার চাই, একান্ত আপন আধাঁরে।