ঝর্ণায় যাবার পথটা এত্ত বেশি খাড়া নিচুতে চলে গেছে যে সবাই রীতিমত ভয় পেয়ে যাচ্ছিল । একটু সহজ করেই বলি এটা প্রায় ৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলে খাড়া নিচের দিকে চলে গেছে । প্রায় ঘণ্টা দেরেক নিচুতে নামতে নামতে অবশেষে ঝর্ণা । আমি পাগলের মত জুতো, ঘড়ি, মোবাইল ফোন, ছুড়তে ছুড়তে সবার আগে পা ডুবিয়ে পাথরের উপর বসে পড়লাম । কেন উন্মাদ হলাম না আমি !!!!! ঝর্ণার নিচের দিকে রংধনু, এত্ত রঙ, এত সৌন্দর্য কেন এতদিন আমাকে গ্রাস করেনি । উপরের দিকে তাকিয়ে ঝর্ণার শুরুটা খুঁজতে চাইলাম কিন্তু সেটা আদৌ সম্ভব নয় জেনেই কাজটা করছিলাম । দেখে মনে হচ্ছে চিকন শ্যামলা শরীরটা কেউ স্বচ্ছ সাদা শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে, এটা সেই সুন্দরী ঝর্ণা । এমন চিকন খাড়া রাস্তা দিয়ে ঘণ্টা দেড়েক গড়াতে গড়াতে আর হাঁটতে হাঁটতে শেষমেশ পৌঁছে যাবার পরে সব কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায় । এটাও ভুলে গিয়েছিলাম যে কিছুক্ষনের মাথায় আবার ফেরার পথে হাঁটতে হবে ! ঝর্ণার পানি এত বেশি বিশুদ্ধ যে সাবান শ্যাম্পু কিছুর প্রয়োজন ই পড়ছিল না । একটুও বাড়িয়ে বলছিনা, এটা সত্যিই !
এবার ফেরার পালা । নামতে একটুও কষ্ট হয়নি আমার কিন্তু কতটা নিচে নেমেছি এটা টের পেলাম ওঠার সময় । আমার দলের সবাই আমাকে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিল । কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় যে প্রায় পুরো ভ্রমণটায় আমার মত সুস্থ, স্বাভাবিক আর প্রাণবন্ত আর কেউই ছিলনা । বেলা প্রায় তিনটে, ক্ষুধার তাণ্ডবে সবাই বারবার নেতিয়ে পড়ছিল তবু চারটের ভেতর কেওক্রাডং পৌঁছাতে হবেই, নাহলে আজ রাতে এখানেই থাকতে হবে । এটা চিন্তা করে উঠতে শুরু করলাম । লাঞ্চ করে ৫ টায় আবার লেকপাড়ের সেই কটেজে ফেরার তাড়া । ততক্ষণে সূর্যটা আমাদের মতই তাড়াহুড়ো করে ঘরে ফিরবার আয়োজনে মত্ত । কমলা রঙের থালার মত রঙ ধরেছে ওটা । আমরা কেবলই হাঁটছি, এবার আর কোন রেস্ট নয় । এমন সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য জীবনে হবে কিনা জানিনা তবে এতগুলো রঙ দিয়ে সূর্যাস্ত হতে আমি কখনো দেখিনি । প্রথমবারের মত জীবনে এতকিছু করলাম যে বারবার ভেবে দেখতে ইচ্ছে করছিল আরও কতকিছু দেখার বাকি আছে প্রথমবারের মত । আসার সময় পথ যতই সংক্ষিপ্ত মনে হোক না কেন পথ ফুরনোর নাম ছিলনা । এর মধ্যে একজন তো কিছুক্ষন পর পর আছাড় খেয়ে আতঙ্কিত করে তুলছিল আমাদের, আরেকজনের সুগার ফল করল । তবে বাঁচলাম, জোছনার বদৌলতে । বেচারা সেদিন দিগন্ত জোড়া ধুয়ে মুছে দিচ্ছিল আলো দিয়ে । মশাল জ্বালালেও কিছুক্ষন পর পর নিভে যাওয়াতে মূমূর্ষ মোবাইল ফোনের বেঁচে থাকা চার্জে টর্চ জ্বালিয়ে তবে বাঁচোয়া । আগেই শুনেছিলাম সন্ধ্যেরাতে নাকি মাঝেমাঝেই স্থানীয়দের উৎপাতে বড়সড় ঝামেলায় পড়তে হয় । গাইডের তখন নিশ্বাস ফেলার ফুরসত মিলছিল না, একের পর এক সবাইকে হাত ধরে ধরে সংকীর্ণ রাস্তাগুলো পার করে দিচ্ছিল বেচারা । আমি তখন পুরদস্তুর একশনে

পরেরদিন ছিল আমাদের ফিরে আসা, রুমা বাজার হয়ে বান্দরবান । সেদিন ছিল রুমা বাজারে হাটবারের দিন । বাঁশের, বেতের ঝুড়িতে করে সবাই যার যার পণ্য নিয়ে পশরা সাজিয়ে বসেছে । আর ছিল এক সমুদ্র শুঁটকি !!!!! মানুষগুলো দেখে, তাদের জীবনধারা দেখে অনুভব করছিলাম এটাকেই মিশে যাওয়া বলে, প্রকৃতির সঙ্গে । আমাদের আগের সভ্যতা গুলো সহস্র বছর আগে হয়ত এমন করেই মিশে মিশে ছিল আর আমরা যেভাবে মিশে মিশে আছি কংক্রিটের সঙ্গে !
***********************************