আজ কল্পনা চাকমা অপহরণের ১৩ তম বার্ষিকী।
১৯৯৬ সালের এই দিনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্যাঘোনা গ্রামের বাড়ি থেকে অপহৃত হন। কল্পনার মা ও দুই ভাই, যারা এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শি, তারা এই অপহরণের জন্য স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের লেফটেনেন্ট ফেরদৌসকে দায়ী করেছিলেন।
এই ঘটনা সে সময় দেশি-বিদেশী মিডিয়ায় ঝড় তোলে। পাহাড় ও সমতলে গড়ে উঠে যুগপদ আন্দোলন।...
এরপর সরকারের পর সরকার বদল হয়। কাচালং, চেঙ্গী, মাইনী, শঙ্খ, মাতামুহুরি, কাপ্তাই ও কর্ণফুলিতে গড়িয়ে যায় অনেক ঘোলা জল। ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়ে তা কাগুজে চুক্তিতেও পরিনত হয়। ...
কিন্তু পাহাড়ি মেয়েটির আর সন্ধান মেলে না। সুরাহা হয় না বাঘাইছড়ি থানায় দায়ের করা অপহরণ মামলাটি। হিমাগারের অতল গহব্বরে হারিয়ে যায় সরকারি তদন্ত রিপোর্ট। স্তিমিত হয়ে আসে তাকে উদ্ধারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন।
আর এই ১৩ বছর ধরে কল্পনা চাকমা অপহরণের মতো এতো বড় একটি মানবাধিকার লংঘনের দায় বাংলাদেশ নামক কথিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বহন করে চলে। ...কল্পনার পাহাড়ি বন্ধুরা তাদের সহকর্মী হারানো বেদনা বহন করে চলেন ওই ১৩ বছর ধরেই।...
আর আমরা যারা নিজেদের শুভ বুদ্ধির মানুষ বলে দাবি করি, সেই সব সংখ্যাগুরু বাঙালিদের মনের গহিনে কী ১৩ বছরের পুরনো এই কাঁটা কী ক্ষত সৃষ্টি করে না?
*
আজ কল্পনার অপহরণ দিবসে সকাল ১০টায় 'পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন' ঢাকার শাহবাগের জাদুঘরের সামনে আয়োজন করে এক মানববন্ধন কর্মসূচির। পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের এই কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন সাংবাদিক, শিক্ষক, নারী নেত্রী, রাজনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মীসহ বুদ্ধিজীবী মহল।
মানববন্ধনের কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট কলামিস্ট আবুল মোমেন, লেখক শাহরিয়ার কবির, আদিবাসী নেতা ও লেখক সঞ্জিব দ্রং, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, ঢাবির শিক্ষক রুবাইয়াৎ ফেরদৌস, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা হায়দার আকবার খান, নারী নেত্রী ফরিদা আখতার, অ্যাডভোকেট খালেদা খাতুন, সাঁওতাল আদিবাসী নেতা রবীন্দ্র নাথ সরেন, পাহাড়ি নেতা দীপায়ন খীসা প্রমুখ।
তো এই মানববন্ধনের কর্মসূচিতে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন' যে প্রচারপত্র বিলি করে, তার নির্বাচিত অংশ অনেকটা এরকম:
কল্পনা চাকমা অপহরণের ১৩ বছর: রাষ্ট্র আর কতকাল মূক ও বধির হয়ে থাকবে?? তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে
সংগ্রামী দেশবাসী,
কল্পনা চাকমা শাসকশ্রেণীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের আগুয়ান সৈনিক। তিনি লড়াইয়ের ময়দানে সরাসরি অংশ গ্রহণ করে জুম্ম (পাহাড়ি) জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে সংগঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। শ্রমজীবী জনতার মুক্তি-সংগ্রামের দর্শনকে আত্মস্থ করেছিলেন তিনি।
কল্পনা অপহরণের পর জুম্ম জনগণ যেভাবে প্রতিরোধে গর্জে উঠেছিলো, ১৯৯৬ সালের ২৭ জুন কাচালং জনপদে রূপম, সুকেশ, মনতোষদের বীরত্বপূর্ণ আত্নবলিদানের সেই সুমহান পথে জুম্ম জনগণ এখনো সমভাবে আগুয়ান। হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি কল্পনা চাকমার প্রদর্শিত পথে আপোষহীন ধারার জুম্ম জনতার আত্ন-নিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালনের সাহসী শপথ নিতে চায়।
আসুন, আমাদের সাথে সোচ্চার হয়ে আওয়াজ তুলুন:
১. অবিলম্বে অপহরণ রিপোর্ট প্রকাশ ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নিতে হবে।
২. পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠিত নারী ধর্ষণ, অপহরণ ও গণহত্যাসহ মানবাধিকার লংঘনের সকল ঘটনার শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
৩. সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ও 'অপারেশন উত্তরণ' প্রত্যাহারপূর্বক সেনা বাহিনীকে স্থায়ী সেনা নিবাসে ফিরিয়ে আনতে হবে।
এবং
৪. অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করতে হবে।।
---
ছবি: ১. শুভাশীষ চাকমা, ২, ৩ ও ৪. লেখক।
আরো পড়ুন, ১. কল্পনা চাকমা: একটি আহ্বান http://www.sachalayatan.com/biplobr/24938,
২. কল্পনা চাকমা এখন কোথায়? Click This Link